তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

গ্রেট ট্রাইগনোমেট্রিকাল জরিপ (জিটিএস) ১৮০০ সালে শুরু হয়েছিল। জিটিএস টাওয়ার নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। এটি আজও বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান কাজ হিসাবে প্রশংসিত হয়। দ্য গ্রেট আর্ক (৭৮০ ই দ্রাঘিমাংশ) জরিপের মেরুদন্ড ছিল এবং ১৬০০ মাইল ইঞ্চি নিখুঁত সমীক্ষাটি পৃথিবীর পৃষ্ঠের দীর্ঘতম পরিমাপ হিসাবে চেষ্টা করা হয়েছিল।

লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগে ১৭৭৫ সালে কলকাতা এবং ব্যারাকপুরের লাটভবনের মধ্যে যোগাযোগের জন্যে পরিকল্পিত হয় ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড। যা আমজনতার কাছে ‘বিটি রোড’। এই টাওয়ারের কনসেপ্টটা দিয়েছিলেন প্রতিভা ধর। এই অসম্ভব কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যান জর্জ এভারেস্ট। ইনি বেঙ্গল আর্টিলারির চাকরি নিয়ে ভারতে আসেন ১৮০৬ সালে। এইখানেই কাজ চলছিল কর্নেল উইলিয়াম ল্যাম্বটমের উদ্যোগে। ইনি ছিলেন ত্রিকোনোমিতি পদ্ধতিতে জমি জরিপের জন্ম দাতা। ইনি ১৮২৩ সালে মারা যান, কাজটা এগিয়ে নিয়ে যান জর্জ এভারেস্ট। ১৮৩০ সালে জর্জ এভারেস্ট হন ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল, ১৮৬১ সালে নাইট উপাধি পান। ১৮৪৩ সালে এভারেস্ট দেশে ফিরে যান এবং ১৮৬৬ সালে লন্ডন শহরে পয়লা ডিসেম্বরে মারা যান। জর্জ এভারেস্টের পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রথম প্রয়োগকারী ছিলেন রাধানাথ শিকদার যিনি ছিলেন ডিরজিওর মন্ত্র শিষ্য। ১৮৫২ সালে রাধানাথ তথা এভেরেস্টের কর্মের ফলে জানা যায় পৃথিবীর উচ্চতম গিরিশৃঙ্গের কথা।

রাধানাথ শিকদার যখন হিমালয়ের মাপঝোকের  দায়িত্ব নিলেন তখন পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখর হিসেবে পরিচিত। হিমালয় পর্বতমালার ৭৯টি শৃঙ্গের মধ্যে ৩১টি তখন নামকরণ হয়ে গেছে, অন্যগুলো সংখ্যা দিয়ে পরিচিত। ১৮৫২ সালে ত্রিকোনমিতির হিসেব নিকেশে হিমালয়ের শৃঙ্গের উচ্চতা মাপতে গিয়ে তার কাছেই প্রথম ধরা পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়েও বড় শিখর হিমালয়ে রয়েছে। ১৫ নম্বর শৃঙ্গটিই সবচেয়ে উঁচু। স্থানীয় ভাষায় চমুলুংমা বা পৃথিবীর মা হিসেবে পরিচিত এই শৃঙ্গ ভূমি থেকে মেপে দেখলেন উচ্চতা ২৯০০০ ফুট, তিনি বেশ ক'টি প্রেক্ষাপট থেকে পরিমাপ নিলেন এবং দেখলেন উচ্চতার হেরফের হচ্ছে না। তিনি সার্ভেয়ার জেনারেলকে জানালেন এবং অংক কষে দেখলেন এর চেয়ে উঁচু আর কোনো শৃঙ্গ হিমালয়ে নেই, পৃথিবীতেই নেই। 

১৮৫২তে আবিষ্কৃত হলেও আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় অনেক লম্বা সময় লেগে যায়। ৪ বছর পর ১৮৫৬ সালে ঘোষণা করা হয় এবং শৃঙ্গের নাম দেওয়া হয় মাউন্ট এভারেস্ট। নামটি পছন্দ করেছেন সার্ভেয়ার জেনারেল অ্যান্ড্রু স্কট ওয়া। এই নাম নিয়ে ভারতবাসীর একটি আক্ষেপ রয়েছে- এর আবিষ্কারক এবং উচ্চতা নির্ধারক ব্যক্তি রাধানাথ শিকদারের নামেও তো হতে পারত মাউন্ট রাধানাথ। তবে এ নিয়ে রাধানাথও নিস্পৃহ ছিলেন এবং এমনকি জর্জ এভারেস্টও তার নাম সর্বোচ্চ এই শৃঙ্গের সাথে সংযুক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি করেছেন।

জর্জ এভারেস্ট যার নামে বিশ্ববাসী ও বিজ্ঞানীরা  আজও গর্ব অনুভভ করে। ইনি আজও কলকাতার দমদম ও পাইকপাড়ার অহংকার। এই অর্ধ শতাব্দী দীর্ঘ প্রকল্পের সাথে জড়িত সমীকরণগুলি প্রাক কম্পিউটারের যুগে প্রায় অসম্ভব এবং জটিল আর এটি ছিল তার সময়ের সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রকল্প, যে কোনও সমসাময়িক যুদ্ধের চেয়ে বেশি পুরুষকে হত্যা করেছিল এই টাওয়ার তৈরি হওয়ার সময়ে,  এলাকা ছিল জঙ্গলে ভর্তি তারপর ম্যালেরিয়ার প্রাদূর্ভাব। ম্যালেরিয়া পুরো জরিপ দলগুলিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল, বাঘ এবং বন্য জন্তুরা আক্রমন করেছিল এবং বহু মানুষ মারা গিয়েছিল। এটা পিরামিডের কাঠামোকে ভেবে তৈরি করা। জ্বলন্ত ইট দিয়ে নির্মিত এই উঁচু টাওয়ার। ভাবা যায়?

টাওয়ারটি দক্ষিণ প্রান্তকে কলকাতা দ্রাঘিমাংশের সিরিজের বেস লাইন চিহ্নিত করে। টাওয়ারটি পার্কার তৈরি করেছিলেন এবং প্রায় ৭৫ ফুট উচ্চতায় তোলা হয়েছিল। এটির একটি কাটা পিরামিড কাঠামো রয়েছে যার বেস বেস ১৭ ফুট বর্গ এবং শীর্ষটি ১৩ ফুট বর্গ মাপবে। টাওয়ারটি বর্তমানে গণপূর্ত বিভাগের (পিডব্লিউডি) সম্পত্তি যা সেঞ্চুরি পুরাতন টাওয়ারকে দুধের সাদা রঙের একটি নতুন রূপান্তর দিয়েছে। টাওয়ারটির একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং জিটিএস টাওয়ারের বাইরের দেওয়ালে ইংরেজী ও বাংলায় লিখিত আছে। কয়েক দশক আগে টাওয়ারটিতে জনপ্রিয় এন্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলিনের একটি বিজ্ঞাপন ছিল এবং এটি বোরোলিন টাওয়ার নামে পরিচিত ছিল আজ টাওয়ারটি বিটি রোড এবং লকগেট ফ্লাইওভারের সংযোগস্থলে এবং চিড়িয়া মোড়ের ঠিক দক্ষিণে দাঁড়িয়ে আছে। টাওয়ারটি শব্দের মধ্যে কাঠামোগত এবং গেটগুলি সর্বদা লক থাকে।

পাইকপাড়ার ইতিহাসে এটি উল্লেখযোগ্য কর্মযোগ্য এবং ঐতিহাসিকও বটে। কেন রাধনাথ শিকদারের কথা বলছি, বৃহত্তর পাইকপাড়া তথা চিৎপুরের ইতিহাসের সাথে যুক্ত এই অসাধারণ মানুষটি। ইনি পাইকপাড়ার রাজবাড়ীতে দুই একবার এসেছেন পাইকপাড়া রাজার আমন্ত্রণে। রাধানাথের জন্ম কলকাতা শহরের জোড়াসাঁকো এলাকার শিকদার পাড়ায়, ১৮১৩ সালের অক্টোবর মাসে। তাঁর বাবা তিতুরাম শিকদার ও তাঁর পরিবার ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভব, কলকাতার আদি নিবাসী। জ্যেষ্ঠপুত্র রাধানাথকে পাঠশালায় গুরুমশাইয়ের কাছে পড়ানোর পরে ফিরিঙ্গি কমল বসুর স্কুলে ভর্তি করে দেন তিতুরাম। স্কুলটি ছিল ৪৮ নম্বর চিৎপুর রোড। এর পর ১৮২৪ সালে রাধানাথ হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে সাত বছর দশ মাস পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। আর এই সময়েই তাঁর প্রতিভা, ব্যুৎপত্তি, চিন্তাশক্তির বিস্ময়কর স্ফুরণ দেখা যায়। কলেজের সব শিক্ষকেরই স্নেহভাজন ছিলেন। ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন প্রবাদপ্রতিম প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। তাঁর মতবাদে আকৃষ্ট হয়ে যে ক’জন ছাত্র ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এ যুক্ত হয়েছিলেন, তার মধ্যে ছিলেন রাধানাথ। সঙ্গে পেয়েছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, হরচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়দের, যাঁদের কারও কারও সঙ্গে রাধানাথের আজীবন বন্ধুত্ব বজায় ছিল। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com GTS Minar George Everest Radhanath Sikdar)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours