তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

১৮২৬ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে উন্নীত হন রাধানাথ, ডিরোজিওর ছাত্র হওয়ার সুযোগ পান। এর আগে তিনি মলিস সাহেবের কাছে ব্যাকরণ পড়েছিলেন, এ বার শিখলেন ইংরেজি রচনা, ব্যাকরণ, পদ্য প্রভৃতি। তবে কলেজ জীবনে তাঁর কাছে সবচেয়ে জরুরি ছিলেন গণিত শিক্ষক ডক্টর টাইটলার, সংস্কৃত ভাষাতেও যাঁর অগাধ দখল ছিল। রাধানাথ সে সময়ে হিন্দু কলেজের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ, তাঁর অগাধ প্রতিভা দেখে টাইটলার তাঁকে নিউটনের বিখ্যাত বই ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা’ পড়িয়েছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি জ্যামিতির এমন একটি সম্পাদ্য সমাধান করে ফেলেছিলেন, যা গ্লিনিংস ইন সায়েন্স (জানুয়ারি-ডিসেম্বর, ১৮৩১) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সমাধান সম্পূর্ণ ভাবে ছিল রাধানাথের নিজস্ব আবিষ্কার। ১৮৩২ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি যখন হিন্দু কলেজ ছাড়লেন, সে সময় তাঁকে দেওয়া সার্টিফিকেটে লেখা ছিল— ‘ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে এবং অন্যান্য বিষয়সমূহের মূল সূত্রে তিনি বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন।’ নীচে ডেভিড হেয়ার, হোরেস হেম্যান উইলসন, রামকমল সেন, রাধাকান্ত দেব, রসময় দত্তের মতো বিশিষ্টদের সই ছিল। উল্লেখ করতে হয়, বিজ্ঞান পড়ার সঙ্গে রাধানাথের অন্যান্য গুণের স্ফুরণও এই হিন্দু কলেজেই ঘটেছিল। প্রত্যেক বছর কলেজের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী সভায় অংশগ্রহণ করে সকলের প্রশংসা কুড়িয়ে নিতেন তিনি। ১৮২৮ সালের সভায় ‘ফার্স্ট সিন অব ভেনিস প্রিজ়ার্ভড’ থেকে ‘জ্যাফিয়ের’ অংশটি আবৃত্তি করে শোনালেন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রাধানাথ। দ্য কোয়ার্টারলি ওরিয়েন্টাল ম্যাগাজ়িন-এর প্রতিবেদনে তাঁর প্রশংসা ছাপা হল। ১৮৩১-এর সভায় প্রথম শ্রেণির ছাত্র রাধানাথ পাঠ করলেন স্বরচিত প্রবন্ধ। তার বিষয় ‘The cultivation of the sciences is not more favourable to individual happiness, nor more useful and honourable to a nation, than that of polite literature.’ দ্য এশিয়াটিক জার্নাল অ্যান্ড মান্থলি মিসেলেনি-র ১৮৩১ অগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিতও হল সেই প্রবন্ধ। এভাবেই প্রত্যেক বছর তৎকালীন বঙ্গসমাজের বিশিষ্ট মানুষেরা এই কিশোরের প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকল।

রাধানাথের পরিবারের ছিল বিপুল অর্থকষ্ট। কলেজে পড়াকালীন ১৮ বছর বয়সেই সার্ভে অফিসে চাকরিতে ঢুকলেন রাধানাথ। কলেজ পাশ করলেন পরের বছর। তিনি যোগ দিলেন ‘গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে’-তে, পদের নাম ‘কম্পিউটার’, বেতন মাসে ৩০ টাকা। গৌরবের কথা, এই পদে সেই প্রথম কোনও ভারতীয় সুযোগ পেয়েছিলেন। রাধানাথের বিস্ময়কর প্রতিভা, পড়াশোনার গভীরতা, গবেষণার ব্যাপ্তি, উদ্ভাবনী শক্তির কারণে টাইটলারের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। টাইটলারই তাঁর নাম প্রস্তাব করেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী জর্জ এভারেস্টের কাছে, যাঁর সান্নিধ্য ভবিষ্যতে রাধানাথের কাজকর্মের গতিপ্রকৃতি অনেকাংশে নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

এভারেস্ট ছিলেন ‘সার্ভেয়র জেনারেল অব ইন্ডিয়া’র সুপারিনটেনডেন্ট। রাধানাথের কাজকর্মে তিনি একেবারে মুগ্ধ। বস্তুত, রাধানাথের উপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন তিনি যে, তাঁকে নিজের ডান হাত বলতেন। ১৮৩৭ সালে একবার হিন্দু কলেজের বেশ কিছু প্রথম সারির কৃতী ছাত্র ডেপুটি কালেক্টরের পদে চাকরির জন্য দরখাস্ত করেন। প্রার্থী ছিলেন রাধানাথও। সে কথা জানতে পেরেই প্রমাদ গোনেন এভারেস্ট। তিনি বুঝেছিলেন, রাধানাথ চলে গেলে ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভের অসুবিধে তো হবেই, একইসঙ্গে ভারতীয় প্রতিভারও অপমৃত্যু ঘটবে। তিনি সরকারকে এমন ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন, যাতে এই সব ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনও দেশীয় কর্মচারী বিভাগ পাল্টাতে না পারেন। এই সূত্রে ‘কোর্ট অব ডিরেক্টর্স’-এর অনুমতি নিয়ে কর্তৃপক্ষ সার্কুলার জারি করেন। রাধানাথ রয়ে যান সার্ভেতেই। কোনও কোনও গবেষকের মত, এ সময় তাঁকে চাকরিতে রেখে দিতে বেতনও বাড়ানো হয়েছিল। তবে যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, ফলাফল যে তাঁর ও তাঁর দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক হয়েছিল, এ নিয়ে আজ আর কোনও সন্দেহ নেই।

অবশ্য এর পরেও সার্কুলার অগ্রাহ্য করে রাধানাথ ভিন্ন চাকরির জন্য আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন। সেটা ১৮৫০ সাল, কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট পদ খালি হয়েছিল। রাধানাথ সম্ভবত কিছুটা বেশি বেতনের আশাতেই সেই পদের জন্য আবেদন করেছিলেন। তত দিনে এভারেস্ট অবসর গ্রহণ করেছেন, সার্ভেয়র জেনারেলের পদে এসেছেন অ্যান্ড্রু ওয়া। তিনিও বলতেন, রাধানাথের মতো প্রতিভাধর, পরিশ্রমী গণিতবিদ ও জরিপবিদ পাওয়া দুষ্কর, তিনি বিভাগের সম্পদ। সরকারের কাছে তাঁর বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করলেন ওয়া। সঙ্গে এভারেস্টের মতোই লিখলেন একটি প্রশস্তি চিঠি। সে যাত্রাতেও চাকরি পাল্টানো হল না রাধানাথের। এবং তাঁর সম্বন্ধে ওয়া-র এই অসীম শ্রদ্ধা বজায় ছিল চির দিন। ১৮৫০ সালের ২০ অক্টোবর ট্রিগোনোমেট্রিক্যাল সার্ভে সম্পর্কে ইংল্যান্ডের ‘হাউস অব কমন্স’-এ একটি দীর্ঘ রিপোর্ট জমা দিতে হয়েছিল ওয়া-কে। সহকর্মীদের ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে রাধানাথের কথা আলাদা করে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

আসলে, ভারতে ত্রিকোণমিতির সাহায্যে জরিপের কাজ করার জন্য নিজস্ব যে সব অভিক্ষেপ পদ্ধতির ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিলেন এভারেস্ট, সেগুলিরই কিছু কিছু পরিমার্জন করেছিলেন রাধানাথ। তাই তিনি ছিলেন অপরিহার্য। পরে ১৯৫১ সালে এই সংক্রান্ত যুগান্তকারী কাজ ‘A set of Tables for facilitating the computation of Trigonometrical Survey and the projection of Maps for India’ প্রকাশিত হয়। রাধানাথের তৈরি এই টেবল সার্ভের কাজে খুবই ব্যবহৃত হত। এভারেস্ট উদ্ভাবিত ‘রে ট্রেস মেথড’-ও পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করেছিলেন রাধানাথ।

১৮৪৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর চাকরি থেকে অবসর নেন এভারেস্ট, স্থলাভিষিক্ত হন ওয়া। ১৮৪৫ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত হিমালয় পর্বতের ৭৯টি শৃঙ্গকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে ৩১টি শৃঙ্গের স্থানীয় নামকরণও করে ফেলে সার্ভে বিভাগ। বাকিগুলি তখন সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত হত। তেমনই ছিল ১৫ নম্বর শৃঙ্গ।

সালটা ১৮৫২। পর্যবেক্ষণের কাজ চলছে। রাধানাথ তখন ৬০০ টাকা বেতনে প্রধান কম্পিউটার পদে অধিষ্ঠিত। শোনা যায়, হঠাৎ একদিন ছুটতে ছুটতে এসে ওয়া সাহেবকে তিনি বলেন, “স্যার, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটি আবিষ্কার করে ফেলেছি।” সরকারি ভাবে সেই ঘোষণা হতে আরও বছর চারেক সময় লেগেছিল। বারবার হিসেবের পর ১৮৫৬ সালে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ১৫ নম্বর শৃঙ্গটিই বিশ্বের সর্বোচ্চ। নাম দেওয়া হয় ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। বর্তমানে নেপালে অবস্থিত এই শৃঙ্গটির অবশ্য তখনই স্থানীয় একটি তিব্বতি নাম ছিল, ‘চোমোলুংমা’, অর্থাৎ ‘পৃথিবীর মা’।

১০০ মাইলের মতো দূর থেকে এই শৃঙ্গের উচ্চতার বেশ কয়েকটি পরিমাপ নিয়ে যখন গড় করা হয়, তখন হিসেব আসে ঠিক ২৯,০০০ ফুট। কিন্তু এমন ‘রাউন্ড ফিগার’ সার্ভেয়ারদের ধন্দ জাগায়। তাঁরা এও ভাবেন যে, নিটোল সংখ্যা দেখে জনসাধারণের মনে শৃঙ্গের উচ্চতা সম্পর্কে অবিশ্বাস দানা বাধতে পারে। সে জন্য অতিরিক্ত ২ ফুট যোগ করে শৃঙ্গের উচ্চতা দাঁড়ায় ২৯,০০২ ফুট; ১৯৫৪ পর্যন্ত যা ছিল সরকারি হিসেব। পরে অবশ্য এভারেস্টের উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ২৯,০২৮ ফুট।

কিন্তু বহু দিন যাবৎ এই আবিষ্কারের স্বীকৃতি পাননি রাধানাথ। ১৮৮৪ সালে আর্যদর্শন পত্রিকায় যখন রাধানাথের দিনপঞ্জি ও অন্যান্য তথ্য সাজাচ্ছেন তাঁর জীবনীকার যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন উচ্চতম শিখরটির নাম ও উচ্চতা জ্ঞাত হলেও গণনাকারীর নাম ফাইলবন্দি, অর্থাৎ জনসমক্ষে অপ্রকাশিত। জীবনীকার লিখছেন, “যৌবনের প্রারম্ভে গৃহত্যাগী হইয়া সত্যের অনুসন্ধানে কর্নেল এভারেস্টের সহিত হিমালয় শিখরে শিখরে পর্যটন করিয়াছিলেন।” আর পাদটীকায় জানাচ্ছেন, “উক্ত মহাত্মার নামেই হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘এভারেস্ট শৃঙ্গ’ নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ইনিই রাধানাথের পরম বন্ধু ও শিক্ষক ছিলেন।” রাধানাথের পরবর্তী জীবনীকার শিবনাথ শাস্ত্রী ১৯০৩ সালে রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ বইয়ে ‘নব্যবঙ্গ’-এর নায়ক তথা রামতনুর সুহৃদবর্গের অন্যতম রাধানাথ প্রসঙ্গে অনেক কথা লিখলেও সেখানে শৃঙ্গের কোনও উল্লেখ মেলে না। রাধানাথ প্রধান কম্পিউটারের পদে পৌঁছেছিলেন; সার্ভে সংক্রান্ত গণিতে এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে, কর্নেল থুলিয়ার সার্ভে বিষয়ে যে বিখ্যাত বই প্রকাশ করেন, তার প্রধান গণনাগুলি রাধানাথই লিখে দিয়েছিলেন— এইখানেই রাধানাথের প্রতিভা-বর্ণন সমাপ্ত হয়। ১৯১৯ সালে প্রবাসী পত্রিকায় সত্যভূষণ সেন লিখছেন, উচ্চতম শিখরের নাম কত দূর সঙ্গত হয়েছে তা বিবেচ্য, কেননা এভারেস্টের সঙ্গে এই শৃঙ্গ আবিষ্কারের সরাসরি কোনও যোগাযোগই নেই। এ প্রবন্ধ উল্লেখ করেছিল, “যে ভাগ্যবান পুরুষ প্রকৃতপক্ষে ইহাকে দেখিয়া, উহার উচ্চতা পরিমাপ করিয়া সর্বপ্রথম ইহাকে পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ বলিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন, তাঁহার নামানুসারে ইহার নামকরণ করিলেই যথার্থ ও সর্ববাদিসম্মত হইত।” যদিও গণনাকারীর নামটি অনুসন্ধানের চেষ্টা করেননি প্রাবন্ধিক। কেবল এক বার প্রসঙ্গ উসকে দিয়ে লিখেছিলেন, “জানি না ঘটনাক্রমে একজন এদেশীয় লোকের পক্ষে সে সৌভাগ্য ঘটিয়াছিল কিনা এবং সে জন্যই সে বেচারার নাম একেবারে বিস্মৃতির সাগরে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল কিনা।” শেষ অবধি ১৯২৮ সালে প্রবাসী পত্রিকাতেই প্রকাশিত হল সেই ‘ভাগ্যবান পুরুষ’-এর নাম। এবং ১৯৩২ সালে যোগেশচন্দ্র বাগল বিস্তারিত আলোচনা করে রাধানাথকে বিশ্বের উচ্চতম শৃঙ্গের গণনাকারী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com GTS Minar George Everest Radhanath Sikdar)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours