তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
বিশিষ্ট তাত্ত্বিক লেখক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আক্রমণকে মান্যতা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন “নালন্দার লাইব্রেরী কয়েকবার বিধ্বস্ত হয়। P. al. Jor-এর তিব্বতীয় পুস্তকে উল্লিখিত হয়েছে যে ধর্মর্সগন্ধ অর্থাৎ নালন্দার বৃহৎ লাইব্রেরী তিনটি মন্দিরে রথিত ছিল। তীর্থিক (ব্রাহ্মণ) ভি দের দ্বারা অগ্নিসংযােগে তাহা ধ্বংস করা হয়। মগধের রাজমন্ত্রী কুকুতসিদ্ধ নালন্দায় একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে ধর্মোপদেশ প্রদানকালে জনকতক তক্ষণ ভিক্ষু দু’জন তীর্থিক ভি দের গায়ে নােংরা জল নিক্ষেপ করে। তার ফলে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে ‘রত্নসাগর’, ‘রত্নধনুক’ আর নয় তলাযুক্ত ‘রত্নদধি’ নামক তিনটি মন্দির অগ্নিসংযােগে ধ্বংস করে। উক্ত তিনটি মন্দিরেই সমষ্টিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাগার ছিল।” (ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বাঙ্গলার ইতিহাস, চিরায়ত প্রকাশন, প্রথম পরিমার্জিত সংস্করণ, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ৮৬। আরও দেখুন- P. al. Jor.: History of the Rise, Progress and Downfall of Buddhism in India, Edited by S. Das, P. 92).
ষষ্ঠ শতকের রাজা মিহিরকুল বৌদ্ধদের সহ্য করতে পারতেন না। তিনি যখন পাটলিপুত্র আক্রমণ করেন তখন সম্ভবত নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এইচ হিরাস এ বিষয়ে লিখেছেন ‘Nalanda University was not far from the capital, Pataliputra and its fame had also reached Mihirakula’s ears. The buildings of Nalanda were then probably destroyed for the first time, and its priests and students dispersed and perhaps killed.’ (এইচ হিরাস, দ্য রয়েল পেট্রনস্ অফ দ্য ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা, জার্নাল অফ দ্য বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সােসাইটি, পার্ট-১, খণ্ড-১৪, ১৯২৮, পৃ. ৮-৯)। এরপর সপ্তম শতকের মাঝামাঝি মগধে সংঘটিত যুদ্ধবিগ্রহের শিকারও হতে পারে নালন্দা। ঐতিহাসিক এস এন সদাশিবন নালন্দা ধ্বংসের জন্য মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয়কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। (এস এন সদাশিবন, এ সােস্যাল হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, নিউদিল্লি, ২০০০, পৃ. ২০৯)। বুদ্ধ প্রকাশ তাঁর ‘অ্যাসপেক্ট অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন’ গ্রন্থে (আগ্রা, ১৯৬৫) নালন্দায় অগ্নি সংযােগের জন্য হিন্দুদেরই দায়ী করেছেন। অথচ এতদিন আমরা নালন্দা মহাবিহার ধ্বংসের জন্য মােহাম্মদ বখতিয়ার খিলজিকেই অভিযুক্ত করে এসেছি।
শুধু তাই নয়, ময়নামতী মহাবিহারও (অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার অন্তর্গত পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত ময়নামতী) ধ্বংস হয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে। নালন্দার মতাে এক্ষেত্রেও দায়ী করা হত মূলত মুসলিম আক্রণকারীদের। একাদশ শতকের শেষভাগে বৌদ্ধ চন্দ্রবংশ উৎখাত করে অবিভক্ত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্মণ রাজবংশ। এই বংশেরই অন্যতম শাসক ছিলেন জাতবর্মা। রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল সােমপুর মহাবিহারের প্রতি। তিনি অচিরেই বৌদ্ধবিহারটি আবদ্ধ এবং লুণ্ঠন করেন। অবশেষে অগ্নি সংযােগে মহাবিহারটি ধ্বংস করেন। (এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড-২১, বিপুলশ্রী মিত্রের নালন্দা তাম্রশাসন, পৃ. ৯৭)। ওই বিহারের মঠাধ্যক্ষ সুপণ্ডিত কক্ষণাশ্রী মিত্রকেও তিনি অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করেন। (এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড-২১, বিপুলশ্রী মিত্রের নালন্দা তাম্রশাসনের দ্বিতীয় পংক্তি দ্রষ্টব্য)। ভােজবর্মার বেলাবলিপি থেকেও জানা যায়, পরম বিষুক্ষভক্ত জাতবর্মা সােমপুরের মহাবিহার ধ্বংস করেছিলেন। বৌদ্ধ নিপীড়নের কিছু নমুনা প্রসঙ্গে বিখ্যাত সােমপুর মহাবিহার ধ্বংসের কথা নীহাররঞ্জন রায় এভাবে উল্লেখ করেছেন। “…ভারতীয় কোনও রাজা বা রাজবংশের পক্ষে পরধর্মবিরােধী হওয়া অস্বাভাবিক। এ যুক্তি অত্যন্ত আদর্শবাদী যুক্তি, বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি তাে নয়ই। অন্যকাল এবং ভারতবর্ষের অন্য প্রান্তের বা দেশখণ্ডের দৃষ্টান্ত আলােচনা করিয়া লাভ নাই প্রাচীনকালের বাঙলাদেশের কথাই বলি। বঙ্গাল-দেশের সৈন্য-সামন্তরা কি সােমপুর মহাবিহারে আগুন লাগায় নাই? বর্মণ রাজবংশের জনৈক প্রধান রাজকর্মচারী ভট্টভবদেব কি বৌদ্ধ পাষন্ড বৈতালিকদের উপর জাতক্রোধ ছিলেন না? সেন-রাজ বল্লাল সেন কি নাস্তিকদের (বৌদ্ধ) পদোচ্ছেদের জন্যই কলিযুগে জন্মলাভ করেন নাই?” (নীহাররঞ্জন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫০৬ ও পৃ. ৪১৯, ৩০২)।
সুলতানি আমলের কেন্দ্র ছিল ওই দিল্লিতে মুসলিমদের সংখ্যা সব চেয়ে কম ছিল। মোঘলদের সেনাপতি হিন্দু মান সিংহ ছিলেন, তেমনি রাজপুত এবং রানা প্রতাপের সেনাপতি ছিল মুসলিম। এইরকম অসংখ উদাহরণ আছে। মোঘল ও মোঘল বিরোধীদের যুদ্ধ হিন্দু মুসলিম লড়াই নয়, লড়াইটা সাম্রাজ্য বিস্তারে, ধর্মের লড়াই ছিলো না ফলে বলপূর্বক ধর্মান্তকরণের প্রশ্নই উঠে না। তবে ঔরঙ্গজেবের আমলে কিছু মানুষ জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। এটি একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ।মুসলমান শাসকরা জোর করে ধর্মান্তরণ করালে এই দেশে একজনও হিন্দু থাকতো না।
অনেকে বলেন, ইসলামি আক্রমণের পর সংস্কৃতের পতন হল, শাসকের দাপটে সবাই উর্দু, ফার্সি শিখতে ছুটল। বাজে কথা। আমাদের বাংলার নবদ্বীপ বা মিথিলা সংস্কৃত ন্যায় চর্চার কেন্দ্র হয়েছিল সুলতানি আমলে। দারাশিকো বেদান্ত পড়ছেন বারাণসীর পণ্ডিতদের কাছে। মুসলমান শাসকরা এ দেশে প্রায় বারোশো বছর রাজত্ব করেছিলেন। ওঁরা জোর করে ধর্মান্তর করালে এ দেশে একজনও হিন্দু থাকত না। ওঁদের উৎসাহ না থাকলে সংস্কৃতও টিকে থাকত না। ধর্মের সঙ্গে ভাষার উত্থানপতন গুলিয়ে তাই লাভ নেই। (সমাপ্ত)
(www.theoffnews.com - Nalanda University destroyed)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours