পলাশ মুখোপাধ্যায়, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

আজ কোনও রাজনৈতিক লেখা নয়। নয় কোনও গুরুগম্ভীর আলোচনাও। আজ শুধুই আমার এক প্রতিবেশীর গল্প শোনাব আপনাদের। আমার ঠিক পাশেই থাকেন তিনি। আমি যেখানে থাকি সেই দমদম ক্যান্টনমেন্ট এলাকার অভিজাত, সম্ভ্রান্ত পরিবার তারা। তাদের বাড়ি একসময় এই এলাকায় রাজবাড়ি হিসেবেই খ্যাত ছিল। পুরনো আমলের সেই বাড়িতে এক সময় এসেছেন বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী, এবং বিশিষ্টজনেরা। এ হেন মান্যগণ্য পরিবারের সন্তান আমার সম্মানীয় প্রতিবেশী মহাশয়। আমি যখন দমদমে আসি, তার দিন কয়েক পরে নিজেই আলাপ করতে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে। জেনেছিলাম তিনি একজন জাদুকর। দেশে বিদেশে তার জাদুর বেজায় কদর। বছরের অধিকাংশ সময় নাকি বিদেশেই কাটে তার। নিজের বিজ্ঞাপন নিজেই দিয়েছিলেন তিনি। শুনে আমারও বেশ ভালই লেগেছিল, খানিক গর্বও হয়েছিল বটে, এমন একজন গুণী মানুষ আমার প্রতিবেশী। বাড়ির নাম জাদুভবন, বাড়িতে জাদুমঞ্চ থাকলেও এই এক যুগেরও বেশি সময়ে আমার তার জাদু দেখার সৌভাগ্য হয়েছে মাত্র একবার। সেও খুবই সাধারণ কিছু জাদু। তাকে সব সময়েই বাড়ির আশেপাশে দেখা যায়। রিকশা ছাড়া চলাফেরা করেন না। বিদেশে তিনি কখন যান, কি জাদু দেখান তা আমার এবং আশপাশের কারোরই তেমন জানা নেই। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হলেই শুনতে পাই, আগের দিনই তিনি ফ্রান্স, জার্মানি বা আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। ‘পরশুই তো আপনাকে দেখলাম’ বলাতে ভুল শুধরে নিয়ে জানান প্রচুর বিদেশ ঘুরতে হয়, মনে রাখা দায়, তাহলে বোধহয় তার আগের দিন ফিরেছেন। 

এবার আসি তার নানা কর্মকাণ্ডের কথায়। জাদুকর হিসেবে তিনি কতটা প্রতিষ্ঠিত তা ইতিমধ্যে আমরা বেশ বুঝে গিয়েছি। তাহলে সংসার চলে কি করে? পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি বেচেই তার এবং পরিবারের ভরণপোষণ চলে। বাড়ি লাগোয়া জমি ছিল বিঘা খানেক। তা তিনি আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। সেখানে গজিয়েছে তিনটে এপার্টমেন্ট। সেই টাকায় চলেছে বেশ কিছুদিন। এরপর নিজের বাড়ির নিচের তলা ভাড়া দিয়েছেন। এই দুর্দিনের বাজারে চলা মুশকিল। নিচের তলার কিছু অংশ এবং পাশের ফ্ল্যাটের নিচে তার ভাগের কিছু অংশ মিলিয়ে অনুষ্ঠান বাড়ি করে তা ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করলেন কয়েক বছর। না, সে ব্যবসা তেমন টিকল না। এবার সেই অংশ তিনি একটি নার্সারি স্কুলকে ভাড়া দিলেন। সেটা কিছুদিন চলল বটে, এর মধ্যে তিনি বুঝে গেলেন স্কুলের ব্যবসা বেশ লাভজনক। তাই ওই নার্সারি স্কুলটিকে তুলে দিয়ে নিজেই একটা স্কুল খুলে বসলেন সেই জায়গায়। মেয়েকে করে দিলেন দিদিমণি। চলছিল খারাপ না। করোনা এসে দিল সব পণ্ড করে। বছর খানেকের মধ্যেই তালা পড়ল সেই স্কুলে। যা আজও খোলেনি। 

এবার কি করা? আর তো তেমন কিছুই নেই যা বেচাকেনা করা যায়। কোপ পড়ল জাদুমঞ্চে। এই জাদুমঞ্চেই মাঝে মধ্যে লোকজন ডেকে সভা সমিতির নামে নিজের প্রচার প্রসার বা গুণকীর্তন করতেন। সেটাও এবার গেল। সাধের জাদুমঞ্চকে টুকরো টুকরো করে তিনটি দোকানে ভাগ করা হল। ভাড়া দেওয়া হল তা। একটি দোকান অবশ্য এখনও ভাড়া হয়নি। ভিতরের সম্পত্তি তার আর কি আছে আমার জানা নেই। কিন্তু বাইরে থেকে যতটুকু দেখতে পাই তাতে নতুন করে আর তার বিক্রি করবার মত কিছু নেই। পড়ে আছে পিতৃদত্ত বাড়িটুকুই। এবার সেটুকুও চলে গেলে কি হবে তা ব্রহ্মাই জানেন। 

ফ্রি তে পাওয়া বাপ দাদার সম্পত্তি রক্ষা করা বা বাড়ানোর পরিবর্তে তা বিক্রি করতে করতে তলানিতে ঠেকে গিয়েছে আমার প্রতিবেশী মহাশয়ের। সময় সুযোগ পেলেই ইচ্ছেমত বিক্রি করেছেন বা ভাড়া দিয়েছেন সেই সম্পদ। আগামীতে যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে নতুন করে কি বিক্রি করবেন তা চিন্তার বিষয় তার চেয়েও বেশি আমাদের কাছে। তার পরের প্রজন্মও আর হয়তো প্রয়োজনে কোনও কিছু বিক্রি করা বা ভাড়া দেওয়ার উপায় খুঁজে পাবে না। অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও তিনি রেখে যাবেন পূর্বপুরুষদের অঢেল সম্পত্তি থাকার ইতিহাস্টুকুই। তাদের সংসার সংগ্রামে সেই গৌরবের ইতিহাস কতদিন টিকে থাকে বা কাজে লাগে সেটাই এখন দেখার। প্রতিবেশী অবশ্য নির্বিকার, ভাবটা এমন আমি তো আমার জীবন পার করেই ফেললাম, বাকিটা যে যার মত বুঝে নেবে। আগামীর প্রতি আমার কোনও দায়ই নেই। 

গল্পটা কি পরিচিত মনে হচ্ছে? ফ্রি'তে পাওয়া সম্পত্তি, ক্ষমতায় এসে বিক্রি করে দেওয়া বা ভাড়া দিয়ে দেওয়ার নানা উদাহরণ কি চোখের সামনে একের পর এক দৃশ্যমান? হতেও পারে। আমি কিন্তু কিছু বলছি না। শুধু প্রতিবেশীর গল্পটাই শোনালাম আপনাদের।

(www.theoffnews.com - assets sold Magician)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours