সুস্মিতা পাল, লেখিকা ও শিক্ষিকা, কলকাতা:

করোনা আরো অনেক কিছুর সঙ্গে প্রতিবছর বার দুয়েক বেড়াতে যাওয়ার আনন্দটাও কেড়েছে। তাই, দমচাপা গুমোট প্রায় দু দুটো বছর কাটানোর পর হিমেল শীতে হিম- আলয়ের আঁচলের ছায়ায় কটা দিন জুড়িয়ে নিতে গত ১৮ ডিসেম্বর পা বাড়ালাম ঘরের বাইরে। 

"তারপর যে-তে যে-তে যে-তে

এক নদীর সঙ্গে দেখা...

সে নদীর দুদিকে দুটো মুখ।

এক মুখে সে আমাকে আসছি বলে

দাঁড় করিয়ে রেখে

অন্য মুখে

ছুটতে ছুটতে চলে গেল।"

আমিও ধাওয়া করলাম তার পিছু পিছু, 'নামটা তো বলে যাও তোমার'। হাওয়ার গতিতে দৌড় জারি রেখে সে একঝলক হেসে বলে গেল -- ' নামটি আমার গোমতী'। 

স্রোতস্বিনীর গতিপথ অনুসরণ করিতে করিতে কাহিনী প্রবেশ করে এক প্রাচীন নগরীমধ্যস্থ অট্টালিকায়।

"তুম মেরে পাস হোতে হো গ্যয়ে

 যব কোই দুসরা নেহি হোতা" 

অস্তমিত চৈতী অপরাহ্নের মৃদু পবন গুলনারের গন্ডদেশে উড়ন্ত অলকচূর্ণ লইয়া বহুক্ষণ ব্যাপিয়া ক্রীড়ারত। গুলনার অদ্য গভীর অন্যমনা, গবাক্ষপথে শূন্যে তাহার দৃষ্টি ন্যস্ত, তথাপি সে লক্ষ্য করিতেছে না কোনো বস্তু বা ক্রিয়ার প্রতি। তোমরা পটলচেরা নয়নের প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হও, গুলনারের চক্ষু দুটির সহিত উক্ত আনাজের কণিকামাত্র সাদৃশ্য নাই। তথাপি তাহার চক্ষুদ্বয় তদীয় মুখশ্রীর প্রাণস্বরূপ। চঞ্চল খঞ্জনাপক্ষীর ন্যায় তাহা সতত নৃত্যরত - কৌতুকে, আনন্দে, ব্রীড়া বা প্রেমে গুলনারের বর্ণময় হৃদয়খানির ভাব প্রকাশের প্রতিবিম্ব।

"হাজারো খোয়াইশে এ্যায়সি কে

হর খোওয়াইশ পে দম নিকলে

বহত নিকলে মেরে আঁরমা লেকিন

ফির ভি কম নিকলে।"

বাল্যে গুলনার বড়া ইমামবড়ার ঊর্ধ্বতন প্রকোষ্ঠগুলিতে আপনমনে চঞ্চলা হরিণীর ন্যায় সঞ্চরণ করিয়া বেড়াইত। বংশপরম্পরায় নটিনী তাহারা, লঘুপদে গোলকধাঁধা সদৃশ কক্ষ হইতে কক্ষান্তরে পদচারণা করিয়া পথ সন্ধান করিতে কেহই তাহার সমকক্ষ ছিল না। বড়া ইমামবড়ার অপর নাম যে ভুলভুলাইয়া তাহা সার্থক। নবাবের আমন্ত্রণে যৌবনে তাহারও সুযোগ মিলিয়াছে অগণিত অপরাপর নর্তকীদলের সহিত প্রদীপমালায় সজ্জিত স্বল্পালোকিত ঐ সুবিশাল প্রাসাদে রাত্রিযাপনের। বিলাসে-রঙ্গে-ব্যসনে নবাবের রাত্রির প্রহর অতিবাহিত হইয়াছে প্রদীপমালায় সজ্জিত স্বল্পালোকিত ঐ সুবিশাল প্রাসাদে। বর্তমানে নবাব পলায়ন করিয়া না জানি কোন্ দেশে আত্মগোপন করিয়া আছেন।লক্ষ্ণৌনগরী বর্তমানে সিপাহী বিদ্রোহের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিবলয়ের গ্রাসে।

উক্ত দহনে পুড়িয়া খাক হইয়া গিয়াছে গুলনারের প্রেম, পঙ্কিলতার আবর্তে বাস করিয়াও যে কুসুমকোমল পবিত্র হৃদয়খানি সে উৎসর্গ করিয়াছিল ওয়ার্নার সাহেবকে। প্রভাতেই দুঃসংবাদ প্রবিষ্ট হইয়াছিল গুলনারের কর্ণে - উন্মত্ত সিপাহীদের হস্তে নৃশংসভাবে প্রাণ হারাইয়া়ছেন সাহেব। গোমতীতীরে গুলনারের কোঠিতে নৃত্যগীত উপভোগের নিমিত্ত আগমন ঘটিয়াছিল ওয়ার্নারের, ধীরে ধীরে দেশ-ভাষা-সামাজিক অবস্থানের অসাম্য দূরীভূত হইয়া তাহারা একাত্ম হন পরস্পরের।ক্ষণিকের সুখ সহিল না অভাগীর অদৃষ্টে।

"জিন্দগী ইঁয়ু ভি গুজর হি যাতি

কিঁউ তেরা রাহগুজর ইয়াদ আয়া।"

এতদৃশ চিন্তিত হৃদয়ে হস্তোদ্ধৃত ক্ষুদ্র হস্তিদন্তনির্মিত কৌটা বারংবার উন্মুক্ত করিতেছিল গুলনার। এই বিষপাত্র পলকমাত্রেই সকল বেদনা সমাপ্তি ঘটাইতে পারে। তথাপি দিবস ঢলিয়া পড়িল তমসাচ্ছন্ন রজনীর ক্রোড়ে, মনস্থির করিতে পারিল না গুলনার। জীবন বড় মধুর! প্রেমের স্নিগ্ধ মধুর স্মৃতিমঞ্জরীদল কোমলহস্তে শান্তিবারি সিঞ্চন করিয়া দগ্ধ চিত্তে প্রলেপন দিল। গুলনার গরলাধার গবাক্ষপথে গোমতীর গভীর জলে নিক্ষেপ করিয়া আসন হইতে উত্থিত হইল, অধরের মৃদু হাস্যরেখা কপোলের অশ্র়ুধারার সহিত মিলিত হইয়া গুলনারের রূপকে কিঞ্চিৎ অধিক মোহময়ী করিয়া তুলিল।

আনুমানিক দেড় শতাধিক বৎসর পরবর্তী কালে ভারতবর্ষের কলিকাতা নাম্নী মহানগরী হইতে এক আধুনিকা নগরিণী লক্ষ্ণৌতে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আগমন করিয়া বিস্মিত হইয়া লক্ষ্য করিল গলৌটি কাবাবের খুশবুতে আমোদিত, নূপুরনিক্কণে চমকিত, টাঙ্গা চালকের মেহদি রাঙা গুম্ফশশ্রুতে আবরিত লক্ষ্ণৌ নগরীর ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে  সকল কন্যার অধরে সেই আশ্চর্য আতরগন্ধী গোপন হাস্যরেখা, তাহাদের কি এক ব্যাখ্যাতীত অনামী সৌন্দর্যে ভূষিত করিয়াছে। 

"মেহরবা হো কে বুলা লো মুঝে চাহো যিস ওয়ক্ত

ম্যায় গয়া ওয়ক্ত নহী হু কি ফির আ ভি না সঁকু।"

কালচক্র ঘূর্ণিত হইতে থাকে, অতীতে বিলীন হয় বর্তমান, ভবিষ্যত গ্রাস করিয়া লয় বর্তমানকে। সাক্ষী রহে মহাকাল। (ক্রমশ)

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(http://www.theoffnews.com travel)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours