মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার ও লেকচারার, আহমেদাবাদ:

জানি না আপনাদের কারুর হয় কিনা আমার কিন্তু এই টোটকাটি ভীষণ কাজ দেয়---- কখনও কারুর কথায় মনটা তেতো লাগলেই নানান ভাল ভাল মিষ্টির কথা ভাবলেই মনটা বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে।  ছোটবেলার একটা স্মৃতি প্রায়ই মনকে নাড়া দেয়--- জিরাট কি সোমড়াবাজার --ঠিক মনে নেই ট্রেন থামতেই ঘিয়ে রঙ্গের ফতুয়া আর খাটো ধুতি পড়া বেশ ফর্সা মাঝবয়সী সৌম্যদর্শন এক ভদ্রলোককে দেখতাম। কাঁধে একটা ধূসর ঝোলা ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্মের এ মাথা থেকে ওমাথা অবধি পায়চারি করছেন। ওনার একহাতে বিশাল কাঁসার থালায় থাকত ধবধবে সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। সবগুলো এক সাইজের কাঁচা গোল্লা আর অন্য হাতে বেশ বড় কল লাগানো জলের ক্যান। বেশ গম্ভীর গলায় “কাঁচা গোল্লা“ বলে হাঁক দিতে দিতে এগোতেন। বাবা আর আমার চোখে চোখে কথা হয়ে যেত, শালপাতার ওই শঙ্কু আকৃতির তিনকোনা সদ্য বানানো ঠোঙ্গাতে করে গোটা চারেক কাঁচা গোল্লা ভদ্রলোক বাবার ইশারায় আমার দিকে এগিয়ে দিতেন। আমি খেতে খেতেই মায়ের চাপা বকুনি শুনতাম– “এই তো ব্যান্ডেলে বাপ বেটি মিলে কম্পিটিশন  করে রাজভোগ খেলি আবার কাঁচাগোল্লা! পারিস কি করে রে!”

ছোট কথায় কান দিতে নেই ভেবে এসবে কান দিতাম না আমরা। বাপ বেটি বরং গুপ্তিপাড়া না কালনা কোথা থেকে মাখা সন্দেশটা ট্রাই করব তা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়তাম। পেটরোগা ভাই বা ছিপছিপে সুন্দরী মায়ের কারুরই তখন  মিষ্টির প্রতি কোনোই আকর্ষণ ছিল না। আমি তখন নিজের তিনতাক ওয়ালা নধরকান্তি ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বাবার সঙ্গে শলা পরামর্শ করতাম ---নবদ্বীপ পৌঁছে রাতেই বিমলার চমচমটা খেয়ে নিতে হবে। 

তা এ হেন আমার এই দুর্বলতার খবর কর্তার অফিসে যে কি করে ছড়িয়ে পড়েছে জানি না, গুজরাটের নানান মিষ্টি অফিসে এলেই ম্যাডামের জন্য একটু হলেও আসে। কর্তা কম কথার মানুষ আমার ধারণা কর্তার অফিসের ড্রাইভার বিক্রমই ম্যাডামের এই দুর্বলতার খবরটি ফাঁস করেছেন। এখানে আসা ইস্তক আমার এই ভক্ত হনুমানটি আমাকে অনেক দোকান বাজার ঘুরিয়েছে আর ঠিক বুঝে গেছে আমার মিষ্টান্ন প্রীতি।

যাক ধ্যান ভাঙ্গতে শিবের গীত না গেয়ে আসল কথায় আসি। আমার বাপু কখনও কখনও ফ্রীজে মিষ্টি না থাকলে মনটা হুহু করে, তা কিভাবে যেন ভগবানের কানে খবরটা চলে যায় আর কোথাও না কোথাও থেকে মিষ্টি এসেও যায়। কর্তা সুরাট থেকে এবার ফিরল দুই প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে (ম্যাডামের জন্য, ভাবুন খবরটি আমেদাবাদ থেকে সুরাটেও চলে গেছে)। তা এবার সেই দুটি মিষ্টির কথা বলি ----ঘারি আর সুতারফেনি। 

ঘারি খানিকটা জনাই এর মনোহরার মত ময়দা, ঘি মাওয়া ড্রাইফ্রুটস দিয়ে তৈরী, বাইরেটা চিনির শক্ত আবরণের ভেতর মাখা সন্দেশ তবে মুখ ভরে যাবে আমন্ড কাজু পেস্তার স্বাদে। আর সুতারফেনি মিষ্টি বুড়ির চুল যেন। সুরাটের অনেক বাড়ীতেই নাকি সুতারফেনি তৈরী হয়, পাক্কা তিন দিন লাগে এই মিষ্টি বানাতে। ময়দা মাখতেই লাগে ঘণ্টা তিনেক তারপর আছে ঠাসাপর্ব, ওটাই আসল সুতো তৈরীর কৌশল। বাকিটা ছাঁকনির ওপর রেখে খাঁটি ঘিয়ে ভাজা, তারপর সারারাত চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা। সাদাই হয় কেউ আবার কেশর দিলে বাসন্তী রঙ্গের ও হয় ----ভুরভুর করছে ছোটো এলাচের গন্ধ আর ওপরে অকৃপণ হস্তে  আমন্ড আর পেস্তাকুচি ছড়ানো। 

তা ভগবান যখন মনের কথা শোনেন তখন তাঁকেও তো মিষ্টিমুখ করানো ভক্তের অবশ্য কর্তব্য। তাই সরস্বতী পুজোর আগের দিন বানিয়ে ফেললাম মালপোয়া। তা এমন জিনিস বানালে বন্ধুবর্গ প্রতিবেশী সবাই মিলে খাওয়াই নিয়ম। কারণ যারা সত্যি মিষ্টি বিলাসী তাঁরা নিশ্চয়ই মানবেন মিষ্টি শুধু খেয়ে নয় লোককে খাইয়েও সুখ। 

ছোট্ট একটা মজার ঘটনাও ঘটল, পাশের বিহারী মেয়েটি ভীষণ খুশি কারণ সরস্বতী পুজোর পরদিন নাকি পুয়া খাওয়াই নিয়ম। আমি যত বলি এটা পোহা নয়, ও বলে ইয়েহী পুয়া হ্যায় –পরে বুঝলাম মালপোয়াকেই বিহারে পুয়া বলে। যতদিন বাঁচি ততদিনই যে শিখি—মালপোয়াতে আছে ক্ষীর, নারকেল, ময়দা, মৌরি, বড়এলাচ, জয়িত্রী এক চিমটে খাবার সোডা। সুজি বাপু দিই না-- ঘি তেল মিশিয়ে ভেজে চিনির গাঢ় রসে  রাতভর ভিজিয়ে রাখা। সবাই বলে এটাই আমার সিগনেচার ডিশ।

(www.theoffnews.com - sweet)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours