তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

অবশেষে চলেই গেলেন কিংবদন্তী শিল্পী লতা মঙ্গেশকর।

লতা মঙ্গেশকর শুধু কিংবদন্তি শিল্পী নয়, উনি তাঁরও অনেক ওপরে। দুটি পা থাকতো সবসময়ে মাটিতে, বিন্দু মাত্র কোনো লোক দেখানো ভঙ্গি নয় পুরো দেহ মন সংগীতের 'সা' তে নিবদ্ধ। শুধু গান দিয়ে এই জায়গায় পৌঁছানো যায় না, উনার ব্যাক্তিত্ব, হাবভাব এমনি কি হাসি ও সংগীতের জন্য। লতা মঙ্গেশকর এর বাড়িতে যারা গেছেন সব্বারী মুখে একটাই কথা এত অনাড়ম্বর জীবন এত নামী শিল্পীর।

এটাই শেখবার মতো। তিনি মাটি ছোঁয়া মানুষ ছিলেন তাই অনাড়ম্বর জীবন। মনে পড়ছে আশির দশকে যখন গায়ক নচিকেতা নিয়মিত আসতো আমার পাইকপাড়ার বাড়িতে, খালি সংগীত পরিচালক মদনমোহন এর সুরে লতা মঙ্গেশকর এর গানের কথাই বলতো। কারণ মদনমোহনজির আমরা ভক্ত ছিলাম। আজ সব স্মৃতি গুলো উঁকি মারছে। এই লতা মঙ্গেশকর ফিল্মের গান খুব কম শুনতেন, তাঁর কানটা ছিল মূলত শাস্ত্রীয় সংগীতের দিকে প্রধানতঃ। বাবা দিননাথ মঙ্গেশকর এর নাটকের গান, যথেষ্ট শক্ত, খুব ছোট বয়সেই সেগুলি রপ্ত করেছিলেন, ফলে সুরে তাঁর ছিল অনায়াস অগাধ যাতায়াত। একান্ত সাক্ষাৎকারে লতা মঙ্গেশকর বলেছিলেন নওশাদ সাহেবের জন্য গান গাওয়া আর শঙ্কর জয়কিশানের জন্য গাওয়া একই ব্যাপার নয়; প্রতিটি গান এসেছে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে। আমি যখন গান গাইতাম লিপস্টিক লেপ্টে গেল কিনা ভাবতাম না, কারণ আমার কোনো লিপস্টিক ছিল না; কিংবা আমাকে কেমন দেখায় তাও ভাবিনি, আয়না দেখার সময়ও ছিল না। আমি টাকার কথাও ভাবিনি, যদিও সংসার চালাতে হয় বলে টাকার খোঁজ করেছি।"

একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি আজকের বেশির ভাগ শিল্পীরা গান করার সময়ে নিজের বডি ল্যাংগুয়েজ ঠিক করতে ব্যস্ত, কি করে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়? কিন্তু লতা মঙ্গেশকর  এই সব নিয়ে কোনোদিনই ভাবেননি গান করার সময়ে, শুধু গানের দিকেই ছিল নজর। কথা বলতে উনার ভালোই লাগত না,নো শো-অফ, শিশুর মত সরলতা, অথচ সুরে অশেষ গভীরতা, তাই তিনি সরস্বতী। এই গুলো হয়তো কপি করা যায় না, তাই মানুষ গানটাকে কপি করতো, কিন্তু শেষ কালে ওই শিল্পীর গানটা সংগীত হয়ে উঠত না। লতা মঙ্গেশকর ভারতীয় সংস্কৃতির কেন্দ্রে থাকা একজন সাধারণ নারী, কিন্তু কাজ করে গেছেন সব অসাধারণ। যখন প্রেমের গান গাইছেন তখন শুধু গান মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে উনি প্রেমের গভীর শাস্ত্র পাঠ করছেন। সংগীত পরিচালক নওশাদ জি বহু সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এখন কেটে কেটে রেকর্ডিং হয়, আজ ধরুন স্থায়ীটা রেকর্ডিং হলো, কাল হল অন্তরাটা। কিন্তু লতা যে সব সুপারহিট গান গেয়েছেন সত্তর দশকের আগে সবই এক টেকে ফাইনাল রেকর্ডিং, একটাও ভুল নেই, কিন্তু এখন  এত রেকর্ডিং এর সুবিধা তবু ভুলে ভর্তি, এইসব বলছেন সংগীত পরিচালক নওশাদ।

আগে লাইভ রেকডিং হত, একটা ভুল ধরা পড়লে আবার পুরোটা রেকর্ডিং করতে হতো, এখন তা হয় না, কারণ পরে ডাব করা যায়। এই লতা মঙ্গেশকর মনে এবং ঠোঁটে একদম এক ছিলেন, একটি সত্তা।জীবন যাপন ও সংগীত দুটোই' সা'তে বাঁধা, ওই কারণেই উনাকে সরস্বতী বলা হয়। উনি সব সময়ে মনে করতেন, না ঠিক গানটা করতে পাচ্ছি না, শিশুর মত নার্ভাস ছিলেন, তাই বোধ হয় তাঁর গানে ছিল এত পারফেকসন।

৮ বছর বয়স থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত দিনের বেশির ভাগ সময়ে পাল্টা রেওয়াজ করতেন। ওটাই বাবার নির্দেশ ছিল। কিন্তু খালি রেওয়াজ করে এই স্তরে পৌছানো সম্ভব নয়, আশীর্বাদের প্রয়োজন যা তিনি পেয়েছিলেন সব্বার কাছ থেকে। বড়ে গুলাম আলী থেকে বিশমিল্লা খাঁ প্রায় সবাই শুনে একটাই কথা বলতেন, শালী কভি বেসুরো নেহি হতি, ইয়ে বাত আচ্ছা নেহি।

শৈশবে বাড়িতে থাকাকালীন কে এল সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না তার। বাবা চাইতেন ও শুধু ধ্রপদী গান নিয়েই থাকুক। জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হলো, তখন তার বয়স আঠারো। কিন্তু রেডিওটা কেনার পর নব ঘুরাতেই প্রথম যে খবরটি তাকে শুনতে হয় তা হচ্ছে, কে. এল. সায়গল আর বেঁচে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওটা ফেরত দিয়ে দেন তিনি। এই ছিল তাঁর শ্রদ্ধা।

১৯২৯ সালে ইন্দোরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন লতা। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে লতা মঙ্গেশকর ছিলেন সবচেয়ে বড়। তাঁর বাবা পণ্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকর মরাঠি ও কোঙ্কিণী সংগীত শিল্পী ছিলেন, পাশাপাশি অভিনয়ও করতেন। ছোটবেলায় বাড়িতে কে এল সায়গল ছাড়া আর কোনও ছবির গান গাওয়ার অনুমতি ছিল না। গায়িকা নয় মাত্র ১৩ বছর বয়সে অভিনেত্রী হিসাবে কাজ করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সেইসময় বাবাকে হারান গায়িকা, পাঁচ ভাই-বোনের কথা ভেবে ওই বয়সেই হাল ধরেন সংসারের। তিনি শুরু করেছিলেন জীবন অভিনেত্রী হবেন বলে, অনেক ছবিতে অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু ব্যর্থ সব প্রচেষ্টা, হয়তো নির্ধারিত ছিল উনি সুর সম্রাজ্ঞী হবেন।

১৯৪২ সালে একটি মারাঠি ছবির সৌজন্যে প্রথম গান রেকর্ড করেন তিনি। পরের বছর মরাঠি ছবি ‘গাজাভাউ’-এর জন্য ‘মাতা এক সুপুত কি দুনিয়া বদল দে তু’ গানটি রেকর্ড করেন লতা মঙ্গেশকর, এটি ছিল তাঁর প্রথম হিন্দি গান। এরপর লতার মুম্বইয়ে আসা এবং ওস্তাদ আমান আলি খানের কাছে ধ্রুপদী গানের তালিম পর্ব শুরু। এরপর ধীরে ধীরে বলিউডে পায়ের নীচের মাটি শক্ত করতে শুরু করেন লতা মঙ্গেশকর। যদিও চ্যালেঞ্জের মুখে পদে পদে পড়েছিলেন লতা। প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায় ‘শহীদ’ ছবিতে লতাকে দিয়ে গান গাওয়াতে রাজি হননি, সংগীত পরিচালক গুলাম হায়দারকে তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েটার গলাটা বড্ড সরু মিউজিক ডিরেক্টর গুলাম হায়দার পালটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেছিলেন, আগামীদিনে এই মেয়েকে দিয়ে গান গাওয়াতে পায়ে ধরবে গোটা বলিউড। এরপর তাঁর হাত ধরেই বলিউডে প্রথম বড় ব্রেক পান লতা। মজবুর (১৯৪৮) ছবির ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহিন কা না ছোড়া’ গানটি রেকর্ড করেন লতা। শিল্পীর কথায়, ‘গুলাম হায়দার আমার গডফাদার’। শুরুর দিকে লতার গায়েকিতে নূর জাহানের ছাপ খুঁজে পেয়েছেন অনেকে, তবে দ্রুত তা কাটিয়ে উঠে নিজস্ব স্টাইল তৈরি করেছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী।

লতা মঙ্গেশকর তাঁর সাত দশক দীর্ঘ কেরিয়ারে ত্রিশ হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেছেন এবং গান গেয়েছেন ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায়। অনিল বিশ্বাস, এসডি বর্মন, সলিল চৌধুরীর মতো সংগীত পরিচালকদের পছন্দের গায়িকা ছিলেন লতা, অনেকেই হয়ত জানেন না আরডি বর্মনের কেরিয়ারের প্রথম ও শেষ গানটি লতার কন্ঠে রেকর্ড করা। নতুন শতাব্দীতে গানের জগত থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলেন লতা, তবুও ‘বীর জারা’, ‘রং দে বসান্তি’র মতো ছবির অ্যালবামের শোভা বাড়িয়েছে তাঁর সুমধুর কন্ঠ। ২০১৯ সালে ভারতীয় আর্মিকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দেন লতা, রেকর্ড করেন ‘তেরি মিট্টি কি সওগন্ধ’, এটিই লতা মঙ্গেশকরের রেকর্ড করা শেষ গান।

এই লতা মঙ্গেশকর কলকাতার মহান শিল্পী প্রতিমা বন্দোপাধ্যায় এর খুব ভক্ত ছিলেন, কলকাতার সেকালের বহু শিল্পীর সাথে তাঁর ছিল নিবিড় যোগাযোগ। তিনি ফোন করে সন্ধ্যা মুখার্জীর সম্বন্ধেও খোঁজ নিয়েছেন তিন মাস আগে। বাংলার সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল এবং তাঁর মূলে ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যাঁর জন্যই আমরা পেয়েছি সব অবিস্মরণীয় বাংলা গান।

লতা মঙ্গেশকরের বিখ্যাত গানের তালিকা অগুনতি, ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগো’, ‘লাগ জা গলে, ‘চলতে চলতে’, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’- এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়। আজ সংগীতের জীবন্ত সরস্বতীর মৃত্যু হল। ভারতীয় সংগীতের দুনিয়ায় লতা মঙ্গেশকরের অবদান ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮৯ সালে, তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান। ২০০১ সালে দেশের সর্বোচ্চ অসমারিক নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করা হয়েছিল লতা মঙ্গেশকরকে। ২০০৭ সালে ফ্রান্স তাদের দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরস্কার (অফিসার অফ দি লেজিয়ান অফ অনার) দিয়ে সম্মানিত করে লতা মঙ্গেশকরকে। আক্ষরিক অর্থেই তিনি সুরের সরস্বতী, আর ভগবান তো অবিনশ্বর, তাই সঙ্গীত প্রেমীদের হৃদয়ে এভাবেই চির ভাস্বর হয়ে থাকবেন তিনি। লতা মঙ্গেশকর হওয়া যায় না কিন্তু এক এক জন হয়ে উঠেন সুরের সরস্বতী দীর্ঘ সাধনা ও আশীর্বাদ এর জন্যই তিনিই লতা মঙ্গেশকর 'একম অদ্বিতীয়ম'।

শেষ বিচারে বলি লতা মঙ্গেশকর নামটা হলোএ কটি সাধারন মেয়ের অসাধারণ হয়ে উঠার গল্প।

(www.theoffnews.com - dead Lata Mangeshkar)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours