পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

রাজবাড়ির সুবিশাল গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই একরাশ বিরক্তি এবং না ভাল লাগা ঘিরে ধরল লহমায়। এ কি দশা? এ কোথায় এলাম ! যে রাজবাড়ির আনাচে কানাচে ইতিহাস কথা বলে, যে রাজবাড়ি ছিল সত্যজিৎ রায় মৃনাল সেনের অতি প্রিয়, সেই রাজবাড়ির আজ এ কি হাল? কথা হচ্ছে বীরভূমের হেতমপুর রাজবাড়ির। ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো সুবিশাল এই রাজবাড়ির বনেদিয়ানা সুবিখ্যাত। কিন্তু রাজবাড়ি চত্বরে পুরনো দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ি, চোরাই কয়লার স্তুপ, তার সেই কৌলিন্য এবং আভিজাত্যকে যেন ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই রাজবাড়িটির একাংশ বেসরকারি স্কুলকে ভাড়া দেওয়া, বাকি অংশ এবং সংলগ্ন জমিতেও একটি বেসরকারি বিএড কলেজ রয়েছে। তার পরেও রাজবাড়িটির বিশালত্ব তাকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ রাজবাড়ি চত্বরে একটি পুলিশ ক্যাম্প হওয়ার পরই দেখা দেয় এই সমস্যা। দুবরাজপুর থানার জায়গা কম হওয়ায় পুলিশের উদ্ধার করা বিভিন্ন চোরাই গাড়ি, দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ি জমা করে রাখা হয় ওই রাজবাড়ি চত্বরে। সেখানেই জায়গা পেয়েছে উদ্ধার হওয়া চোরাই কয়লাও। সব মিলিয়ে রাজবাড়ির সামনে এখন ভাঙা গাড়ির মেলা। 

হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, লোক-লস্কর— বীরভূমের হেতমপুর রাজবাড়ির বৈভব ছিল ষাটের দশকের আগে পর্যন্ত। হেতমপুর রাজ পরিবারের পূর্বপুরুষ মুরলিধর চক্রবর্তী সতেরো শতকের শেষের দিকে বাঁকুড়া জেলা থেকে বীরভূমে চলে আসেন। তিনি প্রথমে রাজনগরের মুসলিম জমিদারের অধীনে  চাকরিতে যোগ দেন।  তাঁর মৃত্যুর পর  বড়ো ছেলে চৈতন্যচরণ  মা আর ভাইকে নিয়ে হেতমপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। তখন দারিদ্র ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। চৈতন্যচরনের বড়ো ছেলে রাধানাথ চাকরি পান  হেতমপুরের  রায়বংশের জমিদারিতে। নিজের কর্মদক্ষতার প্রমাণ দিয়ে তিনি একটা সময়ে সেরেস্তার দায়িত্ব পান। আর্থিকভাবে ধনী হয়ে জমিদারির ইজারা কিনে সম্পত্তি বাড়াতে থাকেন।  একটা সময়ে তার প্রতিপত্তি রায়দেরও ছাড়িয়ে যায়।  এমনকি মুর্শিদাবাদের নবাবদের থেকেও তিনি কিছু মহল আর জমিদারি কেনেন। এই রাধানাথ চক্রবর্তীকেই হেতমপুর রাজ পরিবারের  প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা যায়।  তিনি বীরভূম রাজের ১৯ টি মৌজার ইজারা নিয়ে ক্রমে মুসলিম শাসন থেকে মুক্ত করেন। এই সময় তিনি রাজনগরের সাথে এক যুদ্ধ জয়ী হয়ে  বীরভূম এবং আশেপাশের অঞ্চলের স্বাধীন বাঙালি  রাজা হন। শেষ পর্যন্ত তিনি রায় পরিবারকে তাঁরই  বেতনভুক্ত করে তোলেন।  ১৮৩৮ সালে তাঁর  মৃত্যুর  সময় তাঁর সম্পত্তিগত  আয় ছিল ২০,০০০০ টাকা। এই রাধানাথেরই পৌত্র রামরঞ্জন। 

১৮৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে এই রামরঞ্জন চক্রবর্তী গরীব প্রজা এবং ব্রিটিশ সরকারকে নানাভাবে  সাহায্য  করেছিলেন। যার ফলে ১৮৮৫ সালে  ব্রিটিশ সরকার খুশি হয়ে  তাঁকে  ‘রাজা’ উপাধিতে  ভূষিত করেন।  দুই বছর পরে তাঁকে লর্ড লিটন  ‘রাজা বাহাদুরের’ পদে উন্নীত করেন। ১৯১২ সালে তিনি মহারাজার পদে উন্নীত হন। ১৯০৫ সালে রামরঞ্জন চক্রবর্তী রাজবাড়ি তৈরি করিয়েছিলেন। তাই এই  বাড়িটিকে  ‘রঞ্জন প্যালেস’  নামেও ডাকা হয়। ইংরেজ সরকারের সঙ্গে এই রাজপরিবারের সখ্যতা অবশ্য বেশ  পুরনো হলেও জানা যায় কাজী নজরুল ইসলাম বেশ কিছুদিন এই প্রাসাদেই আত্মগোপন করেছিলেন। যদিও কিছুদিন বাদে গুপ্তচর মারফত খবর পেয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। 

দুর্গের মতো দেখতে এই বিশাল প্রাসাদের  দরজার সংখ্যা ৯৯৯টি। মুর্শিদাবাদের নবাব হুমায়ুন জা-র তৈরি করা হাজারদুয়ারি প্রাসাদের সম্মান যাতে  অক্ষুন্ন থাকে, তার জন্য হাজারদুয়ারির থেকে একটা দরজা কম রাখা হয়েছিল এই বাড়িতে। তবে স্থানীয় লোকজনের মুখে এই প্রাসাদের নাম হয়েছিল ‘হেতমপুরের  হাজারদুয়ারি’। 

সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে যে রাজা গুপিকে গাধার পিঠে চাপিয়ে গ্রাম থেকে বার করে দিয়েছিলেন সেই রাজার  রাজবাড়ির সেট ছিল হেতমপুর প্রাসাদে। আরও অনেক বিখ্যাত ছবির শুটিং এখানে হয়েছে। সত্যজিতেরই ‘অভিযান’, মৃণাল সেনের ‘মৃগয়া’,  তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’, সন্দীপ রায়ের ‘গোঁসাইপুর সরগরম’, রাজা সেনের ‘দামু’-র এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

সেই রাজবাড়ির আজ এই হাল দেখে আমার মতই দুঃখিত এবং ক্ষুব্ধ স্থানীয়রাও। অবিলম্বে পুলিশ প্রশাসন এবং বীরভূমের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সকল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যাতে তারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবেন। রাজবাড়ির ভিতরে পর্যটকদের ঢোকার অধিকার নেই, কিন্তু বাইরে থেকেও অনেকেই তা দেখতে আসেন। যে অংশে যতটুকু প্রবেশ করা যায় তার প্রায় সবটাই এখন পরিত্যক্ত গাড়ির জঞ্জালে ভরে রয়েছে। যা শুধু দৃষ্টিকটুই নয়, দুঃখজনকও বটে।

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Hetampur rajbari)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours