তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
কলিকাতার ইতিহাসে নিমতলা ঘাট স্ট্রীট একটি বহুল প্রচারিত নাম।. ..
সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি ছিল নিমতলা ঘাট স্ট্রীট। এই রাজ পথটির সাথে নিমতলা শ্মশান এর একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে। উত্তর কলকাতার অধিকাংশের হিন্দুর মহা নিস্ক্রমনের অন্তিম যাত্রা এই পথ দিয়ে নিমতলা মহাশ্মশানে এসে পৌছায়। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই রাজপথটি হল সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চশিক্ষার একটি উজ্জ্বল দীপশিখা ডাফ সাহেব একদিন এই পথের ধারে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন~ সেইদিনের ডাফ কলেজ আজকের স্কটিশ চার্চ কলেজ রূপে বন্দিত। ধর্ম-সংস্কৃতির এক আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছে এই রাজপথটির ধারে মুসলিম মসজিদের দুই পাশেই রয়েছে হিন্দু মন্দির- মহম্মদ রমজানের নিয়ামতুল্লা ঘাট মসজিদের এক পাশে মা আনন্দময়ীর মন্দির, অন্যপাশে আছে মদন দত্ত-এর পুত্রদের প্রতিষ্ঠিত দুর্গেশ্বর মন্দির। হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সহমর্মিতার ইতিহাসে এটি একটি গৌরবজ্জ্বল নিদর্শন। সেকালের কলিকাতার বিশিষ্ট জ্ঞানীগুণী ধনী ব্যক্তিরা বাস ভবন নির্মাণ করেছিলেন নিমতলা ঘাট স্ট্রীটের দু’পারে। এরা হলেন মদন দত্ত, কাশীনাথ দত্ত, প্রাণকৃষ্ণ সেন, জয়নারায়ণ কবিরাজ প্রমুখ। কথিত আছে মথুর সেনের প্রাসাদ ছিল সেকালের কলিকাতার দর্শনীয় বস্তুগুলির অন্যতম। ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র রূপেও নিমতলা ঘাটের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল— বহু লবণ গােলা ও কাঠের গোলা থাকায় এর গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।
নিমতলা ঘাট স্ট্রীট ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সুতানুটি গ্রামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন নিমতলা ঘাট স্ট্রীট জোড়াবাগান স্ট্রীট বলে পরিচিত ছিল। সে সময় এই পথটি সম্পূর্ণ খােলা হল না। সরল গ্রাম্য চেহারা ছিল এই পথটির ছােট ছােট পুকুর, মধ্যে মধ্যে কাঁচা রাস্তা, খানিকটা মাঠ, খানিকটা চাষের জমি আবার কোথাও বা পথ, কোথাও বা বাগান– এইভাবে দেখানাে আছে আর্মির ম্যাপে। বেলি সাহেবের ম্যাপটি প্রকাশিত হয় ১৭৮২ খ্রীস্টাব্দে। এই ম্যাপে রাস্তাটি গঙ্গাতীর থেকে চিৎপুর রােড পর্যন্ত সরলরেখায় দেখানাে হয়েছিল এবং জোড়াবাগান স্ট্রীট নামে নামাঙ্কিত ছিল। এর পশ্চিম সীমার ঘাটের নাম ছিল জোড়াবাগান ঘাট, নিমতলার ঘাট তার অনেকটা উত্তরে ছিল। জোড়াবাগান ঘাটে শবদাহ হত।
১৬৮৬ সালে জব চার্নক হুগলি থেকে বিতাড়িত হয়ে শ্মশান কালি বা আনন্দময়ীর আশেপাশে অবস্থিত একটি নিম গাছের নিচে বাস করেছিলেন। জব চার্নকের বৈঠকখানা প্রসঙ্গে কটন সাহেব লিখেছেন,"he was wont to seat, and smoke a meditative hookah under the shade of a reading perpol tror which too at the junction of what is now Bow Bazar Street and lower Circular Roed. The cor went by the name of Boysconnah (bonak-khana) or resting place, and for a continued to be a favourite rendezvous. The historic tree was removed by the Marquess of Hastings in 1820, in pursuance of his schemes for the improvement of the city,” অর্থাৎ একটি ছায়াঘন পিপুল বৃক্ষের তলায় বসে জব চার্নক মৌজ করে তামাক সেবন করতেন। স্থানটি বৈঠকখানা অথবা বিশ্রামের স্থানরূপে পরিচিতি লাভ করেছিল এবং বহু বছর ধরে এটি একটি বিশিষ্ট আড্ডাখানা বলে চিহ্নিত হয়েছিল। ১৮২০ সালে মারকুইস অফ হেস্টিংসের নগর উন্নয়নের পরিকল্পনা কার্যকর করার সময় এই গাছটি কাটা পড়ে যায়। কটন সাহেবের মতে ওই বটগাছটার জন্য বৌবাজার স্ট্রিটের পূর্ব নাম ছিল বৈঠক খানা স্ট্রীট। আর একটি মত হল জোব চার্নক চিৎপুর রােডের ধারে এক বৃহৎ বটবৃক্ষের তলায় বসতেন বলেই সেই কারণে ওই অঞ্চলের নাম হয়েছিল বটতলা।
শ্রদ্ধেয় রাধারমণ মিত্র কিন্তু অন্যমত পােষণ করেন। তিনি লিখেছেন, “সব চমক একটি প্রকাণ্ড নিমগাছের তলায় বসতেন— যে নিমগাছ থেকে নিমতলা, “এই great tree’ই হচ্ছে ঐতিহাসিকদের মতে সেই নিমগাছ। এই গাছটা ১৮৭৯-৮০ সালে আগুন লেগে পুড়ে যায়। নিমতলার আনন্দময়ী কালীর মন্দিরের কাছেই এই নিম গাছটি ছিল। তারই কিছু উত্তরে জোব চার্নক জাহাজ থেকে নেমেছিলেন।” সে যাই হােক, ওই অঞ্চলে নিমগাছের অস্তিত্ব থেকেই নিমতলা ঘাট ও নিমতলা ঘাট স্ট্রীট নামাঙ্কিত হয়েছে সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। এই নতুন শ্মশানে শবদাহ শুরু হয় ১৮২৮ সালে। ২১ মার্চ ১৮২৮ সালের তিমির নামক পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এর পাশাপাশি বলতে হয় জগন্নাথ ঘাটের কথা নিমতলা তলা ঘাট থেকে মাত্র সাত মিনিটের দূরত্ব। এগুলি নিছক ঘাট নয়, শহর কলকাতার ইতিহাস জড়িয়ে আছে এখানে। তেমনই দু’টি ঘাট জগন্নাথ ঘাট ও নিমতলা ঘাট। ঐতিহ্যমণ্ডিত এই ঘাটগুলো যেন ইতিহাসের পটচিত্র।
চারিদিকে শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি। সারা ঘাট জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকশো মানুষ। তাঁদের চোখ গঙ্গার জলে, যেখানে এক মধ্য চল্লিশের যুবক সদলবল স্নান করতে নেমেছেন। তাঁরা ডুব দিলেন। মধ্যমণি যুবকের বড় বড় চুল ছড়িয়ে রয়েছে জলের উপর। এক সময় তাঁরা উঠে দাঁড়ালেন। আরও জোরে সম্মিলিত শাঁখ বেজে উঠল। যুবকটি গেয়ে উঠলেন, “বাংলার মাটি, বাংলার জল/বাংলার বায়ু, বাংলার ফল/ পুণ্য হউক, পুন্য হউক..”। সকলে তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Kolkata Nimtala Ghat Street)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours