দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:

ক্ষুদে দাদু জানে আলম পৌষ মেলার কৌলিন‍্য টোকা ছড়ি নিয়ে এসেছিলেন একষট্টি সাল কি তার পর। সেটা ছিল পৌষ মেলার উদ্বোধনীর দিন। তখন দুই কি তিন দিনের মেলা হত মন্দিরের কাছে। আজ কত বছর পর ভুবন ডাঙার ডাকবাংলো মাঠে নাতি হাজির মেলার সেই কৌলিন‍্য, মাথার টোকা নিয়ে। ঘটনার অদ্ভুত সমাপতন। 

ডাকবাংলোর মাঠের মেলায় মোতালেব মোল্লা বলেন, বাবার কাছে শুনেছি, দাদুর হাতের তৈরী মাথার টোকা আর ছড়ি দিয়ে সেবছর শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলার উদ্বোধন হয়েছিল। আজ এত বছর পরেও ডাকবাংলো মাঠে এই মেলার উদ্বোধনে নিজের হাতে তৈরী তালপাতার টোকা নিয়ে আমি হাজির।

আলাপচারিতায় জানা গেল, মোতালেব মোল্লার খুব অভাবের সংসার। মা একমাস আগে গত হয়েছেন। তিন মেয়ে সানিয়া, আফরিন ও আলিয়া এবং স্ত্রী জহোরা বিবিকে নিয়ে তার ছোট্ট সংসার। মেয়েদের বয়স যথাক্রমে তেরো, আট ও তিন। বাড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ডায়ামণ্ড হারবার। একই থানার কবিরা গ্রাম থেকে তালপাতা সংগ্রহ করেন। স্ত্রী জহোরা বিবি ও নিজে মিলে তৈরী করেন তালপাতার টুপি। যাকে শান্তিনিকেতনে সবার কাছে টোকা নামেই চেনে। মোতালেব বলেন, দৈনিক একজন ছ'টা টোকা বানাতে পারে। কাঁচা তালপাতা গাছ থেকে পেড়ে একদিন শুকোতে হয়। তারপর সুতো দিয়ে সেলাই করে টোকা বানানো হয়। তারপর রঙ করা হয়। এক একটি টোকার দাম চল্লিশ থেকে ষাট টাকা। গোটা দিনের আয় আড়াইশো থেকে  তিনশো টাকা। তিন তিনটে মেয়ের পড়াশোনা ও সবার খোরাকিতে সংসার চলে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিদি সবার কথা ভাবে। আমার আবেদন তার কাছেই। তিনি গরীবের মা বাপ। যদি কিছু হয়। 

মোতালেব মোল্লারা আটজন এসেছেন ডায়মণ্ড হারবার থেকেই। ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাই ফুটপাতে ব‍্যবসা। তিনি জানান, মেলায় দৈনিক তিনশো আয়। খোরাকি বাবদ ব‍্যয় দুশো টাকা। হাতে থাকে একশো। তাঁর অভিযোগ, শান্তিনিকেতনে মেলা হলে ভালো হতো। সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর সামনে এর থেকে বেশী টোকা বিক্রি হয়ে ছিল আগে। নাম না জানলেও, এটা জানেন, শান্তিনিকেতনের ভিসি মেলা হতে দেননি। তিনি বলেন, খুব খারাপ করেছেন উনি। একই সুর মেলায় আসা তাঁর প্রতিবেশী সাবিনা বিবি ও বড় দিদি জুবেরা বেওয়ার মুখে। তাঁরাও এসেছেন মেলায় টোকা, তালপাতার তৈরী ফুলের সাজি বিক্রি করতে। একইভাবে উপাচার্য বিদ‍্যুৎ চক্রবর্তীকে দায়ী করেন ছড়ি বিক্রেতা আমিনুল হোদা। তাঁর বাড়ি বোলপুর পুরসভার ষোলো নং ওয়ার্ডে। তিনি কবিগুরু হস্তশিল্প উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক। প্রতি ছড়ির দাম চল্লিশ থেকে ষাট টাকার মধ‍্যে। 

যদিও ‘আমরা ‘সবাই’ চলতি হাওয়ার পহ্নী’। কিন্তু সব হারালেও, আমরা ঐতিহ্য হারাইনি। শান্তিনিকেতনের মেলায় তাই আজও পাওয়া যায়, টোকা ও ছড়ি। যা ছিল শান্তিনিকেতনের মেলা ফেরত আসার একমাত্র নিশান। শান্তিনিকেতনের মেলার কৌলিন্য হল টোকা আর ছড়ি। যার হাতে ছড়ি আর মাথায় তালপাতার টোকা। তাকে দেখে বোঝা যেত সে শান্তিনিকেতনের মেলা থেকে এসেছে। আগে আসে পাশের গ্রামের লোকেরা এই টোকা আর ছড়ি বানিয়ে এই মেলায় বিক্রি করতে আসত। সেই তালপাতার টোকা সারা বছর ব্যবহার করত আশ্রমিক থেকে এলাকার অনেকেই। যে কোন গ্রীষ্মের দুপুরে শান্তিনিকেতনের খোয়াই পথ ধরে মাথায় এই টোকা নিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখা যায় অনেককেই। এর ব্যতিক্রম ঘটেনি নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন বা প্রবীন আশ্রমিক সৌমেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও। সকলের মাথায় শোভা পায় এই টোকা। শান্তিনিকেতনের ব্যাগের সঙ্গে টোকা আর ছড়ি পৌষ মেলা তথা শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য। মুর্শিদাবাদের এক পর্যটক জানালেন, শান্তিনিকেতন মেলার বিশেষ ঐতিহ্য টোকা আর ছড়ি। এই মেলায় সেটা তা হাতে পেয়ে বেশ আনন্দ পেয়েছি”। প্রবীন আশ্রমিক সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “শান্তিনিকেতনের মেলার কৌলীন্যই টোকা ও ছড়ি"।

(www.theoffnews.com - Shantiniketan fair)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours