তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

মোঘলদেরও আগে মুসলিমরা কি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করেছিল আর মুসলিম আমলে কি বলপূর্বক হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল?

ইতিহাস বলছে বখতিয়ার খিলজি নালন্দা ধ্বংস করেনি। নালন্দা ধংসের কারণ হলো গোড়া হিন্দু ও বুদ্ধবাদীদের সংঘর্ষের ফল শ্রুতি। বিহারে অবস্থিত নালন্দা কিন্তু হিন্দুদের কোন মানমন্দির নয়, এটি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে বৌদ্ধদের দ্বারা, এটা পরিচালিতও হতো বৌদ্ধদের দ্বারা।

নালন্দা মোট তিনবার আক্রান্ত হয়। প্রথম আক্রমণের শিকার হয় প্রতিষ্ঠার একশত বছরের মধ্যে হুনদের দ্বারা। দ্বিতীয় আক্রমণের শিকার হয় হিন্দুদের মহারাজা শশাঙ্কের হাতে। ঐতিহাসিক ডিডি গোস্বামী এ সম্পর্কে বলেন, সর্বপ্রথম এই মহাবিহারের উপর আক্রমণ আসে শশাঙ্ক নরেন্দ্রগুপ্তের দ্বারা। তার বৌদ্ধ বিদ্বেষ এতোটাই তীব্র ছিল যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে এসে গাঙ্গেয় উপদ্বীপ দখল বৌদ্ধ অনুরুক্ত হর্ষবর্ধনকে হত্যার করার পর বোধিবৃক্ষকে উপড়ে নদীতে ফেলে দেন, বৌদ্ধের পদচিহ্ন ধ্বংস করেন। নালন্দার প্রভূত ক্ষতি সাধন করেন তিনি, চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ্গের আগমনের সময়ও নালন্দা তার দৈন্যদশা থেকে বের হতে পারেনি। তৃতীয় আক্রমণ হয় এক বহিঃশত্রু দ্বারা ১১৯৩ সালে, এই সময় নালন্দা পুরোপুরি ভস্মীভূত করা হয়। এই আক্রমণের সময়কাল নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।

এখন আসুন, খিলজির দিকে ফিরে যাই। হিন্দু রাজঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের ভাষায়, খিলজি হিন্দুস্থানে আসেন ১১৯৫ সালে, হুসাম উদ্দীনের কাছে কাজ পান ১১৯৬ সালে, উদন্তপুরী বিহার আক্রমণ করেন ১১৯৯ সালে, ইরফান হাবিবের ভাষ্যমতে ১১৯৯ সালে দক্ষিণ বিহারে অভিযান চালিয়ে খিলজি গোবিন্দপালকে পরাজিত করেন। নালন্দা থেকে এর দূরত্ব প্রায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার, তাবাকাতে নাসিরিতে যে টিকিওয়ালা ব্রাহ্মণদের হত্যা এবং মন্দির ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে, এটি হচ্ছে মূলত বৌদ্ধদের এই উদন্তপুরী বিহার, খিলজি দূর্গ ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে এটি আক্রমণ করেন, যা ছিল লক্ষণসেনেরই চাল।

যদুনাথ সরকারের মতে খিলজির বাংলা আক্রমণ ছিল ১২০১ সালে।এখানে সবচেয়ে মজার বিষয়টি হচ্ছে সকল ঐতিহাসিকের দাবি অনুযায়ী খিলজি বঙ্গবিজয় করেন ১২০৪ সালের ১০ ই মে। অন্যদিকে অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয় ১১৯৩ সালে। যে লোকটি বাংলায় আসেন ১২০৪ সালে, সে কি করে ১১৯৩ সালে নালন্দা ধ্বংস করলো তা ইতিহাস বিকৃতিকারীরাই ভালো বলতে পারবে। ১১৯৩ সালে নালন্দা যার হাতে ধ্বংস হয়েছিল তিনি হচ্ছেন তীরহুতের হিন্দু রাজা অর্জুন।

বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের জন্য বখতিয়ার খিলজিকে নির্মম আক্রমণকে দায়ী করা হয়। এ তথ্য সর্বাংশে সত্য নয়। তবে এই আলােচনায় প্রবেশের পূর্বে আমরা নালন্দার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরতে পারি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদানের ভিত্তি বিশ্লেষণ করে নালন্দার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দী থেকে। তখন নালন্দা ছিল একটি সমৃদ্ধ শহর। কিন্তু নালন্দার অবস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকেরা সহমত হতে পারেননি। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে পার্শ্ববর্তী অনেক স্থানের সঙ্গে নালন্দাকে সনাক্ত করেছেন ঐতিহাসিকেরা। কিন্তু এইসব তথ্য প্রমাণ থেকে নালন্দার সঠিক সনাক্তকরণ সহজসাধ্য নয়। কারণ অনেক তথ্যই পরস্পর বিরােধী। তবে পালি বৌদ্ধ সাহিত্য ও জৈন উপাদান থেকে নালন্দার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সে নালন্দা এবং বর্তমান নালন্দা মােটামুটিভাবে একই, যা কিনা বিহার রাজ্যের রাজগীর শহরের উপকরণ। 

বৌদ্ধ সংঘের সংস্কৃত বা পালি প্রতিশব্দ হল বিহার, যার প্রকৃত অর্থ বৌদ্ধদের আশ্রয়স্থল। এইসব বিহারের অনেকগুলি পরবর্তীকালে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, তার মধ্যে কয়েকটি আবার বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল, যেমন নালন্দা। এই নালন্দার উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। কারণ ফা-হিয়েন যখন নালন্দাতে আসেন, তখন সেখানে কোনাে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না (বি এন মিশ্র, নালন্দা সাের্সের্স অ্যান্ড ব্যাক গ্রাউন্ড, খণ্ড-১, বি আর পাবলিশিং কর্পোরেশন, ১৯৯৮, পৃ. ১৮১)। গুপ্ত যুগে নালন্দা বিহার থেকে মহাবিহারে রূপান্তরিত হয়েছিল মূলত রাজকীয় অনুদানের দ্বারাই। আর কোনাে মহাবিহার নালন্দার মত রাজকীয় অনুদান পায়নি। কারণ নালন্দা ছিল বিশ্বমানের শিক্ষাক্ষেত্র। পাল রাজারাও ছিলেন নালন্দার পৃষ্ঠপােষক। পাল শাসনকালেই নালন্দা খ্যাতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল। এই পাল রাজারা ছিলেন মহাযান বৌদ্ধধর্মের অনুসারী আর নালন্দা ছিল তাঁদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র, যার ফলে তাঁরা মুক্তহস্তে নালন্দাতে দান করেছিলেন। সেই সময় নালন্দাতে ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা আসতাে, যারা জ্ঞানার্জনের শেষে প্রচুর আর্থিক সাহায্য নালন্দাকে দিয়ে যেত—নালন্দার সমৃদ্ধির এটাও একটা অন্যতম প্রধান কারণ বলা যেতে পারে। এখানে প্রায় ১০,০০০ ছাত্র বসবাস করত ও অধ্যায়ন করত। (নালন্দা উৎখননের ফলে যে বাড়িগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে দশ হাজার ছাত্রের থাকার ব্যবস্থাকে সমর্থন করা যায় না। ৬৭০ সালে ইৎ-সিং নামে অপর এক চীনা পরিব্রাজক নালন্দা পরিদর্শন করেন। তার মতে, এখানে তিন হাজার ছাত্র থাকত। ইৎ-সিং এর বক্তব্যই বেশি সমর্থনযােগ্য ও যুক্তিসম্মত বলে মনে করেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা (দেখুন- রামশরণ শর্মা, ভারতের প্রাচীন অতীত, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসােয়ান, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ, ২০১১, পৃ. ২৬৭)। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ স্বয়ং নালন্দার অধ্যক্ষ শীলভদ্রের কাছে পড়াশুনাে করতেন। তাঁর মতে, ভারতে তখন হাজার হাজার শিক্ষাকেন্দ্র ছিল কিন্তু শিক্ষণীয় বিষয়ের বৈচিত্র্য, শিক্ষা পদ্ধতির উৎকর্ষে ও বিশালত্বে নালন্দার স্থান ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ। (আর সি মজুমদার, এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া, দিল্লি, ১৯৭৪, পৃ. ৪৫২-৫৪)। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Nalanda University destroyed)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours