তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

অনেকেই একই প্রশ্ন করেন খালি ভাষা দিবসে, বাংলা ভাষা কি বিলুপ্তির পথে?

ইউনেস্কোর মতে ১০,০০০ এর কম মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষার বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই হিসেবে ভারতে এখনও পর্যন্ত পাওয়া ৭৮০ ভাষার মধ্যে বিপদ সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৬০০টির। এবং জানা যাচ্ছে গত ৬০ বছরে প্রায় ২৫০ ভারতীয় ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর যে ভাষার কোনো বক্তা নেই কিংবা লিখিত রূপের চলন নেই সেই ভাষা হলো লুপ্ত ভাষা।

কিন্তু সমকালে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে, আমাদের বাংলা ভাষা কি সঙ্কটের মুখে? বাংলা কি এক দিন লুপ্তপ্রায় ভাষায় পরিণত হবে? এই সকল প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া যায়— না, অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে সেই রকম আশঙ্কা এখনও তৈরি হয়নি। একটা পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। মাতৃভাষাভাষী সংখ্যার নিরিখে বিশ্বে বাংলার স্থান পঞ্চম কি ষষ্ঠ। প্রথম চিনা ভাষা (প্রায় ১২৮ কোটি ৪০ লক্ষ); দ্বিতীয় স্থানে আছে স্পেনীয় ভাষা (৪৩ কোটি ৭০ লক্ষ); ইংরাজি তৃতীয় স্থানে (৩৭ কোটি ২০লক্ষ); আরবি আছে চতুর্থ স্থানে (২৯ কোটি ৫০ লক্ষ)। পঞ্চম স্থানটি নিয়ে বাংলার লড়াই হিন্দির সঙ্গে। হিন্দি যাদের মাতৃভাষা, তাদের সংখ্যা ২৬ কোটি; কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে বাংলাভাষীর সংখ্যা ২৬ কোটি ৫০ লক্ষ।

তবে ২০০১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে বেড়েছে হিন্দিভাষী লোকের সংখ্যা। বেড়েছে বাংলাভাষীর সংখ্যাও। তুলনায় হিন্দিভাষী মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই। ৪১.০৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৩.৬৩ শতাংশ। আর বাংলাভাষীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮.১১ শতাংশ থেকে ৮.৩ শতাংশ। এই তালিকাতেই তেলেগুকে সরিয়ে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে মারাঠি ভাষা। বাংলার পরেই স্থান মারাঠির।

দেশের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত ২২টি ভাষার মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। সেই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে সবার শেষ স্থান পেয়েছে সংস্কৃত। এই ভাষায় কথা বলেন ২৪ হাজার ৮২১ জন নাগরিক। এমনকী বোড়ো, মণিপুরী, কলকানি, ডোগরি ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা সংস্কৃতের থেকেও বেশি।

তবে সংস্কৃত ভাষার কর্তৃত্ব থেকে যিনি বাংলা ভাষাকে মুক্ত করলেন তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। যাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন অতন্ত্য শ্রদ্ধার সাথে যে বিদ্যাসাগর ছিলেন বাংলার প্রথম গদ্য শিল্পী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা, ইংরেজের কর্মোদ্যম ও বাঙালি মায়ের হৃদয়বৃত্তি। ইতিহাস বলছে তিনি নাকি পালকিতে যেতে যেতে স্কুল পরিদর্শনের সময়ে বর্ন পরিচয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। ভাবা যায় কি অসামান্য প্রতিভা আর মাতৃ ভাষার প্রতি ভক্তি। রবীন্দ্রনাথেরও অবদান সীমাহীন। বাঙালির সংস্কৃতি আজ বলতে লজ্জা নেই তলানিতে এসে ঠেকেছে। এখন প্রশ্ন হলো একটাই, ওইরকম তেজস্বী বাঙালির আবার কি পুনর্জীবন সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন এক কথায় উনার সম্বন্ধে অক্ষয় মনুষত্ব ও অজেয় পৌরুষ।

আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। আজ হিন্দি হিন্দু সংস্কৃতির যুগের সন্ধিক্ষণে এসে মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ আর বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রম বিকাশের কথা। আজ আবার আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসও। রবীন্দ্রনাথের মননে প্রোথিত বিষয়াবলীর মধ্যে অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ছিল বাংলাভাষা৷ মাতৃভাষা বাংলার সপক্ষে ছিল তাঁর আজন্ম সংগ্রাম৷ তাঁর বহু প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে তার পরিচয় পাওয়া যায়৷ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মাতৃভাষা বাংলার প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন৷ মাত্র বাইশ বছর বয়সে ‘ভারতী' পত্রিকায় তিনি লিখেছেন, ‘‘ইংরাজিতে যাহা শিখিয়াছ তাহা বাংলায় প্রকাশ কর, বাংলা সাহিত্য উন্নতি লাভ করুক ও অবশেষে বাংলা বিদ্যালয়ে দেশ ছাইয়া সেই সমুদয় শিক্ষা বাংলায় ব্যাপ্ত হইয়া পড়ুক৷''

মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে বাংলাদেশে সকল প্রকার শিক্ষার ব্যবস্থা করা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ চিরজীবন উদ্বিগ্ন ছিলেন৷ বঙ্গাব্দ তেরোশো'র আষাঢ় সংখ্যায় তিনি শিক্ষায় মাতৃভাষার স্থান সম্বন্ধে যা বলেছিলেন তা এখনো উদ্ধৃতিযোগ্য – ‘‘কোন শিক্ষাকে স্থায়ী করিতে চাইলে, গভীর করিতে হইলে, ব্যাপক করিতে হইলে তাহাকে চিরপরিচিত মাতৃভাষায় বিগলিত করিয়া দিতে হয়৷''

বাংলাভাষার রূপ ও প্রকৃতি, অবয়ব এবং অন্তরশক্তি অবলোকন ও অনুসন্ধানে ছিল তাঁর নিরন্তর আগ্রহ৷ শুধু ভাব প্রকাশের বাহন নয় বাংলা ভাষাকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন চর্চার বাহন হিসেবে পেতে হলে, তিনি বলেছেন, ‘‘বাংলা ভাষাকে চিনতে হবে ভালো করে; কোথায় তার শক্তি, কোথায় তার দুর্বলতা, দুইই আমাদের জানা চাই৷'' তিনি চেয়েছিলেন বাংলাভাষা যেন সবল ও সতেজ হয়৷

বঙ্গাব্দ তেরোশো এগারোতে তিনি 'ভাষার ইঙ্গিত' প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘‘বৈয়াকরণের যে সকল গুণ ও বিদ্যা থাকা উচিত তাহা আমার নাই, শিশুকাল হইতে স্বভাবত আমি ব্যাকরণভীরু; কিন্তু বাংলা ভাষাকে তাহার সকল প্রকার মুর্তিতেই আমি হৃদয়ের সহিত শ্রদ্ধা করি, এই জন্য তাহার সহিত তন্নতন্ন করিয়া পরিচয় সাধনে আমি ক্লান্তিবোধ করি না৷'' রবীন্দ্রনাথের এই শ্রদ্ধার প্রতিরূপ হলো তাঁর দুই অসামান্য গ্রন্থ ‘বাংলাভাষা-পরিচয়' ও ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব'৷

মাতৃভাষা বাংলার সপক্ষে ছিল তাঁর আজন্ম সংগ্রাম৷ তাঁর বহু প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে তার পরিচয় পাওয়া যায়৷ অধ্যাপক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৩২-এ৷ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা ছিল ‘‘রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের হিতার্থে বেশ কিছু ভাষণ দেবেন এবং বাংলা ভাষার অধ্যয়ন ও গবেষণা কর্মের উন্নতি সাধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা করিবেন৷''

গবেষণা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান বাংলা বানানে যে বিশৃঙ্খলা চলছে তার মধ্যে একটা শৃঙ্খলা স্থাপন করা আবশ্যক এবং এ কাজের ভার বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষেই গ্রহণ করা উচিত৷'' একই সঙ্গে তিনি বাংলায় বৈজ্ঞানিক শব্দের পরিভাষা প্রণয়ন ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তার কথাও উত্থাপন করেন৷ রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাব অনুসারে গঠিত হয় বহুল পরিচিত ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানান-সংস্কার-সমিতি৷' সংস্কার সমিতির প্রথম পুস্তিকা প্রকাশিত হয় ১৯৩৬-এর মে মাসে ‘বাংলা বানানের নিয়ম' শিরোনামে৷

বাংলা ভাষার যে নিজস্ব ব্যাকরণ নেই সে কথাও প্রথম মনে করিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ৷ বাংলা ব্যাকরণ যে সংস্কৃত ব্যাকরণের দ্বারা শাসিত হতে পারে না সেই কথা সামনে রেখে তিনি তাঁর ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব' ও ‘বাংলাভাষা-পরিচয়' গ্রন্থে প্রকৃত বাংলা ব্যকরণ রচনার দিক নির্দেশনা দিয়েছেন৷ মাতৃভাষার প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা এবং শিক্ষার বাহন হিসেবে মাতৃভাষা বাংলা প্রচলনের প্রবল দায়িত্ববোধ প্রসঙ্গে এসে পড়ে তাঁর পরিভাষা-ভাবনার কথা৷ প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর, অর্থাৎ জীবনের এক বিরাট সময় ধরে রবীন্দ্রনাথ বাংলা পরিভাষা নিয়ে কাজ করেছেন, মাথা ঘামিয়েছেন, নানাজনকে নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন৷

ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে দেখা যায় প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে প্রাচীন ব্রাহ্মী লিপির প্রচলন ছিল। এরও বহু পরে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দের প্রায় কাছাকাছি সময়ে সম্রাট অশোকের লিপি সৃষ্টি হয়েছিল। তারও পর কুণাল লিপি, গুপ্ত আমলে গুপ্ত লিপি, মৌর্য লিপি, আর্যলিপি, কুটিল লিপি ইত্যাদির সৃষ্টি হয়েছিল। এক হাজার খ্রিস্টাব্দের সময় নাগাদ প্রাচীন বাংলা লিপির সৃষ্টি হয়েছিল। অনেক পরিবর্তনের পথ বেয়ে বাংলা লিপিরও সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষার নিজস্ব বর্ণমালাও আছে। যেখানে বহু ভাষারই নিজস্ব কোনও বর্ণমালা নেই, তারা অন্য ভাষার বর্ণমালা ব্যবহার করে লেখে সেখানে বাংলা ভাষার নিজের বর্ণমালা থাকা বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে অবশ্যই বিরাট শ্লাঘার বিষয়।

সমগ্র বিশ্বে এখন প্রায় পাঁচ হাজার ভাষায় মানুষ কথা বলেন। যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশই হল আফ্রিকার ব্যবহৃত ভাষা। উচ্চারণ, শব্দের ব্যবহার ও বাক্য নির্মাণের দিক থেকে যা একটা অন্যটার সঙ্গে সম্পর্কিত। ভাষাবিদরা এই ভাষাগুলিকে মোটামুটি কুড়িটির মতো পরিবারে ভাগ করেছেন। তবে একটা লক্ষণীয় মজার ব্যাপার হল আফ্রিকারই সিয়েরা লিওন দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হল বাংলা। 

আমরা বিশ্বাস করি নিখাদ বাঙালিয়ানায়। আমরা নববর্ষ-এর দিনে আটপৌরে স্টাইলে দামি ঢাকাই জামদানি পড়ি। কপালে বড় টিপ, একটু শাখা সিঁদুর। বাড়িতে বাংলা বর্ষপূর্তির দিনে জলখাবারে ফুলকো লুচি আর কালো জিরে কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে সাদা আলুর চচ্চরি আর বেগুন ভাজা। দুপুরে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নামী রেস্তোরাঁয় বাঙালিয়ানা ভোজ। মাটি ও কলাপাতার বাসনে মোচার ঘণ্ট, পোস্ত বড়া, তেল কই, ধোকার ডালনা, ভেটকি পাতুরি, পার্শে ঝাল, মিষ্টি দই, রাবড়ি। যদিও কলকাতায় থাকলে এই আদিখ্যেতা গুলো একটু বেশিই হয়। পঁচিশে বৈশাখ বাইশে শ্রাবণে শুধুই রবীন্দ্রনাথ।

আমরা এমন সব কেতা দেখাই যে অবাঙালি পেলেই নিজের মাতৃভাষা বেমালুম ভুলে বাংলা উচ্চারণে প্রায় নির্ভুল হিন্দিতে কথা বলি। এখন তো বাংলা প্রায় ভুলতে শিখেছি। আজকাল দেখছি সবাই হিন্দিতে কথা বলার চেষ্টা করছে। খোদ বিশ্বভারতীর উপাচার্য হিন্দিতে বক্তৃতা দিচ্ছেন।আমার অনেক চেনা পরিচিত বন্ধু ফেসবুকে, ফোনে হিন্দিতে কথা বলার চেষ্টা করছে। একটা অদ্ভুত হিন্দি হিন্দু সংস্কৃতি বাংলাকে গ্রাস করতে চলেছে। হিন্দি ভাষার ওপর কোনো আপত্তি নেই। যে কোনো রাজ্যের ভাষাকে অক্ষুন্ন রেখে যদি হিন্দি চলে কি আপত্তি আছে। বাংলা বিজ্ঞাপনে অ-বাংলা শব্দগুচ্ছের বিরুদ্ধে আমাদের তেমন ক্ষোভ নেই।

অথচ ‘উনিশ মে’ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ভাষাদিবস নিয়ে লিখতে বসি। ভারী যত্নে, পরম আবেগে কবি একদা লিখেছিলেন, “মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা...”। আমাদের এই বাংলা ভাষা এমনই এক ঐতিহ্য আছে যা কিনা বৃহৎ এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে আগলে রেখেছে নিজস্ব বনেদিয়ানায়। বস্তুত ভাষাকে মাধ্যম করেই এক একটি অঞ্চল বিশেষে এক একটি জনজাতির সৃষ্টি হয়। নিজেদের কথিত মাতৃভাষার গর্বেই একটা অঞ্চলের অধিবাসী নিজেদের মধ্যে একাত্মতা অনুভব করেন। এ ভাবেই ক্রমান্বয়ে একই অঞ্চলবাসী, যারা একই ভাষা ব্যবহার করেন, তারা নিজেদের এক জাতি এক প্রাণ বলে বিবেচনা করেন। মাতৃভাষাই সমস্ত গোষ্ঠীকে এক জাতিতে একত্রীভূত করে।

বাংলা ভাষার ব্যবহার এখন পৃথিবীর এক বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দ্বারা ব্যবহৃত ভাষা। পৃথিবীর জনসংখ্যার নিরিখে প্রায় ২৩ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। বিশ্বে বহুল প্রচারিত ভাষাগুলির মধ্যে সংখ্যানুসারে বাংলা ভাষার স্থান চতুর্থ থেকে সপ্তমের মধ্যে। ইংরাজি, চৈনিক, স্প্যানিশ ইত্যাদির পরই বাংলা ভাষার স্থান। দক্ষিণ-এশিয়ার পূর্বপ্রান্তে বাংলা ভাষাটি মূলত ইন্দো-আর্য ভাষা। সংস্কৃত পালি ও প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে।

উৎকর্ষ গত  দিক দিয়ে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, গান, গদ্যে বাংলা ভাষার বনেদিয়ানা অন্য ভাষাকে ম্লান করে দেয়। খ্রিস্টায় প্রথম সহস্রাব্দের শেষ দিকে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির অপভ্রংশ থেকে যে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলির উদ্ভব হয়, তার মধ্যে বাংলা একটি। বাংলা ভাষার ইতিহাস তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ১) চর্যাপদ (৯০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ), ২) মধ্য বাংলা (১৪০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ) এর মধ্যে চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ধরা হয়। ৩) আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)। চর্যাপদ আবিষ্কার বা রচনার কাল হিসেব করলে এর প্রমাণ মেলে। বাংলা ভাষার গদ্য অবশ্য অনেকটা পরে, লিখিত ভাষার হিসেব অনুযায়ী।

তবে ভাষারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা ভাষার কথ্য রূপের জেলাভিত্তিক কিছু কিছু প্রভেদ থাকলেও বাংলা ভাষার লিখিত রূপ বিশেষ করে সাহিত্যে, ইতিহাস, সংবাদপত্রে, গান ইত্যাদিতে এই ভাষা ব্যবহারকারীকে বাঙালি বলে পরিচয় দেয়। মাতৃভাষার জন্য একটা অন্য ধরনের আস্বাদ, শ্লাঘা, অনুভবের ভূমি তৈরি হয় বাঙালি মননে। আমাদের নিজস্ব এই ভাষার একটা বুদ্ধিপ্রদ আভিজাত্য আছে। আমরা শুধু বাংলা সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী এই গর্ববোধ আমাদের দুই বাংলারই।

আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন হিসাবে ২১ ফেব্রুয়ারি একটি গৌরবজ্জ্বল দিন। দিনটিকে বাংলাদেশি নাগরিকের কাছে ‘শহিদ দিবস’ বা ‘মাতৃভাষা দিবস’ হিসাবেও পালিত হতে দেখা যায়। স্বাধীনোত্তর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশি সংঘর্ষে আব্দুস সামাদ, রফিক উদ্দিন আহমেদ, আবুল বরকত আব্দুল জব্বর এবং অহিউল্লাহ নামে এক বালক নিহত হন। সে দিনের বাংলা ভাষার জন্য শহিদ হওয়া মানুষদের স্মরণে প্রতি বছর এই দিনটিকে বাংলাদেশ তুমুল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্মরণ করা হয়। জাতিসংঘও এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’ হিসাবে মান্যতা প্রদান করেছে।

বাংলাদেশে একুশের সেই অমর বলিদান নিয়ে সেখানকার গীতিকার আব্দুল গফফর চৌধুরী প্রথম গান লেখেন, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙা একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’ গানটিতে প্রথম সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। পরে ১৯৫৪ সালে ওই একই গানে নতুন করে সুরারোপ করেন আলতাফ মাহমুদ। সেই থেকে আজও ভাষা আন্দোলন স্মরণে বাংলাদেশে প্রভাতফেরিতে এই গানটি গাওয়া হয়।

সমসাময়িক বিশ্লেষণে এটা দেখা যায়, বাংলা ভাষার ঐতিহ্য সম্বন্ধে বাঙালির যে অতীত গৌরব ছিল, তা এখন অনেকখানি ইতিহাসে পরিণত। সমালোচকরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ভাবের ঘরে চুরি করার মতোই এই ‘মহান একুশে’ বা ‘উনিশে মে’ পালন করে সত্যিই কী বাংলা ভাষার ব্যবহার বা প্রয়োগের ব্যবহারিক দিক মসৃণ হচ্ছে। বিভিন্ন সাহিত্যসভা বা সেমিনারে প্রথিতযশা সাহিত্যিককে সংশয় প্রকাশ করতে দেখা যায় বাংলা ভাষাটাই আদৌ ‘মোদের গরব মোদের আশা’ আছে কিনা।

যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সেই গেল শতকের মাঝামাঝি পূর্ব বাংলার রফিক, বরকত, আব্দুল, জব্বার-এর মাতৃভাষার জন্য আহুতি দানকে এতগুলো বছর পরও স্মরণ করে, আবেগ আতিশয্যে প্রতিবছর ‘ভাষা শহিদ দিবস’ পালন করে আত্মপ্রসাদ লাভ করা শুধু। আহা, কতই না উদার কণ্ঠে, সোচ্চারে বা ব্যানার লিখনে, পত্রিকার ক্রোড়পত্র জুড়ে ওই কিছু সময় চলে ‘আ মরি বাংলা ভাষা’র চর্বিতচর্বণ। হয়তো এই আকুল হওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশি শহিদ ভাইদের মাতৃভাষার জন্য বলিদান সত্যিই মার্মান্তিক। আমরা বিভিন্ন ভাষাভাষীর ভারত রাষ্ট্রে থেকে প্রায় সর্বত্রই রাষ্ট্রভাষা উপস্থিতি অনুভূত করি। গো-বলয়ে রাষ্ট্রভাষা প্রচলন আছেই। তবে দক্ষিণ ভারতের চারটি ভিন্ন ভাষাধর্মী রাজ্যে রাষ্ট্রভাষার প্রতি অদ্ভুত অনীহা প্রকট। চার রাজ্যই তাদের নিজস্ব তামিল, তেলেগু, কন্নঢ়, মালয়ালম ভাষার প্রতি গোঁড়া মনোভাবাপন্ন হলেও ইংরেজি ভাষায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কথা বলতে কিন্তু কুণ্ঠাবোধ করেন না।

পশ্চিমবঙ্গ তথা অন্য কিছু রাজ্যে নিজস্ব প্রাদেশিক ভাষা থাকলেও সেই সব মাতৃভাষার ব্যবহার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বাংলা ভাষার ব্যবহারও কমে আসছে। টিভি সিরিয়ালগুলোর বিরতির ফাঁকফোকরে বিজ্ঞাপন বিজ্ঞপ্তিতে বা বাংলা ম্যাগাজিনগুলোর বাংলার লিখিত বিজ্ঞাপনেও কোথাও কোথাও উদ্ভট বাংলা। হয়তো সেগুলি বিজ্ঞাপন কপিরাইটার মূল হিন্দি বা ইংরেজি বিজ্ঞাপনী বিবৃতির অক্ষম বাংলা অনুবাদ। বাংলা ভাষাটাই যেন কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। এখন তো প্রকৃত বাংলার সঙ্গে হিন্দি-ইংরাজি ভাষার মিশেল দেখে দেখে, শুনে আমরা এতটাই ধাতস্থ হয়ে গেছি যে এই জগাখিচুরির ব্যাপারে আর কোনও তাপ-উত্তাপ বোধ করি না।

এটা ঠিক পেশাগত বা বৈবাহিক কারণে কেরিয়ার গঠনে দূর প্রদেশে বসত গড়তে হচ্ছে অনেককে। সুতরাং বাংলার শুদ্ধতাও সেখানে স্থানীয় ভাষা, রাষ্ট্রভাষা আর ইংরাজির সঙ্গে ডায়েলেকট-এ মিশে যাচ্ছে। জেন ওয়াইয়ের সঙ্গে পূর্ববর্তী প্রজন্মও ইন্টারনেটে ট্যুইটার ফেসবুক চ্যাটে মোবাইল বার্তাতেও মিশ্র ভাষায় দিব্যি সড়গড় হয়ে গেছি। অযথা তত্ত্বকথায় ভারী ‘একুশে’ দিনের আবেগ আতিশয্যের বাহুল্যতা অনেকটাই আপেক্ষিক মাত্র। এই বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তিগত বিভিন্ন চাহিদা সত্ত্বেও ভাষার মিশেল যেন ঐকান্তিক হয়ে উঠেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত একটা রব প্রায়ই ওঠে যে বাংলা বই পড়ার অভ্যেস বা পাঠকের সংখ্যাও দিনকে দিন কমে আসছে। এই সর্বনেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়া মানুষকে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে উন্নততর করলেও মানুষের বাংলা পাঠের অভ্যাসকে গ্রাস করছে।

এমন একটা কথাও প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে বাঙালিই নাকি বাংলা ভাষাটাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে দিচ্ছে। ইংরাজি শিক্ষার মূল্য, কথন ও পঠনপাঠনেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইদানীং কালে বিশেষ করে বাংলা বইয়ের পাঠক সংখ্যা কিন্তু বাড়েনি। যদিও কলকাতা বইমেলার কিছু মানুষ ধুয়ো তোলে তারা এখানে প্রতিবছর কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। তবে সেখানে বাংলা বই কত আদৌ বিক্রি হল, তা জেনেও না জানার মতো ভান করে তাঁরা এ কথা বলেন। তবে কলকাতা বইমেলা, সব সময় বাংলাদেশে ‘একুশের বইমেলার’ মতো শুধুমাত্র বাংলা বাংলার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি এটা আমাদের কাছে ভাল হয়েছে।

হয়তো এই অতিরিক্ত আবেগ আতিশয্যকে উসকে দিয়েই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সহস্রাব্দের সূচনায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে খাতায় কলমে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে উদযাপন করার ডাক দিয়েছে। এক যোগে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে, ভাষাপ্রেমী জনগণের কাছে যা প্রভূত তাৎপর্যপূর্ণ। আমরাও এই দিনটিকে যথাযথ মর্যাদা-সহ পালন করছি নানা উৎসব-অনুষ্ঠান-সেমিনার-বক্তৃতা-কবিতা পাঠের আসর ইত্যাদির স্মরণে-বরণে। যদিও বাংলা ভাষা নিয়ে পশ্চিমবাংলা, কলকাতায় এই হুজুগ প্রীতি দিনটিকে ঘিরে। ‘মহান একুশে’ প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে একটা বিশাল সামাজিক অনুষ্ঠান। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি’, ‘মাতৃভাষা দিবস’। এবং খুব হীন ভাবেই এটাই লক্ষণীয় যে, বছরে হুজুগে ক্লান্ত একটা দুটো দিনকে ঘিরে মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা, সম্ভ্রম, বা মাতামাতি গড়ে উঠে।

রচিত হোক ভাষা আন্দোলনের পূর্ণ ইতিহাস খুব সহজে কি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখে ফেলা যায়? কিন্তু এই আন্দোলনের প্রতি অধ্যায়ে অধ্যায়ে রয়েছে মানুষের আত্মত্যাগের গল্প। এখনও অনেকটা আড়ালেই রয়ে গেছে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত ছোট্ট ছোট্ট আন্দোলনের ইতিহাস। ছোট ছোট আন্দোলন গুলোই তো ৫২’র বিষ্ফোরণে বড় ভূমিকা রেখেছে।

সারাদেশের ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের ইতিহাস এখন নতুন প্রজন্ম জানতে চায়। আমার কাছে মনে হয়েছে ভাষা আন্দোলনের পূর্ণ ইতিহাস এখনও সংরক্ষণ হয়নি। এ জাতির এতো বড় অর্জনের ইতিহাসে এক ইঞ্চিও ফাঁক যেন না থাকে আমাদের উচিত হবে সেদিকেই নজর দেওয়া।

শুধু তাই নয়, বাংলা এখনও পূর্ণ মর্যাদার আসনে বসতে পারেনি। এখনও চাকরি জন্য বাংলার আগে ইংরেজিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এখনও দফতরগুলোতে ইংরেজির প্রাধান্যই বেশি। এরপর চলছে হিন্দির ভাষার শাসকদের  আগ্রাসন। অথচ যে ভাষা আমরা রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি। তাকে মূল্যায়ন করার দায়িত্ব তো আমাদেরই ছিল।

হিন্দি ভাষাকে খাটো করে দেখার অর্থই হয় না। প্রত্যেকটি ভাষার আলাদা ইতিহাস ও সংস্কৃতি আছে। কিন্তু তাই বলে বাংলা ভাষাভাষীর দেশে হিন্দিকে চাপিয়ে দেওয়া মানে বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে নস্যাৎ করা। হিন্দি ভাষা বাংলা ভাষার তুলনায় অনেক প্রবীণ। বাংলা ভাষার উদ্ভব চর্চা পদের সময়ে জন্ম হলেও এর পেছনের জন্মের ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছরের।

কিন্তু হিন্দি ভাষার বয়স কত, এই প্রশ্ন তো জাগে। ১৯২০ -১৯৩০ সালের দিকে ব্রিটিশ শাসকরা ভারতীয়দের উপর উর্দূ চাপানোর জন্য দেবনাগরী লিপিতে সংস্কৃত শব্দবহুল উর্দু লেখার প্রচলন করে। তখন থেকে হিন্দি ভাষার জন্ম হয়। অনেকে মনে করে থাকেন হিন্দি থেকে উর্দূ এসেছে কিন্তু আসলেই এই ধারণাটি ভুল বরং উর্দু থেকে হিন্দি এসেছে।

হিন্দী-উর্দূর মূল ভাষাটি আসলে খড়িবোলী , খড়ীবোলি সংস্কৃতের সৌরসেনী শাখা (তথ্যটি উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া) থেকে এসেছে। এর সঙ্গে আরবী - ফারসীর শব্দভাণ্ডার ও তুর্কির সাহিত্য সৌন্দর্য যোগ করে উর্দূ ভাষার প্রচলন করে মুঘলরা। ব্রিটিশ সরকারের ১৯১২ সালে প্রকাশিত কাগজের মুদ্রা গুলোতে তামিল, তেলুগু, মালায়ালাম, কন্নড়, মারাঠি, উর্দু, বাংলা থাকলেও হিন্দি দেখা যায় না। অর্থাৎ ১৯১২ সালে ও হিন্দি ভাষার তেমন অস্তিত্ব ছিল না। হিন্দি ভাষাটি আসলে ১৯২৬ সালে প্রচলন করা হয়। মনে রাখবেন সাম্রাজ্যবাদীরা আগে ভাষাকে আক্রমণ করে এরপর ওই ভাষার যে মানুষ গুলো যুক্ত আছে তাদের পদলিত করে, এই ভাবে তাঁরা অন্য ভাষার ইতিহাসকে নস্যাৎ করে শাসন কায়েম করে, এটাই সব দেশে ঘটেছে, ইতিহাস তাই বলে। রুখে দাঁড়ান, প্রতিবাদ করুন।

যাই হোক আজকের প্রজন্মের জন্য বাংলা ভাষার ইতিহাস জানা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, নিছক উৎসবের মতো ২১ ফেব্রুয়ারি'কে পালন করা খুবই বেদনা দায়ক। হিন্দি ও ইংরেজিতে কথা বলুন হয়তো জানাও দরকার কিন্তু বাংলা ভাষাকে সম্মানের সাথে প্রথমে রাখুন, প্রাণে রাখুন শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া খুবই  বিপদজনক।

(www.theoffnews.com - 21 February Bangla)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours