সুজাতা দাস, লেখিকা ও সমাজকর্মী, কলকাতা:

যদিও দোলযাত্রা হিন্দু বৈষ্ণব অর্থাৎ কৃষ্ণ ভক্তদের উৎসব তথাপি এই উৎসব হোলি বা বসন্ত উৎসব নামেও পরিচিত সারা পৃথিবীতে, যেহেতু আমার ছোটবেলা এবং বেড়ে ওঠা নবদ্বীপে তাই গৌরাঙ্গের জন্মতিথি হিসেবে এই আনন্দের কিছুটা ভাগ আমার জুটে গেছে ছোটবেলায়, তবে সেই সময় এতো জৌলুস ছিল না আর আমরাও রাস্তায় বেড়নোর সুযোগ পেতাম না তবে বিকেলে সব মন্দিরে ঘুরে বেড়াতাম বড়দের সাথে আর প্রসাদও পেতাম মন্দিরে। 

বড় হতে হতে বিবাহসূত্রে কলকাতা বাসিনী হওয়ার ফলে নবদ্বীপ আজ বহু দুরের, এই অনুষ্ঠানগুলোতে আর যাওয়া হয়ে ওঠে না সংসার আর লেখার কারণে, তবে বড্ড মন কেমন করে এই সময় গুলোতে, আজও মনে পড়ে অবসরে ছোটবেলা আর কৈশোরকে আবার ঠিকও হয়ে যায় নিজে নিজেই।

যাই হোক বৈষ্ণব মতে এই ফাল্গুনী তিথিতে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ, রাধিকা ও গোপীনিদের সাথে আবির গুলাল সহযোগে রঙ খেলায় মেতেছিলেন, এই নিয়ে নানা কাহিনিও আছে। সেই থেকেই এই দোল খেলার উৎপত্তি, তাই বৈষ্ণব মতে দীক্ষিত মানুষ আজও এই পূর্ণিমাতে প্রথমেই রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহের চরণে আবির গুলাল দিয়ে পুজো করেন,  তারপর তাদের চতুরদোলায় বসিয়ে শহরের রাজপথে পরিক্রমায় বের হন কৃষ্ণ নাম সহযোগে সেটা যেমন বৃন্দাবনে তেমনই নবদ্বীপে--- এখন অবশ্য মায়াপুরে ইস্কনের মন্দির হওয়ায় মায়াপুরেও জাঁকজমকের সাথে দোল উৎসব পালিত হয় আর বিদেশীদের আগমনে গমগম করে নবদ্বীপ আর মায়াপুরের রাজপথ--- তবে আমার ছোটবেলার সাথে এর মিল খুঁজে পাই না কারণ তখন আন্তরিকতা ছিল প্রবল আর এখন চাকচিক্যের আধিক্য, যেখানে একদম সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই।

সেই রাজপথেই সকলে রাধাকৃষ্ণের চরণে আবির দেওয়ার পর ভক্তেরা নিজেদের মধ্যে আবির গুলাল নিজেরা অর্থাৎ নারীপুরুষ নির্বিশেষে একে অপরকে আবীর দিয়ে থাকেন--- এই পরিক্রমা দেখা যায় মূলত বৃন্দাবন ও নবদ্বীপ মায়াপুর মথুরা তাছাড়াও নদীয়া ও বৃন্দাবনের অনেক জায়গায়।

নবদ্বীপে এই উৎসব পালিত হয় শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্মদিন হিসেবে, নবদ্বীপের প্রতিটি মন্দিরে মহাপ্রভুর জন্মদিন হিসেবে লক্ষ্য লক্ষ্য ভক্তের সমাগম হয়---- নবদ্বীপের প্রাচীন মায়াপুরে গৌরাঙ্গের জন্মভিটে সেদিন অনেক সুন্দর করে সাজানো হয় এবং ভোগরাগ হয়, ভক্ত সমাগমে এই প্রাঙ্গন মুখরিত হয় হরি সংকির্তনে--- খুব ভোরে শুরু হয় নগর কীর্তন তারপর জায়গায় জায়গায় মহাপ্রভুর মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়, এই দোল বা হোলি সারা বিশ্ব জুড়ে পালিত হয়, তবে হোলি শব্দটা এসেছে হোলিকা দহন থেকে অর্থাৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় যে দহন বা অগ্নিপ্রজ্বলন হয় তার থেকে।

আসা যাক সেই ঘটনাতে যদিও অনেকের জানা এই গল্প তবুও আরেকবার---- হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও দিতির কন্যা ও তাদের পুত্র হিরণ্যকশিপুর বোন, এরা দুজনেই ছিলেন হিংস্র এবং বিষ্ণু বিদ্বেষি। প্রহ্লাদ ছিলেন হিরণ্যকশিপুর ও কয়াধুর সর্ব কনিষ্ঠ পুত্র, তিনি ছিলেন তার মায়ের মতোই বিষ্ণু ভক্ত অসুর কুলে জন্মেও তার ভক্তি এতটুকুও কমেনি বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে হিরণ্যকশিপু সিদ্ধান্ত নেন পুত্রকে মৃত্যু দণ্ড দেবার।

কিন্তু প্রতিবারই তার পরিকল্পনা বিফলে যাওয়ায় তার বোন হোলিকা নিজে দায়িত্ব নেন প্রহ্লাদ বধের কারণ তিনিও তার দাদার মতোই কুটিল ছিলেন---

একবার হোলিকা অগ্নিদেবকে তপস্যায় তুষ্ট করে তার থেকে বর পেয়েছিলেন যে হোলিকাকে কখনও আগুন স্পর্শ করবে না--- সেই বরে বলীয়ান হয়ে এইরকমই এক বসন্ত পূর্ণিমার আগের দিন প্রহ্লাদকে মারার জন্য অনেক বিরাট চিতা তৈরী করে তাতে প্রবেশ করেন। অহংকার আর শক্তির অপব্যবহারের কারণে তার প্রাপ্ত বর নষ্ট হয় ফলে হোলিকা পুড়ে মারা যায় নিজ হাতে তৈরি চিতায়--- আর বিষ্ণু ভক্তির কারণে প্রহ্লাদ জলন্ত অগ্নিকুন্ড থেকে জীবিত ফিরে আসেন।

সেই থেকে দোলের আগের দিন হোলিকা দহন করেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতে, আর পরের দিন অসুভকে হারানোর আনন্দে আনন্দ করেন রঙ আবির আর গুলাল দিয়ে নিজেদের রাঙিয়ে। অপর পক্ষে কথিত আছে শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামের এক অত্যাচারী অসুরকে বধ করে বৃন্দাবনকে অসুর মুক্ত করেছিলেন এবং আগুনে পুড়িয়েছিলেন, তাই আনন্দে পরের দিন এই হোলি উৎসব পালিত হয়। কারণ যাই থাকুক এই আনন্দ উৎসব পালিত হতো আবির দিয়ে পরে এতে রঙ যুক্ত হয়, কিন্তু এখন আবার আবিরেই ফিরছেন সকলেই।

এই দিনটি গুরুদেবের আশ্রম শান্তিনিকেতনে বিশেষ ভাবে পালিত হয়, এখানে ভোর ভোর স্তোত্র পাঠ থেকে শুরু করে গান নাচ নাটক অনুষ্ঠিত হতো এবং আজও হয়। পরবর্তীতে এখানে এই বসন্ত উৎসবটি অন্য মাত্রা পায়, খুব সকালে আবির খেলতে খেলতে প্রভাত ফেরি ও তার সাথে নৃত্যের তালে "ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল", এই গানটি পরিবেশনের সাথে নিজেদেরও সাজিয়ে নেয় পলাশের লাল রঙে কচিকাঁচাদের সাথে বড়রাও।

এই হোলি উৎসব পালিত হয় নন্দগাও ও বারসানাতেও তবে সেখানে বাইরের কেউ অংশগ্রহণ করার অধিকার পান না, এ এক আলাদা হোলি--- কথিত আছে শ্রীকৃষ্ণ রাধিকাকে আবীর গুলাল দিতে বারসানা পর্যন্ত আসতেন এবং  বারসানার মানুষদের ভীষণ জ্বালাতন করতেন।ওখানকার মানুষেরা রোজ রোজ এই জ্বালাতন সহ্য করতে না পেরে শ্রীকৃষ্ণ ও তার সখাদের লাঠি দিয়ে মজা করে আঘাত করতেন--- সেই ঐতিহ্য আজও পালন করেন এই দুই গ্রাম চল্লিশ দিন ধরে, এই হোলি একেবারেই আলাদা ধরনের এর নাম "লাথ মার হোলি"। বিপরীতে বারসানা গ্রামের মানুষও আসেন নন্দগাও তবে পুরো ব্যাপারটা এই দুই গ্রামেই সীমাবদ্ধ সাথে ওই ঐতিহ্যও।

বৃন্দাবনের বাঁকে বিহারী মন্দিরে খেলা হয় হোলি লাখো লাখো বিদেশিরা এই হোলিতে অংশ গ্রহণ করেন, অংশ গ্রহণ করেন সারা ভারতের মানুষেরাও, মুখরিত রাধে রাধে ধ্বনির সাথে প্রভু শ্রীকৃষ্ণের সাথে হোলি খেলেন ভক্তেরা। সৃষ্টি হয় সেই সময় এক অদ্ভুত পরিবেশের--- কথিত আছে রাধার গৌরবর্ণ কৃষ্ণের কষ্টের কারণ ছিল এবং তিনি যশোদাকে সেই কথা বলতেনও বারবার--- তাই রাধাকে কালো রূপে দেখতে শ্রীকৃষ্ণ আবীর ছুঁড়ে দিতেন রাধার গায়ে বিপরীতে রাধারাণী ও তার সখীরাও একই কাজ করতেন--- তাই মথুরাতে আজও এই ছুড়ে ছুড়েই রঙ খেলা হয়।

দোল উৎসব বা হোলি যে নামেই পরিচিত হোক না কেন এই উৎসব সারা ভারত ও পৃথিবীর অনেক জায়গায় পালিত হওয়া এই উৎসব অধর্মকে পরাজিত করে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা--- আর সেটা পালনের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই প্রয়াস জারি রাখুন, মাতুন দোল বা হোলি উৎসবে তবে অবশ্যই হিংস্রতাকে দুরে সরিয়ে।

(www.theoffnews.com - holi festival)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours