পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা: 

তিনি গর্বিত তিনি হিন্দু। স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোতে তার ঐতিহাসিক ভাষণে দৃপ্ত স্বরে জানিয়েছিলেন এ কথা। তার প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনও হিন্দু সংগঠন হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু হঠাৎ রামকৃষ্ণ মিশন আদালতে দাবি করে তারা মোটেই হিন্দু সংগঠন নয়। তারা সংখ্যালঘু, রামকৃষ্ণের মত বা রামকৃষ্ণ ইজমে বিশ্বাসী। রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে তার শিক্ষকদের মতভেদ এবং সেই বিবাদের কারনে দায়ের হওয়া এক মামলার প্রেক্ষিতে তারা আদালতে হলফনামা জমা দিয়ে জানায় "শ্রী রামকৃষ্ণের ধর্ম হল হিন্দুদের থেকে আলাদা এবং আলাদা ধর্ম...রামকৃষ্ণবাদের আলাদা ঈশ্বর, আলাদা নাম, আলাদা মন্দির, আলাদা উপাসনা, আলাদা সম্প্রদায়, আলাদা সংগঠন এবং উপরে রয়েছে সব, একটি পৃথক দর্শন।" সন্দেহ নেই যে এই যুক্তিগুলি স্বামী বিবেকানন্দের রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের সঙ্গে মেলে না। তার ইচ্ছা ছিল "এমন একটি সংগঠন যা হিন্দুদের পারস্পরিক সাহায্য এবং উপলব্ধি শেখাবে।" কিন্তু আদালতে জেতার জন্য সেই হিন্দুত্বকে বিসর্জন দিতে এক মুহূর্তও ভাবেননি মিশনের মহারাজেরা।

অর্থাৎ কাজ হাসিলের জন্য যে কেউ যা খুশিই করতে পারেন আদর্শ এবং নীতির বাইরে গিয়ে। এই যেমন মুকুল রায় হঠাৎ ঘোষণা করেছেন তিনি বিজেপিতেই ছিলেন, আছেন। তিনি তৃণমূলে যোগ দেননি। কেন এই অদ্ভুত স্বীকারোক্তি? পিএসি কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে টিকে থাকার জন্য। বিরোধীদের দাবি, নিয়ম অনুযায়ী বিরোধী দল থেকেই পিএসির চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। কিন্তু, মুকুল রায় শাসক দলে থাকা সত্ত্বেও কেন তাকে চেয়ারম্যান করা হলো? সেই প্রেক্ষিতে স্পিকারের কাছে মুকুল রায়ের আইনজীবীরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, মুকুল রায় বিজেপিতেই ছিলেন এবং বিজেপিতেই রয়েছেন। একদিনের সৌজন্য সাক্ষাৎকে ধরে কোনও ভাবেই বলা যায় না যে তিনি বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। গলায় কোনও দলের উত্তরীয় পরার অর্থ এই নয় যে তিনি ওই দলের সদস্য। বিজেপিও মুকুল রায়কে সাসপেন্ড করেনি। সম্প্রতি বেশি কিছুদিন ধরে মুকুল রায় প্রকাশ্যে বিজেপির স্বপক্ষে কথা বলেছেন। তিনি বিভিন্ন সময় বলেছেন বিজেপি আগামীতে বিভিন্ন ভোটে বিপুল ভোটে জিতবে। কারণ বিজেপি বর্তমানে ভালো জায়গায় রয়েছে। এসব থেকেই স্পষ্ট, এখনও মুকুল রায় বিজেপিতেই রয়েছেন।

তাহলে ভাবুন। এখনও পর্যন্ত স্ট্যাম্প পেপারে লিখে রেজিস্ট্রি করে বা আদালতে হলফনামা দিয়ে তো কেউ কোনও পার্টিতে যোগ দেননি। চেনা প্রথা মেনেই জানুয়ারি মাসেই মুকুল তৃণমূল ভবনে গিয়ে ফের তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তার গলায় তৃণমূলের উত্তরীয় পরিয়ে দেন। এর পরে মুকুলের অনুগামী বিভিন্ন নেতা কর্মী যারা বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন তারাও একে একে তৃণমূলে যোগ দেন মুকুলের হাত ধরেই। যদিও মুকুল দলবদল করলেও বিজেপির ঘোরেই ছিলেন। কারণ কখনও কৃষ্ণনগর, কখনও বোলপুরে তাকে তৃণমূলের মঞ্চ থেকেই নির্বাচনে বিজেপির জয়গান গাইতে শোনা যায়। অস্বস্তিতে পড়ে তৃণমূলের স্থানীয় নেতা কর্মীরা ভুল শুধরে দিলেও মুকুল বার বার একই ভুল করেছেন। এটাও বলেছেন যে “ভারতীয় জনতা পার্টি মানেই তৃণমূল”। তবে এবার আর ভুল করে নয়, আইনজীবীদের দিয়ে কাগজে কলমেই তিনি জানিয়েছেন তিনি বিজেপিতেই আছেন। যদিও বিজেপি নেতৃত্ব তার এই কথায় মোটেও ভুলতে নারাজ। তারাও লড়বার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। 

এবার তৃণমূল কি করবে? আমরা জানি রাজনীতিতে নীতির কোনও স্থান নেই। তাই শুধুমাত্র টিকে থাকার কারনেই মুকুল হেরো পার্টি ছেড়ে জেতা পার্টিতে ফের নাম লিখিয়েছিলেন। জেতা পার্টিও বুড়ো ঘোড়াকে নিয়ে রেখেছিল রিজার্ভ বেঞ্চে। তার অসংলগ্ন বক্তব্যকে মানসিক ভারসাম্যের সমস্যা বলে অভিহিত করেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু এবার? তৃণমূলে এটা নতুন নয়, একটু ব্যক্তিগত আক্রমণ করে এর সঙ্গে তৃণমূলের এক অভিনেত্রী সাংসদের সাদৃশ্য টানা যেতেই পারে। টিভিতে খবরের কাগজে টানা মাস দেড়েক ধরে সেই সাংসদের বিয়ের কেনাকাটা, বিয়ের আসর, বিয়ের পরে কলকাতায় রিসেপশন, সেখানে উপস্থিত কাঁড়ি কাঁড়ি সেলিব্রিটিদের হাসিমুখের ছবি, হানিমুনের ছবি সবই দেখলেন। তার কয়েক মাস পরে শুনলেন ওটা নাকি বিয়েই ছিল না। এখানেও তেমনই মুকুল রায়ের সপুত্র তৃণমূলে যোগ দেওয়ার ছবি, তাকে মালা পরিয়ে হাতে পতাকা ধরিয়ে বরণ করে নেওয়ার ছবি দেখলেন। তৃণমূলের বিভিন্ন সভা সমিতিতে মঞ্চে তাঁকে দেখা গেল, তিনি ভাষণ দিলেন। এরপরে হঠাৎ শুনলেন তিনি নাকি তৃণমূলে যোগ দেননি। কেমন লাগছে? নিজেকেই কেমন অশুচি, পাপগ্রস্ত মনে হচ্ছে না? যে নেতা নেত্রীদের চোখের সামনে নির্লজ্জতার শেষ সীমায় ডুবে যেতে দেখছেন তাদের তো লজ্জা ঘেন্না ভয়, তিন থাকতে নয়। তাই আমাদেরই লজ্জিত হওয়ার কথা এরা আমাদের নেতা অথবা এদের আমরাই নেতা বানিয়েছি ভেবে।

(www.theoffnews.com - Ramkrishna mission West Bengal politics Mukul Roy Nusrat Jahan BJP TMC)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours