পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

একটা পরিচিত প্রবাদ আছে, “রাজা বড় দাতা, দান করেন কাকে? রাণীকে।“ এই রাজার মতই দাতা আমাদের দেশের রাজা এবং তার সরকার। তাদের প্রজাদের জন্য উদ্বেগ, চিন্তা, সর্বোপরি বিভিন্ন জনমুখী পদক্ষেপের উদাহরণে বেসামাল সাধারণ মানুষ। ঝুরি ঝুরি উদাহরণ আছে কেন্দ্রের প্রজাপালনের নামে লুঠপাটের। সাম্প্রতিক বিষয় দিয়েই শুরু করা যাক। সেদিন এটিএমে টাকা তুলতে গিয়ে কানে এল একটা উদ্বিগ্ন কণ্ঠ। এটিএমের প্রহরী চেয়ারে বসে আছেন, তার কানে ফোন, সেখান থেকেই ওই আওয়াজ। শুনলাম, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে কি হবে আমাদের, এই দুশ্চিন্তা রাতের ঘুম কেড়েছে তার। সেটাই ফোনের ওপারে থাকা মানুষটিকে জানাচ্ছেন তিনি। শুধু তিনিই নন, দেখলাম আশেপাশে থাকা প্রায় সকলেই কমবেশি ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তায়। আমার ১২ বছরের ছেলের মুখেও তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কার কালো মেঘ। আমাদের মত মানুষের যদি এমন উদ্বেগ হয় তাহলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনুমেয় যাদের আত্মীয় পরিজন সন্তান ইউক্রেনে আছেন তারা কেমন মানসিক দুশ্চিন্তায় দিন গুনছেন। আমার পরিচিত এক দাদার ছেলেও সে দেশে পড়াশোনা করে। সেই দাদার কাছেই শুনলাম আমাদের এখানে যুদ্ধ নিয়ে যতটা রটনা, দুশ্চিন্তা, আশঙ্কা, তার ছিটেফোঁটাও নাকি ইউক্রেনের বাতাসে নেই। তবুও সংবাদ মাধ্যমে উত্তেজনা দেখে সকলেই চাইছেন ফিরে আসুক নিজের লোকেরা। 

এখানেই আমাদের দেশের সরকারের খেলা শুরু। আমেরিকা জানিয়ে দিয়েছে তারা ইউক্রেনে তাদের নাগরিকদের উদ্ধারে সক্রিয় হবে না। সকলেই নিজের দায়িত্বে ফিরে আসুক। কিন্তু আমাদের দেশ তাদের নাগরিকদের উদ্ধারে যথেষ্ট সক্রিয়। শুনেই কেমন ভাল লাগছে বলুন, সাধে কি বলি, মেরা ভারত মহান। কিন্তু এই মহান উদ্যোগের পিছনে আছে অন্য খেলা। সাধারণ ভাবে ইউক্রেন থেকে এদেশে যাতায়াত করতে  হাজার পঁয়ত্রিশ টাকা খরচ হয়। তবে এখন এই যুদ্ধ যুদ্ধ আবহে সেই খরচটা বেড়ে গিয়েছে এক লাফে অনেকটাই। তাহলেও প্রায় এশিয়ার অন্য দেশের ফ্লাইট ধরে আসতে পচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকার মত খরচ হচ্ছে এই মুহূর্তে। আমার দেশ ভারত, তার নাগরিকদের উদ্ধার করতে যে বিমান পাঠিয়েছে তার একপিঠের ভাড়া পড়ছে ষাট থেকে পঁয়ষট্টি হাজার টাকা। ভাবুন, উদ্ধার করতে আসা বিমান ভাড়া নিচ্ছে সাধারণ ভাড়ার দ্বিগুণ। এটা কি উদ্ধার? নাকি উদ্ধারের নামে লুঠপাট? সে হিসেব আপনিই করুন। অতি দেশভক্তরা বলতেই পারেন যে যাওয়ার সময় খালি বিমান নিয়ে যাওয়ার খরচ জুড়ে এই ভাড়া। কিন্তু সে দেশে থাকা অসহায় ভারতীয় নাগরিকদের জন্য এই ছাড় কি সরকার দিতে পারত না? রাম মন্দির বা নতুন সংসদ ভবন নির্মানে দুদিন দেরিই না হয় হত। এত টাকার বিনিময়ে “রেসকিউ অপারেশন” শব্দটি এখানে ব্যবহার করাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। 

আমি বিমানে ছাড়ের কথা বলছি কেন? আমাদের রেল তো করোনার পরে সব ধরনের ছাড়ই তুলে দিয়েছে। দেশের প্রবীণ নাগরিকেরা রেলের টিকিটে অনেকটাই ছাড় পেতেন। তাতে তাদের যাতায়াতে সুবিধাও হত। আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রবীণ নাগরিকের রোজগারের উৎস তাদের সারাজীবনের পরিশ্রমের বিনিময়ে জমানো পুঁজি। সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই যে পুঁজি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম। সেই ক্ষেত্রেও সুদের হার কমতে কমতে এখন কি অবস্থায় দাঁড়িয়েছে তা নিশ্চয় এখানে বলার প্রয়োজন রাখে না। এমতাবস্থায় রেলযাত্রায় এই ছাড়ে কিছুটা স্বস্তি পেতেন আমাদের মা মাসি কাকা পিশেমশায়রা। কিন্তু এই সরকারের বদান্যতায় সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।  

কেন্দ্রের প্রজাপালনের আর একটা বিরাট পদক্ষেপ হল ট্রাই নামে এক হার্মাদের প্রবর্তন। আমাদের দেশে টেলিকম এবং কেবল টিভির ব্যয় বা বিভিন্ন নীতি নির্ধারণ করে এই ট্রাই নামক কেন্দ্রীয় সংস্থা। তাদের সুচিন্তিত সুপারিশে ৬০ থেকে ৮০ টাকায় মাস প্রতি কেবল টিভির খরচ এখন কমপক্ষে আড়াইশো টাকা। ভাবুন কি দরদ আমাদের প্রতি। মোবাইল ফোনে আগে ছমাস রিচার্জ করে তার পরে কম পক্ষে দশ টাকা ভরেও কথা বলা যেত। ট্রাই জনগনের সুবিধা করতে গিয়ে ছমাসের রিচার্জকে ২৮ দিনে নামিয়ে আনল। দশ টাকায় কথা বলা তো এখন ইতিহাস। কারা এই সংস্থায় আছেন আমার জানা নেই, কিন্তু ছোট বেলায় স্বাভাবিক অংকের নিয়মে ৩০ দিনে মাসের হিসেবটাও তাদের অজানা এটা দেখে বেশ অবাকই লাগে। কিন্তু তারা অঙ্ক পারেন না বা জানেন না এটাই বা বলি কি করে? ভাল করে দেখলেই বোঝা যায়, ট্রাই রীতিমত অঙ্ক কষে টেলিকম সংস্থাগুলিকে সুবিধা করে দিতে এই কম্ম করেছে। ২৮ দিনের হিসেব হলে মাসের হিসেবে তা আরও একমাস বেশি হয়ে যায়। অর্থাৎ আপনি এখন ১৩ মাসের টাকা দিয়ে ১২ মাসের পরিষেবা পান, সেটাও আগের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি মূল্যে। বুঝতেই পারছেন আপনার আমার ভাল করবার জন্য কেন্দ্রের সরকার কতটা উদ্বিগ্ন? 

আর মাত্র কটা দিন, উত্তর প্রদেশে ভোটটা মেটার অপেক্ষা। তার পরেই তো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল বলে। সেই দাম কোথায় দাঁড়াবে তা এখন ভাবলেই সাধারণ মানুষের ঘুম উড়বে। চল্লিশ টাকা বাড়িয়ে সেখান থেকে পাঁচ বা দশ টাকা কমিয়ে প্রজাদের প্রতি ভালবাসা এবং দায়িত্বের এক মহৎ দৃষ্টান্ত  স্থাপন করেছিল কেন্দ্র। এবার? এখন শুধু আতঙ্ক একটাই, কেন্দ্র আমাদের উপকারের কথা ভেবে কি, কি সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। শেষবেলায় আর একটি প্রবাদের কথা মনে পড়ছে, “ভিক্ষে চাইনে, তোর কুকুর ঠেকা।“

(www.theoffnews.com - Government services)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours