তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
ভারতবর্ষের মানুষ কি সত্যি হিন্দু রাষ্ট্র চায়। ভারতীয় সংস্কৃতির পাশে হিন্দু রাষ্ট্র কি সঙ্গতিপূর্ণ? এই প্রশ্নের গভীরে যাওয়া খুবই প্রাসঙ্গিক আজকের দিনে।
হিন্দু রাষ্ট্র শব্দটির মানে কি?
রাষ্ট্র একটি কেন্দ্রীভূত শক্তি। যার নিজস্ব সেনাবাহিনী আছে, অর্থ নীতি ও প্রশাসনিক মূলক রাজনীতি আছে। যা দিয়ে সমগ্র দেশকে শাসন করা যায়। স্টেট ও নেশনের কনসেপ্ট হলো মূলতঃ euro কনসেপ্ট। যাকে ভাঙলে সবাই ভেঙে পড়বে, তাই ভারতকে জয় করেও শেষে ভাঙতে পারেনি। কারণ ভারতবর্ষে একটি মাথা বলে কিছু ছিল না। এই দেশটি নানা রকম সমাজে বিভক্ত ছিল। বিতর্ক ছিল এই দেশের প্রাণ। বিনা প্রশ্নে কোনো কিছুকে মেনে না নেওয়া। ওই কারণেই Stereotype কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ছিল না বলেই বিদেশিরা ভারতকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। স্টেট কনসেপ্টটা আসে ব্রিটিশদের হাত ধরে।
এত হিন্দুত্ত্ব নিয়ে কথা বা বিতর্ক চলছে। এই হিন্দু কারা? যারা ঈশ্বর ও ধর্ম বিরোধী তারাও হিন্দু আর যারা সপক্ষে তারাও হিন্দু। হিন্দু বলতে কোন সম্প্রদায়কে বোঝায় না। হিন্দু শব্দের অর্থ উদার বিশ্বজনীনতা, হিন্দু শব্দ সংস্কৃতি বাচক, এক অপৌরুষেয় শব্দ। যে ভারত ভূখণ্ডে বৈদিক, বৌদ্ধ, শৈব, বৈষ্ণব, এমন কি তথাকথিত অন্য ধর্মের সকল অধিববাসীরাও হিন্দু। আমাদের পূর্বপুরুষরা দৃপ্তকন্ঠে উচ্চারণ করে গেছেন-
“আসিন্ধুসিন্ধুপর্য্যন্ত যস্য ভারতভূমিকা পিতৃভূঃ পূণ্যভূশ্চৈব স বৈ হিন্দুরিতিস্মৃতঃ।"
অর্থাৎ সিন্ধুদেশ থেকে আরম্ভ করে দক্ষিণে সিন্ধু অর্থাৎ সমুদ্র পর্যন্ত পৃথিবীর তাবৎ পুণ্য সংস্কার, পুণ্য আচার, পুণ্য অনুষ্ঠান, পুণ্য জ্ঞানের বিমল ধারা যেখানে পিতৃভূঃ অর্থাৎ জন্মগ্রহণ করেছে সেই পাবন ক্ষেত্রে আমরা বাস করি বলে আমাদের পিতৃপুরুষরা নিজেদের হিন্দু নামে অভিহিত করতেন। সিন্ধু থেকেই এসেছে হিন্দু। যারা বাইরে থেকে ভারতবর্ষে এসেছিল আরবরা পার্সিয়ানরা।
এরা স'এর উচ্চারণ করতে পারতো না, তাই হ বলতো। তাই থেকেই হিন্দু। বর্তমানে সাধারণভাবে হিন্দু শব্দ দিয়ে হিন্দুধর্মকে বোঝানো হয়। যদিও বুৎপত্তিগতভাবে হিন্দু শব্দটি দ্বারা সিন্ধু নদের অববাহিকায় বসবাসরত সকলকে বোঝানো হয়। ভারতের সংবিধানে "হিন্দু" শব্দটি ব্যবহার করে যে কোন ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসীকে (হিন্দুধর্ম, জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম বা শিখধর্ম) নির্দেশ করা হয়েছে। হিন্দু এবং হিন্দি শব্দ দুটিকে সংস্কৃতির পরিচায়ক হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে সেই সকল লোকের জন্য যারা সিন্ধু নদের পাশে বসবাস করছেন। এইভাবে কবি যেমন ইকবাল, মন্ত্রী যেমন এম.সি.চাগলা এবং আরএসএসের মত প্রতিষ্ঠান হিন্দু এবং হিন্দি শব্দ দুটিকে ব্যবহার করেছেন সিন্ধু নদের পাড়ে বসবাসরত মানুষদেরকে বোঝাতে তা সেই যে কোন ধর্মের হোক না কেন।
হিন্দু শব্দটি এসেছে (পার্সিয়ান হয়ে) সংস্কৃত শব্দ সিন্ধু (ঐতিহাসিক স্থানীয় সিন্ধু নদী বা ইন্ডাস্ রিভার) থেকে। এর অবস্থান ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অংশে (বর্তমানে পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতের অংশে)। গেবিন ফ্লাডের মতে, "আসল পরিভাষা হিন্দু প্রথম দেওয়া হয় পার্সিয়ান ভৌগোলিক পরিভাষা থেকে যা দ্বারা সিন্ধু নদীর পাশে বসবাসকারী লোকেদের বোঝানো হত । শব্দটি দিয়ে তখন ভৌগোলিক অবস্থান বোঝানো হত এবং এর দ্বারা কোন ধর্মকে বোঝানো হত না।
Hinduism এই শব্দটি ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের তৈরি শব্দ। ১৮৪৮ সালের আগে হিন্দু বিশ্বাস বা হিন্দু ভাবাবেগ, এই সব শব্দ শোনা যায়নি। কারণ সনাতন ধর্মে হিন্দু বিশ্বাস কথাটার কোনো মূল্য নেই। কারণ বিশ্বাস মানেই সন্দেহ। যারা ঈশ্বর বিশ্বাস করেন আর যারা করেন না Both are swiming in same water। সনাতন ভারতবর্ষের লক্ষ ছিল সত্য অনুসন্ধান করা। মুক্তি আসল লক্ষ।
ধর্ম নয়। বরং ধর্মীয় বন্ধন থেকে মুক্তি। হিন্দু শব্দটি কিন্তু ব্রাহ্মণদের কোন ধর্ম গ্রন্থে নেই । শ্রুতি, পুরাণ, বেদ, গীতা, রামায়ণ, মহাভারতে অর্থাৎ সংস্কৃতের কোন মৌলিক গ্রন্থে ‘হিন্দু’ শব্দটি নেই। এবিষয়ে বাবা সাহেব Dr. B.R AMBEDKAR ANNIHILETION OF CASTE এ বলেছেন-
`সর্ব প্রথম এই চরম সত্যকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, হিন্দু সমাজ একটি পৌরানিক কাহিনী । হিন্দু নামটা একটা বিদেশী নাম। ‘হিন্দু’ শব্দটা (আক্রমনকারী) মুসলমানদের দেওয়া নাম। স্থানীয় অধিবাসী এবং মুসলমানদের মধ্যে স্বাতন্ত্র বোঝানোর জন্য তারা স্থানীয় অধিবাসীদের ‘হিন্দু’ নামে অভিহিত করেছিল । ভারতে মুসলমানদের আক্রমনের পূর্বেকার সময়ে সংস্কৃত ভাষার লেখকদের ‘নেশন’ (জাতি) সম্বন্ধে কোন ধারনা ছিল না। তারা ভারতীয় অধিবাসীদের একটি সাধারণ নামকরনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। তাই হিন্দু সমাজের বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই। এটা শুধু জাতিগুলির একটি সমষ্টিগত নাম।
আজ আমরা এই সব ইতিহাস ভুলে গেছি। শেষ বিচারে এই দেশে হিন্দু মানে বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। কোনো একক ধর্ম নয়। রাষ্ট্র ও নয়। কোনো এক ব্যক্তি এর সৃষ্টি কর্তা নয়। হিন্দু সংস্কৃতি একটা সাগর এইখানে বহু নদী মিলিত হয়েছে। হিন্দু ধর্ম বলে কিছু হয় না। একটি কথা প্রাচীন ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, তা হলো সনাতন ধর্ম। আসলে হিন্দুত্বর তথ্যের সাথে হিন্দু ব্রাহ্মন্যবাদ সঙ্গতিপূর্ণ। যেটা ভারতের মূল কণ্ঠস্বর নয়। এই ব্রাহ্মন্যবাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে ছিলেন বুদ্ধ, চার্বাক পন্থীরা, তুলসী দাস, সন্ত কবীর, চৈতন্য এবং বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ এবং বিদ্যাসাগর।
সবার ওপরে মানুষ বড় তাঁহার ওপরে কেহ নাই, প্রথমে বললেন কবি বিপ্রদাস, সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, সবার ওপরে মানুষ সত্য তাঁহার ওপরে কেহ নাই। কিন্তু এই কথা আজ অনেকেই ভুলতে বসেছি কোনো জাতি, গোষ্ঠী বা কোনো ধর্ম রাষ্ট্রের কেন্দ্রে থাকতে পারে না। এটা সর্ব ধর্ম ও সর্ব সমন্বয়ের দেশ, বহু মতে বিভক্ত, এটাই আমাদের দেশের সৌন্দর্য্য। এইখানে unity মানে diversity। বৈচিত্রের মধ্যেই ঐক্য।
সুভাষচন্দ্রের সারা জীবনই তীব্র দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত। এক জন হিন্দু হিসেবে রামকৃষ্ণদেব ও স্বামী বিবেকানন্দের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন তিনি। আর রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে শিষ্য ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ভারত পথের প্রধান এক দিশারি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের। চিত্তরঞ্জনের মতোই নেতাজি সুভাষের জীবনে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের স্থান ছিল না কোনও। সুভাষ লিখেছেন, “ভারতের হিন্দু জননায়কদের মধ্যে দেশবন্ধুর মতো ইসলামের এত বড় বন্ধু আর কেহ ছিলেন বলিয়া আমার মনে হয় না। তিনি হিন্দুধর্মকে এত ভালবাসিতেন যে তার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন, অথচ তাঁর মনের মধ্যে গোঁড়ামি আদৌ ছিল না। আমি জিজ্ঞাসা করি, কয়জন হিন্দু নায়ক বুকে হাত দিয়া বলিতে পারেন তাঁহারা মুসলমানকে আদৌ ঘৃণা করেন না?”
অথচ এই নেতাকে হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসেবে প্রতিস্থাপনের বেপরোয়া চেষ্টা চলছে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও সাভারকরের মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে নেতাজিকে একাসনে বসানোর চেষ্টা চলছে। ইতিহাস কী বলে? শ্যামাপ্রসাদের জনসঙ্ঘ-পূর্ববর্তী হিন্দু মহাসভার মিটিং ভেঙে দেয় সুভাষের ফরওয়ার্ড ব্লকের বাহিনী। শ্যামাপ্রসাদের নিজের লেখা লিভস ফ্রম আ ডায়েরি-তেও তার সাক্ষ্য। সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতিত্বকালেই কংগ্রেস দল কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার দ্বৈত সদস্যপদ নিষিদ্ধ করেছিল। অর্থাৎ, এক সংগঠনের সদস্য থাকলে অন্যটির সদস্য থাকা চলবে না। মুসলিম লীগের পক্ষেও সেই একই আইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৪০ সালের ৪ মে ফরওয়ার্ড ব্লকের কাগজে ‘কংগ্রেস এবং সাম্প্রদায়িক সংগঠন’ শিরোনামে সুভাষ সম্পাদকীয় লেখেন, “হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের কোনও সদস্য কংগ্রেসের কোনও নির্বাচনী কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।” এই হিন্দু মহাসভার দুই বিশাল নেতা ছিলেন দামোদর বিনায়ক সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
শুধু শ্যামাপ্রসাদের মিটিং ভেঙে দেওয়াই নয়। সুভাষ বাহিনী আরও বেশি নির্মম ছিল সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি। আরএসএস, জনসঙ্ঘ ও এবিভিপি নেতা বলরাজ মাধোক তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, “সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সমর্থকদের বলেছিলেন হিন্দু মহাসভাকে আটকাতে। হিন্দু রাষ্ট্র শব্দটি শুধু ভারতের সংস্কৃতির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ শুধু তাই নয় অত্যন্ত বিপদজনক।
যত মত তত পথ এটাই ভারতবর্ষ। ফরাসি সাহিত্যিক আন্দ্রে ঘিদে বলেছিলেন যে সত্যে পৌছে গেছে তাঁকে সন্দেহ কর, বরং যে সত্য খুঁজছে তাঁর সাথে থাকো। হিন্দুত্ব বা হিন্দু রাষ্ট্র হলো ফেলে আসা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আধুনিক রূপ। এই লড়াইটা কয়েক হাজার বছর চলছে। হিন্দুত্ববাদীরা থাকুক এই দেশে না হলে মানুষ কি করে বুঝবে বহুত্ববাদকে?
(www.theoffnews.com - Hindu Hinduism India)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours