পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

ভর্তি ক্লাস রুম, থুড়ি সভাঘর। কড়া দিদিমণির সামনে থরহরি কম্পমান ছাত্রছাত্রী। কি যে হয়… কি যে বলবেন… মুখ শুকনো করে দুরুদুরু বক্ষে বসে আছেন সকলে। এক এক জনের নাম ধরে দিদিমণি ডাকেন তার মুখটি তখন দেখার মত হয়। এ ছবি কোনও স্কুলের নয়, এ ছবি দেখা যায় প্রায়শই আমাদের রাজ্যে হওয়া প্রশাসনিক সভার নামে এক প্রহসনে। দিদিমণির ভূমিকায় বলাই বাহুল্য একজনই। সামনের অনুগত ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু স্কুল পড়ুয়া নন, মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, সভাধিপতি, বড় বড় আমলা, পুলিশ আধিকারিক থেকে শুরু করে পুরসভার পুরপ্রধান, নিদেন পক্ষে পঞ্চায়েত প্রধান। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা যতই ডাকসাইটে হোন না কেন এখানে কিন্তু বাধ্য ছাত্র। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান খোঁজ নেন সকল কাজের, খতিয়ান নেন সাফল্যের। উন্নয়নের মাপকাঠি না পেরোলেই চাপ আছে। 

এ পর্যন্ত পড়ে খুশিই হওয়ার কথা। আমিও বেশ খুশিই হয়েছিলাম যখন ২০১১ সালে নির্বাচনে জিতে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শুধু কলকাতায় ঠাণ্ডাঘরে বসে নয়, রাজ্য চালাবেন জেলায় জেলায় গিয়ে। মনে হয়েছিল এবার বুঝবে জেলার ঘুষ খাওয়া আমলারা, এবার শায়েস্তা হবে রাজনীতি করে গাড়ি বাড়ি হাঁকানো নেতারা। এবার কাজ হবে হাতে হাতে। কদিন যেতে না যেতেই বোঝা গেল এসবই নতুন বোতলে পুরনো মদের মত। হাঁক ডাকই সার, কাজের কাজ কিছুই হওয়ার নয়। তবে একথা তো প্রকাশ্যে বলা যাবে না। কারন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান তো বলেই দিয়েছেন যে আমাদের রাজ্যে উন্নয়নের সব কাজ শেষ। এখন যা হচ্ছে বা যা পাচ্ছি সবই নাকি উদ্বৃত্ত। তাই তো কোনও প্রশাসনিক সভাতেই তিনি আর কাউকে কিছু চাইতে দেন না। এই তো সেদিন, একজন বিধায়ক তার এলাকায় একটি কলেজ করে দেওয়ার অনুরোধ জানাতে উঠেছিলেন। এই অনুরোধ করা মাত্রই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রচুর অপমান করে সাফ জানিয়ে দিলেন প্রচুর কাজ হয়েছে, এর পরেও কেউ কিছু চাইলে আর প্রশাসনিক সভাতে তিনি ডাকবেন না। বুঝুন ঠেলা। আমার এলাকার সুখ, দুঃখ, চাহিদা, প্রয়োজনের কথা যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই তো বিধায়ককে নির্বাচিত করা। তা তিনি যদি তার এলাকার মানুষের স্বার্থে কিছু চেয়ে থাকেন সেই দোষে তাকে নাকি পরের সভাতে ডাকাই হবে না। এর পরে কোন বিধায়কের বুকের পাটা আছে তিনি কিছু চাইবেন। আসলে মুখ্যমন্ত্রীর ধারণা, না না ধারণা বলব কেন, বিশ্বাস। মুখ্যমন্ত্রীর বিশ্বাস তিনি তার রাজ্যের সব কিছুই জানেন, কার কি দুঃখ, কার কি চাহিদা, কার কি কষ্ট, সে সবই তাঁর জানা। তিনি নিজেই বুঝে নিতে পারেন, কারও চাওয়ার দরকার নেই।

সত্যিই কি পারেন? কই গোবরডাঙার মানুষের কষ্ট তো তিনি এতদিনেও বুঝে উঠতে পারেন নি। গোবরডাঙার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে একটা হাসপাতাল দাবি করে আসছে। বাম আমলে তাদের অপদার্থতার জন্য গোবরডাঙায় থাকা হাসপাতালটি দেহ রেখেছিল। অথচ সেই হাসপাতালের জন্য পরিকাঠামো রেডি। আউটডোর, ইনডোর, এমনকি চিকিৎসাকর্মীদের থাকার জন্য কোয়ার্টার পর্যন্ত তৈরি হয়ে পড়ে আছে। দরকার ছিল শুধু দুই একজন চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মী। অর্থাৎ রাজ্য সরকারকে কিছুই নতুন করে করতে হত না। তাও দিতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী। এমনই এক প্রশাসনিক সভাতেই স্থানীয় বিধায়ক এবং তৎকালীন পুরপ্রধান ভয়ে ভয়ে জানিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। না, চাহিদা পূরণ তো দূরে থাক, মুখ্যমন্ত্রী পুরপ্রধানের বাচনভঙ্গিকে কটাক্ষ করে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন গোবরডাঙায় হাসপাতাল হবে না। মাঝে কোভিড হাসপাতাল হিসেবে সেটিকে ব্যবহার করা হলেও পরবর্তিতে তার ঠিকঠাক ভবিষ্যৎ কি তা আজও স্পষ্ট নয়। গোবরডাঙার মানুষ অবশ্য তার জবাবও দিয়েছে। সেই ঘটনার পর লোকসভা এবং বিধানসভা কোনও আসনেই তৃণমূল ওই এলাকায় জেতেনি। অথচ গোবরডাঙা এর আগে তৃণমূলের পক্ষেই ছিল, ২০১১ তেও এখানে তৃণমুল প্রার্থীই জেতেন, পুরসভাও তৃণমূলই দখল করেছিল। মুখ্যমন্ত্রীর ইগোর কারনে একটা গোটা এলাকার মানুষ তাঁর বিপক্ষে চলে গেলেন কিন্তু তাতেও কি তাঁর কিছু যায় আসে? কে জানে…

এ থেকে একটা বিষয় পরিস্কার, প্রশাসনিক সভা হল মুখ্যমন্ত্রীর বেড়ানোর অজুহাত। ঠিক যেমন রাজধানীতে দীর্ঘদিন শাসন কার্য চালাতে চালাতে রাজারা ক্লান্ত হয়ে মাঝে মধ্যে শিকারে যেতেন, অনেকটা তেমনই। কাজের কাজ কি হয় তা স্বয়ং তিনিই বলতে পারবেন। নিজের দলের বিধায়কদের তিনি তো চমকে ধমকে চাওয়া থেকে বিরত করতেই পারেন, করেও থাকেন। কিন্তু অন্য দলের বিধায়করা তার চমকানিতে ভয় না পেতেও পারে। দূর্বিনীতের মত কিছু চেয়ে বসতে পারে, যা তার একেবারেই পছন্দ নয়। তাই তো তিনি প্রশাসনিক সভায় বিরোধী দলের বিধায়ক বা অন্য জনপ্রতিনিধিদের ডাকায় বিশ্বাসী নন। একাই বলে যাবেন, প্রতিবাদ করবার কেউ থাকবে না, শুধু শ্রোতা হিসেবে বসে থাকবেন কয়েকজন অনুগত অধীনস্ত। ‘মন কি বাত’ শোনানোর এটাও একটা পদ্ধতি হতেই পারে। 

তবে কি, বারংবার এই সভা করতেও প্রচুর খরচ। জেলায় জেলায় অনেক জায়গাতেই বড় সভাঘর থাকে না। করতে হয় প্যাণ্ডেল। রাজ্য তথা জেলার তাবড় তাবড় নেতা মন্ত্রী আমলারা আসেন। তাদের জন্য খাওয়া দাওয়া, যাতায়াত, কিছু ক্ষেত্রে থাকা ইত্যাদি নানান ব্যাপারে খরচ হয় জলের মত। সেই টাকা কিন্তু যায় আপনার আমার দেওয়া কর থেকেই। শোনার যেহেতু কোনও প্রয়োজন থাকে না, গোটা ব্যাপারটাই বলার, সেহেতু কলকাতায় বসে ভিডিও কনফারেন্সে এই সভা করলেও যে কি ক্ষতি ছিল তা অনেকেরই বোধগম্য হয় না। হয় তো প্রয়োজন আছে, যা আপনার আমার মত সাধারণের চোখে পড়ে না। কিন্তু সাধারণের চোখে যেটা পড়ে সেটা হল এই চাওয়ার বিরুদ্ধতা। কলেজ, হাসপাতাল, নিশ্চয় কেউ ব্যক্তিগত  দরকারে চাননি। তাই আপনার আমার দরকারে যে চাওয়া, তারই ক্রমাগত বিরোধীতা করলে সেটাই আবার বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে না তো? নেত্রীই জানেন। তিনি তো আবার সর্বজ্ঞ।

(www.theoffnews.com - Administrative meeting chief minister)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours