চন্দ্রিমা দত্ত (সাঁজবাতি), লেখিকা ও শিক্ষিকা, শ্রীরামপুর, হুগলি:
কত শতকের আলো গুটিয়ে গেছে, উজ্জ্বল হয়েছে ছায়া। পৃথিবীর আদিমতম শিল্পী - এক গুহামানব, তার ঈষৎ নুয়ে পড়া শক্তিশালী জেদী চেহারা নিয়ে খুঁজে খুঁজে কাঠকয়লা আর চর্বির পোড়া তেল মিশিয়ে বানিয়েছিলেন রং। তা দিয়ে এঁকে ফেলেছিলেন কি ভয়ানক এক তেজী ষাঁড়কে। যার বাঁকানো ধনুকের মতো শরীর, সর্বভার বহন করা শিঙের চুড়ো। প্রতিকৃতির চেহারা দেখেই অনুভব করা যায় তার ভয়ঙ্কর তীব্র গতির কথা! আমরা দেখেছি ইতিহাস বইয়ের পাতায়।
সেই শব্দময় ছবি দেখে আমরা ভেবেছি বিজয়োল্লাস। কিংবা মনে হচ্ছে মানুষের প্রতি তার অসম্ভব অবজ্ঞা! কিন্তু, তা তো পরাজয়ের আর্তনাদও হতে পারে। অথবা সেই আদিশিল্পী হয়তো জন্তুটির মধ্যে নিজের রাগ বা ক্ষোভের কথা লিখে দিয়েছেন, যা দৃশ্যমান না! কত কথা বলে যায় একটা ছবি! গভীরে কান পাতলেই শোনা যায় শব্দ।
তাই বোধহয় সভ্যতার আরো অনেক অনেক ধাপ পেরিয়ে ছবি আরো বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে! সৃষ্টি হয়েছে ভাষার বুনিয়াদ - যা মানুষের আলোছায়াময় মনের প্রবনতা।
বহু খন্ডে বিভক্ত বহু ধারায় প্রবাহিত সেই আলোছায়াময় মন তৈরি করেছে বর্ণের প্রবাহ। সেই প্রবাহের কিন্তু নাশ নেই। ছবি, গান, সুর, কবিতা, গল্পকে আধার করে আত্মার অবিনশ্বর বর্ণচ্ছটা চিরকালীন বাঙ্ময় রূপ হয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছে স্পন্দনের নীরবতার গর্ভে। সে স্পন্দন মননের। সে স্পন্দন বর্ণসমৃদ্ধ শিল্পীমনের।
বর্ণ শব্দটিই তো বিস্ময়কর! আমরা রংকে বর্ণ বলি, আবার ধ্বনির লিখিত রূপও তো বর্ণ। শব্দকে রেখায় বাঁধো (কবিতা / গান) বর্ণ পাবে। শব্দকে রেখায় বর্ণিত করো (ছবি) বর্ণ পাবে। শব্দকে নদীসাগরের ঢেউ, বৃষ্টির ছন্দ, বাতাসের ফিসফিস, পাখির কুজন ইত্যাদিতে বেঁধে সুরের চিত্রকল্প করো - বর্ণই পাবে ।
আজও তো ধুলো ধোঁয়া অ্যাসিডরেন ভরা জীবনে নববর্ষার আগমনীতে মন বলে ওঠে "পূর্ব দিকের মেঘ ইস্পাতের মতো কালো। পশ্চিম দিকের মেঘ ঘননীল" শৈশবের বর্ণময় কল্পলৌকিক ইশারায়।
বর্ণের জাত নেই। যদি থেকেও থাকে, তাহলে শিল্পীর বর্ণ বৈষ্ণব জাতের। তা নাহলে বিশ্বের সেরা সেরা শিল্পী, কবিগণ বিনয়ী মাটির মানুষ হবেন কেন! তা না হলে বাংলার লোকশিল্পের প্রধান কারক বর্ণ গৈরিক আর শ্যামনীল হবে কেন! তা নাহলে ভারতীয় রাগাশ্রয়ী গানের নব্বই শতাংশ বন্দীশ - রাধা কৃষ্ণকে নিয়ে হবে কেন! এই কথা গুলো কি খুব অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে? হতেই পারে। কিন্তু আমি জাতের কথা উল্লেখ করলাম এই কারণেই যে - জাতশিল্পীর মনের বর্ণ গৈরিকই। অন্তরে সন্ন্যাসী যিনি, তিনিই তো পারেন মনের অনুভূতির বর্ণদের এক এক করে খুলে দিতে তাঁর সৃষ্টিতে! সবই তো ছবি!
সেই গুহামানব শিল্পীটি ছবি আঁকতে চাননি! বলতে চেয়েছিলেন নিজের জেদ ও জীবনযাপন। পদাবলী চর্যাপদের কাব্যকাহিনীকারেরাও ছবি এঁকে গেছেন আনন্দ বিরহ সাধনার... শব্দভান্ডারকে আশ্রয় করে। কাহিনীকার গীতিকার সুরকার ভাস্করেরাও তাই। সেই সব বর্ণমালা অনুভূতি ও মননের একেক রঙকে অবলম্বন করে পৌঁছে যায় অভীষ্টে...
সে এক চিরকালীন বর্ণময় অধিবাস।
(www.theoffnews.com - Art alphabet)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours