তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
বাংলা গানে মাতৃ বিয়োগ। আজকের প্রজন্মের কাছে হয়তো অজানা ও অচেনা। কিংবদন্তী সংগীত শিল্পী আজ চলে গেলেন। তিনি ছিলেন মাটি ছোঁয়া আন্তরিক শিল্পী এককথায় নিরহংকারী মাতৃ স্থানীয় শিল্পী। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও উদ্বাস্তুদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় (১৯৩১ - ২০২২), কিন্তু আজ চলে গেলেন।
১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ওই বছর বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিল লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু। সেই উদ্বাস্তুদের পাশে দাঁড়াতে গণ আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। গান গেয়ে সংগ্রহ করেন অর্থ। সেই অর্থ তিনি তুলে দিয়েছিলেন উদ্বাস্তুদের কল্যানে। এখানেই শেষ নয়, তিনি অর্থ সাহায্য করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা। বাংলাদেশের শিল্পী সমর দাস বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন, সেই বেতার কেন্দ্র স্থাপনেও অর্থ সাহায্য করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির উপলক্ষে তিনি গেয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’। সেই গান অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। বাংলাদেশও ভুলে যায়নি তার অবদান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন প্রধান শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। তিনি কিংবদন্তি গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়াতে রং। বাবা ছিলেন রেলের কর্মকর্তা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় | মা ছিলেন হেমপ্রভা দেবী। বাড়িতে গানের পরিবেশ ছিল বংশ পরম্পরায়। পরিবারের আদি পুরুষ রামগতি মুখোপাধ্যায় ছিলেন বড় সঙ্গীতজ্ঞ। বাড়ির সকলেই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত চর্চা করতেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানে হাতেখড়ি তার বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে শিখিয়েছিলেন ভক্তিমূলক গান। তার মা হেমপ্রভা দেবীও ভাল গান গাইতেন। মাত্র বারো বছর বয়সে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কলকাতার আকাশবাণীর “গল্পদাদুর আসর” অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন। গীতিকার ছিলেন অজয় ভট্টাচার্য। বারো বছর বয়সেই অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সাড়ে চোদ্দ বছর বয়সে গীতশ্রী পরীক্ষাতেও প্রথম হলেন।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তালিম নেন যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। পণ্ডিত সন্তোষ বসু মল্লিক, পন্ডিত চিন্ময় লাহিড়ীর থেকেও প্রশিক্ষণ নেন তিনি। তবে ওনার সঙ্গীত গুরু ছিলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ'কে বাবা বলে ডাকতেন তিনি। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁও খুব স্নেহ করতেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে। ওনার কাছ থেকেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আয়ত্ত করেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত।
কলকাতার ডিকসনের লেনের জ্ঞান প্রকাশ ঘোষের বাড়িতে শুরু হয়েছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের তালিম। শেষে বড়ে গুলাম আলীর ছেলে মুনাবর আলীর কাছে তালিম নিয়েছিলেন। তিনি ১৭টা হিন্দি ছবিতে গান গেয়েছেন। তিনি এমনিতেই ভারত রত্ন।
তেরো বছর দশ মাস বয়সে এইচএমভি থেকে প্রকাশিত হয় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বেসিক রেকর্ড। গানের কথা ও সুর গিরীন চক্রবর্তীর। গানদুটি ছিল ‘তুমি ফিরায়ে দিয়াছ’ ও ‘তোমার আকাশে ঝিলমিল করে’। এরপর রাইচাঁদ বড়ালের সংগীত পরিচালনায় ‘অঞ্জনগড়’ এবং রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সংগীত পরিচালনায় ‘সমাপিকা’ ছবিতেও গান গাইলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এরপর শচীন দেববর্মনের ডাকে তিনি পাড়ি দিলেন মুম্বাই। সেখানে সঙ্গীত পরিচালক অনিল বিশ্বাসের সুরে লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ডুয়েট গাইলেন তিনি। সেই সূত্রেই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রপাত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। সেই বন্ধুত্ব টিকে আছে সত্তর বছর। কিন্তু মুম্বাইতে বেশিদিন মন টিকল না সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। ফিরে এলেন কলকাতায়।
শুরু হল বাংলা গানের এক অনন্য অধ্যায়। ‘সপ্তপদী’ চলচ্চিত্রের সেই দৃশ্য। উত্তম আর সুচিত্রা চলেছেন বাইকে। গাইছেন “এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত তুমি বলো তো!” সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে লিপ দিচ্ছেন উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন। এই গান বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। হেমন্ত মুখার্জীর সাথে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ডুয়েট আজও বাঙালিকে নস্টালজিক করে দেয়। উত্তম সুচিত্রার বহু হিট গানের নেপথ্য ছিলেন এই দুজনেই। হেমন্ত মুখার্জি ছাড়াও রবিন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতা ঘোষের সঙ্গেও অনেক কাজ করেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। একবার কলকাতার রাজভবনে পয়লা জানুয়ারির অনুষ্ঠানে গাইলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। গানের পর ইন্দিরা গান্ধী পরিচয় করে বলেছিলেন, “এত মিষ্টি গলা তোমার! ভীষণ ভাল লাগল।” তবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাফল্যের পিছনে তার স্বামী গীতিকার শ্যামল গুপ্তেরও বড় অবদান ছিল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান করতে যাতে সমস্যা না হয় তাই নিজে তুলে নিয়েছিলেন সাংসারিক দায়দায়িত্ব।
২০১১ সালে বঙ্গবিভূষণ সম্মান পান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ১৯৭০ সালে জয়জয়ন্তী এবং নিশিপদ্ম চলচ্চিত্রে তার গানের জন্য সেরা নেপথ্য গায়িকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।তবে পাননি জাতীয় পুরস্কার। তাতে অবশ্য আক্ষেপ নেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন শ্রোতাদের ভালবাসাই তার জীবনের সেরা পুরস্কার।
গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তাঁর কণ্ঠের জাদুতে মজে কয়েক প্রজন্ম। সমকালীন আর এক কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে কেমন ছিল তাঁর সম্পর্ক? সন্ধ্যার মায়ের হাতের কোন রান্না খেতে পছন্দ করতেন লতা? সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জীবনের অজানা কিছু কাহিনি।
১৯৪৫-এর অগস্ট মাসে এক চোদ্দ বছর বয়সের কিশোরীর প্রথম রেকর্ড বেরলো কলম্বিয়া থেকে। আধুনিক গান— গিরীন চক্রবর্তীর কথায় ও সুরে ‘তুমি ফিরায়ে দিয়াছ’ ও ‘তোমার আকাশে ঝিলমিল করে’। এর বছর দু’য়েকের মধ্যেই দু’টি বাংলা ছবিতেও নেপথ্যে গাইবার সুযোগ হয়ে গেল: রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘অঞ্জনগড়’ এবং রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘সমাপিকা’ ছবিতে। শুধু তাই নয় ওই একই বছরে অর্থাৎ ১৯৪৮-এ তিনটি আধুনিক গানের রেকর্ড! ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৮: এই তিন বছরের উজ্জ্বল সঙ্গীতযাত্রাই বলে দিচ্ছে যে এই কিশোরী থাকতেই এসেছেন। তিনি আর কেউ নন, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়— জীবন্ত কিংবদন্তি। বাংলা ছায়াছবির গান, বেসিক আধুনিক গানের সম্রাজ্ঞী সন্ধ্যা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতেও বিশেষ নৈপুণ্যের পরিচয় রেখেছিলেন। এই সন্ধ্যাই এক সময় মুম্বইয়ে হিন্দি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাকের কিছু কাজ করেছিলেন, যা অনেকটাই অজানা। সন্ধ্যার সেই মুম্বই-পর্বের কিছু কথা আজ জানা আবশ্যক।
১৯৪৮-এর শেষ। রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘বিদুষী ভার্যা’ ছবির গান রেকর্ডিং সেরে ঢাকুরিয়ায় বাড়ি ফিরেছেন সন্ধ্যা। শচীন দেববর্মনের পরিচিত এক ব্যক্তি— যিনি সন্ধ্যার পরিবারেরও চেনাজানা— সেই শচীন গঙ্গোপাধ্যায় সে দিন সন্ধ্যার বাড়িতে এসে বললেন—শচীন দেববর্মন তোমায় বম্বে নিয়ে যেতে চান। শচীনদার স্ত্রী মীরা দেববর্মনও তোমার গান শুনতে চেয়েছেন। শচীন দেববর্মন তো আগেই মুম্বই চলে গিয়েছেন। কলকাতায় সাউথ অ্যান্ড পার্কের বাড়িতে মীরাদি থাকতেন। এক দিন সন্ধ্যা গান শুনিয়েও এলেন মীরাদিকে। শুনে ভালো লেগেছিল তাঁর। যা হোক, মুম্বই যাবেন কি যাবেন না সেই নিয়ে কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর ১৯৫০-এ সন্ধ্যা শেষ পর্যন্ত মুম্বই গেলেন। ট্রেনে, সঙ্গে দিদি সরসী আর বড়দা।
মুম্বইয়ে খার স্টেশনের পাশে ‘এভারগ্রিন’ হোটেলে থাকতেন শচীন দেববর্মন। সন্ধ্যাদের ব্যবস্থাও সেখানে করেছিলেন। শচীন দেববর্মনকে আগে থেকেই চিনতেন সন্ধ্যা। কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে গাইতে গিয়ে আলাপ হয়েছিল। মুম্বইয়ে রোজই সন্ধ্যাদের খোঁজখবর নিতেন শচীন দেববর্মন।
শচীন দেববর্মন নিয়ে গেলেও মুম্বইয়ে প্রথম প্লেব্যাকের সুযোগ হল অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘তারানা’ ছবিতে। সন্ধ্যার বড়দাই মুম্বইয়ে অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শচীন দেবের মতো অনিল বিশ্বাসও বাঙালিদের খুব পছন্দ করতেন। অনিলদার বাড়িতে সন্ধ্যারা মাঝে মাঝে যেতেন, গানবাজনা হত। এক দিন গেছেন, দেখেন তালাত মাহমুদ এসেছেন। অনিলদা খুব সুন্দর গাইতেন, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, প্রাদেশিক গান, লোকগীতি— সবই জানতেন। তো সে দিন অনিলদাই শুরু করলেন একটা ঠুংরি দিয়ে, তার পর অনিলদার কথা মতো যোগ দিলেন সন্ধ্যা আর তালাত।
অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘তারানা’ ছবিতে গাইতে গিয়েই লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে পরিচয় হল। গানটা ছিল লতার সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে— ‘বাল পাপিহে বোল রে, তু বোল পাপিহে বোল’। অভিনেত্রী মধুবালার লিপে লতার, সন্ধ্যার গান ছিল শ্যামার লিপে। অনিল বিশ্বাসের সুরে পরে ‘ফরেব’ ছবিতে গেয়েছেন সন্ধ্যা।
পরিচয়ের কিছু দিনের মধ্যেই লতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়ে যায় সন্ধ্যার। লতা প্রায়ই চলে আসতেন এভারগ্রিন হোটেলে সন্ধ্যার কাছে। সাধারণ বেশভূষা, আন্তরিক ব্যবহার। লতাকে খুব ভালো লাগল সন্ধ্যার। লতা একলাই আসতেন, কখনওবা থাকতেন সুরকার রোশন, সি রামচন্দ্র। লতার সঙ্গে গান নিয়ে নানা আলোচনা হত। তখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নামী শিল্পী রোশেনারা বেগম, হীরাবাই বরোদেকর, কেশরবাই বরোদেকর। রোশেনারার গান সবচেয়ে পছন্দ করতেন লতা। লতা আবার খুব ভালো অন্যের গলা নকল করতে পারতেন। সে সময়কার হিন্দি ছবির মহিলা শিল্পীদের গলা নকল করে শোনাতেন লতা সন্ধ্যাকে। প্রথম দিকে সন্ধ্যার সঙ্গে তাঁর দিদি ছিলেন। কয়েক মাস দিদি থেকে চলে যাবার পর সন্ধ্যার মা আসেন। মা নিজেই রান্না করতেন। হোটেলের খাবার খেতেন না। লতা মায়ের হাতের রান্না দারুণ পছন্দ করতেন। লতা এসে মা’কে বলতেন— ‘মাইজি, আজ থোড়াসা চাউল লেঙ্গে।’ সন্ধ্যার মা লতাকে রেঁধে খাওয়াতেন নানা তরকারি, কোনও দিন আবার পায়েস। লতা খুব তৃপ্তি করে খেতেন সে সব।
লতা সন্ধ্যার কাছে এসে অনেক সময়ই শুয়ে শুয়ে গল্প করতেন। বলতেন নানা সুখ-দুঃখের কথা। বলতেন কী ভাবে কত কষ্ট করে স্টুডিওর দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে। পুরনো ছেঁড়া চটি, কাপড় মাত্র দু’টি। যেটা পরে বেরোতেন, রাতে ফিরে সেটাই কেচে বালিশের নীচে রেখে দিতেন, ইস্ত্রি হয়ে যেত। কোনও কোনও সঙ্গীত পরিচালক বলতেন— ‘ইতনি পাতলি আওয়াজ?’ কিন্তু লতা দমবার পাত্রী নন। প্রতিভা যাঁর আছে তাঁকে আটকাবে কে? এ সব কথা শুনে লতার ওপর শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায় সন্ধ্যার। কোনও কোনও দিন সন্ধ্যাও চলে যেতেন লতার বাড়ি। লতার মা খুবই ভালোবাসতেন সন্ধ্যাকে। লতা কফি খুব পছন্দ করতেন। এলাচ দিয়ে কফি তৈরি করতেন। নানা গল্প গাছা হত। একরাশ চুল লতার। লতাকে বলতেন সন্ধ্যা— কী সুন্দর চুল তোমার। তার পর লতা কোনও কাজে বেরোলে সন্ধ্যাকে নামিয়ে দিয়ে যেতেন হোটেলে। পরবর্তীকালে সন্ধ্যার ঢাকুরিয়ার বাড়িতেও এসেছেন লতা।
সন্ধ্যা মুখার্জী মানেই উত্তম সুচিত্রা, সন্ধ্যা মুখার্জী মানেই ফেলে আসা বাংলা গানের মেলোডি। শোনা যায় যখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় যখন শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করতেন তাঁর দুই মাস আগে থেকে আধুনিক গানের অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিতেন। একসময়ে প্রায় ২৫ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছেছিলেন শুধু বেতারের মাধ্যমে। কিন্তু তাঁর জীবন ছিল বাহুল্যবর্জিত, একদম অনাড়ম্বর।
যাই হোক অনেকের একটা ধারণা আছে লতার সঙ্গে সন্ধ্যার সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না, এতক্ষনে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে এটা একেবারেই ভুল। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা গানের বটবৃক্ষ। বর্তমান পত্রিকার তরফ এক সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল। কিছু অংশ তুলে দিলাম।
প্রশ্ন: আপনার গাওয়া গানের গুণগত মান নিয়ে কখনও সমালোচনা হয়েছিল?
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়: আমার বড়দা আমার গানের সবথেকে বড় সমালোচক ছিলেন। আমার গান নিয়ে কেন সমালোচনা হবে না বলতে পারো? সমালোচনা না শুনলে এসব কী করে বলো তো? আমার গাওয়া সিনেমার গান, আধুনিক গান পরে একা একা শুনতাম। সুর মানে তো ব্রহ্ম। কোথাও কোথাও মনে হয়েছে স্কেলিং ঠিক নেই। কখনও মনে হয়েছে গানে অলঙ্কার একটু বেশি বা কম হয়েছে। আর একটু অন্যভাবে গাইলে হয়তো ভালো হতো। নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারি না।
প্রশ্ন: মহানায়িকা আর মহাগায়িকার যুগলবন্দি কি ভোলা যায়? সুচিত্রা-সন্ধ্যার কথা বলছি। ব্যক্তিগত জীবনে কেমন সম্পর্ক ছিল?
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়: প্রথমেই বলি আমি একজন সাধারণ গায়িকা। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে সুচিত্রার লিপে প্রথম গাইলাম। ও এত সুন্দর লিপ দিয়েছিল যেন নিজেই গাইছে। কত যে গান গেয়েছি ওর জন্য। আমার স্বামী গীতিকার শ্যামল গুপ্তও সঙ্গে ছিলেন। ভরত মহারাজের স্নেহের কথা ভুলতে পারি না। ‘সাতপাকে বাঁধা’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন সুচিত্রা। ওঁর বাড়িতে একদিন অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলাম। সুচিত্রা সেই সময় থাকতেন নিউ আলিপুরে। সেদিন আমি অনেক ফুল নিয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিল বিদেশি পারফিউমের একটা শিশি। গোটা পারফিউমটা ছড়িয়ে দিয়েছিলাম ওর গায়ে। সুচিত্রা খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন, ‘সন্ধ্যা আমাকে একেবারে রানির মতো করে দিল আজ।’
প্রশ্ন: শচীন দেববর্মনের ডাকে হিন্দি ছবিতে প্লে-ব্যাক করার জন্য মুম্বই গেলেন। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। সাফল্য পেয়েও কলকাতায় ফিরে এলেন।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়: (লিকার চায়ে চুমুক দিয়ে) শচীনদা আমাকে মুম্বই নিয়ে গেলেন তাঁর ছবিতে গাইবার জন্যে। অদ্ভুত ব্যাপার তাঁর ছবিতে কিন্তু প্রথমে গাইনি। গেয়েছিলাম আরও একজন গুণী সঙ্গীত পরিচালক অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘তারানা’ ছবিতে। লতা মঙ্গেশকর ও আমার ওই ডুয়েটটা ছিল— ‘বোল পাপিহে বোল রে/বোল পাপিহে বোল’ গাওয়ার সূত্রেই লতার সঙ্গে পরিচয়। আমি থাকতাম খার রেল স্টেশনের প্রায় লাগোয়া এভারগ্রিন হোটেলে। রেকর্ডিং না থাকলে লতা প্রায়ই আমার কাছে আসতেন। খুব গল্প করতাম দু’জনে মিলে। লতা ও আমার মধ্যে গান নিয়ে অনেক আলোচনা হতো। আমার মা কিছুদিন ছিলেন আমার সঙ্গে। লতা মায়ের রান্না পছন্দ করতেন। লতা তখন থাকতেন চার্নিরোড স্টেশনের কাছাকাছি এক জায়গায়। আমিও ওঁদের বাড়িতে যেতাম। লতা ভালো নকল করতে পারতেন। ওঁর কমেডির সেন্সও দারুণ। সেই সময় হিন্দি ছবিতে যেসব মহিলা শিল্পী গাইছেন, তাঁদের কপি করে আমাকে শোনাতেন লতা। আমাদের প্রায় সত্তর বছরের বন্ধুত্ব আজও অটুট। একবার ওঁকে বলেছিলাম, ‘তুমি ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ গানটা একটু শোনাবে?’ সঙ্গে সঙ্গে ফোনে শুনিয়ে দিলেন। কিন্তু মুম্বইতে মন টিকলো না, তাই ফিরে এলাম।
সাক্ষাৎকারের শেষে বললেন, শুধু একটা কথাই বারবার মনে হয়, এত মানুষের ভালোবাসার সত্যিই কি যোগ্য আমি?
(www.theoffnews.com - singer Sandhya Mukhopadhyay)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours