শামা আরজু, লেখক, বাংলাদেশ:

তুই আর আমাতে, তফাৎ বেশী কই! অল্প বয়সের প্রেম, ভুল মানুষকে ভালোবাসা- একই তো। তোর মতো আমিও ভুল করেছি বারবার। প্রথাকে পায়ে দলেই চলেছি। জননন্দিত হইনি তাও জানি। তাতে আমার একরত্তিও দুঃখ হয়নি। কিন্তুু না চাইলেও সামাজিক একটা ফালতু প্রথার কাছে বলি তুই।পিতৃতান্ত্রিকতা। আমি  নিজেকে চালিয়ে গিয়েছিলাম, বাবার যতোটা না অনুপ্রেরণায় তার চেয়ে বেশী ভয়ে। বাবার ভয়, এখনও এই সমাজে জরুরীই খুব। তোরও একটা বৈধ বাপ ছিল। বাপকে তুই ভয়ও করতিস। কিন্তুু তোর বাবা তোর এবং তোদের বিষয়ে দায়িত্ব নিতে চায়নি কখনোই। তুই তখন ক্লাস সেভেনে। ভালো ছাত্রী। কিন্তুু প্রেমে পড়েছিস মোহন নামের একটা বখাটে ছেলের। ঘরের মেইন দরজায় একটা ফুটো ছিল। যাকে তোর ভাই, বাবু (শিশুই তখন) শুদ্ধ বাংলা ভেবে বলতো, ফুন্দা। তো সেই ছিদ্র দিয়ে ওই বখাটে ছেলেটি প্রায়ই চিঠি গুঁজে রেখে যেতো। আমি তোর সেই বৈধ বাপকে বলেছিলাম, একটু যান, ছেলেটার বাবার সঙ্গে কথা বলেন! আমার মিনতির পশ্চাদ্দেশে লাথি মেরে সে বলেছিল, আমি এসব নোংরামির মধ্যে নেই। এর পর আর একটা কথা বলার রুচিও আমার ছিল না। আরও দু'ক্লাস পর ও চলেই গেল। আমার বন্ধু রোজির কাছে বলে গেল, আমি নাকি তোকে ঠিক রাখতে পারবো না। এও বললো, তার মায়ের (আমার) বিয়ে হয়েছে একটা ওর হবে...। সংখ্যাটা অধিক ছিল, আমার এখন আর ঠিক মনে পড়ছে না, তবে আমার পুরনো কোনও লেখায় অবশ্যই আছে। রোজির মনে আছে কি না ওকেও জিজ্ঞেস করলে জানলাম আছে। হুম, রোজি বলেছিল, তো আপনার মেয়ে আপনি নিলেন না কেন? উত্তর দেয়নি সে। থাকলে তো!

ইহাই ছিল আমার সন্তানদের বৈধ পিতা। আমি একা অনেক চেষ্টা করেও প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় যাকে ঠিক থাকা বলে, সে রকম ঠিক রাখতে পারিনি তোকে। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ আর নোংরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বলি হয়ে গেলি তুই। না, এতে আমার কোনওই আক্ষেপ নেই। সে থাকলে তুই কী হতিস জানি না। তবে আজকের তোকে নিয়ে আমি চিন্তিত হলেও লজ্জিত নই। বরং গর্বিত। কারন তুই জীবন শিখেছিস।

আমার মেধাগত রেজাল্ট নিয়ে বুয়েট মেডিকেলে চেষ্টা করা যেত। ওসব কখনও ভাবতেই শিখিনি।বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে বিএ পাশ করাবেন। হ্যাঁ কঠিন পরিশ্রমে আমি আমার বাবার স্বপ্নের সমান বড় হতে পেরেছিলাম। আমার বিএ পাশের কোর্সের সাথে (পাস) শব্দটা ছিল। হাসার কোনওই কারন নেই কারণ এইচএসসিতে আমি বিজ্ঞানেই পড়তাম। চাকুরীর কারনে আমি বিজ্ঞান বিভাগ বাদ দিয়েছি।

তোর যে রেজাল্ট তাতে তোরও অমন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবার রাস্তা ছিল। কিন্তু আমি ওসব ভাবতেও শিখিনি। একার রোজগারে আমাদের তিনজনের স্থায়ী অসুস্থতা নিয়ে, বাসা ভাড়া নিয়ে থেকে, ওসব ভাবার সুযোগ কই! আমিও আসলে বড় স্বপ্ন দেখতেও শিখিনি। সাধ্যের বাইরে স্বপ্ন কেনই বা দেখতে যাব! আরও একটা কারন আছে। ততদিনে জীবন যুদ্ধ আমাকে শিখিয়েছে সুপ্রতিষ্ঠিত  মানুষ মানেই ভালো মানুষ নয় বরং ওরাই বেশী খারাপ! এতসব ভেবে চিন্তে তোকে বিজ্ঞান নয় হিসাব বিজ্ঞানেই পড়ালাম। অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পর্যন্ত তোর সব রেজাল্ট প্রথম বিভাগেই ছিল। খুব ভালো গান করতিস তুই। তবু শেষরক্ষা বুঝি হলই না। লেখাপড়া ছেড়েই দিলি।

তারপর নদীর পানি অনেক গড়ালো। নদীর বাঁকে বাঁকে কত গল্প ছিল। তুই আবার আমার কাছে।আপাততঃ আমি অনেক খুশি তোর এতদিনে নষ্ট পথে অনেক টাকা পয়সা হবার কথা ছিল। না, কিছুই হয়নি তোর। তাতে কী, আমার তো তোকেই চাই। তুই ফিরে এসেছিস। তুই অন্ধকারে হারিয়ে যাসনি। আমি আতঙ্কে থাকতাম, যে কোনও সময় আমার কাছে তোর মৃত্যু সংবাদ আসবে। তা আসেনি। পুঁজিবাদের জঞ্জাল হিসাবে একগাদা মানসিক অসুস্থতা নিয়ে তুই আমার সেই ছোট্ট মেয়েটি হয়ে আবার আমার বুকেই এলি। গত প্রায় দুবছর গাদাগাদা ওষুধ খেয়েও আমার ঘুম হচ্ছিল না। খাবার গিলতে কষ্ট হতো। তুই অসুস্থ শরীর নিয়েও আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছিস। আমার সে কী ঘুম! একটা কাজও হয়ে গেল আপাততঃ। কিন্তু না, আবার যুদ্ধ।

এসপির মেয়ে পরিচয়ে এক মেয়ে আমাদের এখানের প্রথম সারির একজন নেতার সাথে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বেডে যাবার জন্য আবার  তোকে ভালোই পীড়াপীড়ি করছে। আমার কাছে অডিও রেকর্ড আছে। এর সাথে জড়িত আরও কয়েকজনের নাম আছে।

প্রথমে একটা ধাক্কাই খেলাম। তারপর ভাবলাম -আমাকে তো থামলে চলবে না। এই সমাজ আমাকে জাত যোদ্ধা বানিয়ে ছেড়েছে। একবার ভাবলাম এখনই মাঠে নেমে পড়ি। তারপর ভাবলাম, না আরও একটু সময় নিই। আমার দমের কষ্ট হচ্ছে। একটু সময় নিই। দমের ব্যায়াম করি। শক্তি  অর্জন করি। তারপর আবার মাঠে নামবো। 

ভালোবাসার লোক এখনও কিছু বাকি আছে। তাই হঠাৎ মরে যাওয়ার ভয়ও আছে। তবুও থামবে না কিছুই। কারন আমি আমার যোগ্য উত্তরসূরী তৈরি  করতে পেরেছি। মানুষ বিশ্বাসঘাতকতা করলেও আমার লেখা তো করবে না। হয়তো আমি দেখবো না, তাতেও দুঃখ নেই। অনেক মুক্তিযোদ্ধাই স্বাধীনতা দেখে যায়নি।

যাদের আমরা খুব সফল ভাবতে শিখেছি তারা আদৌ সফল কিনা ভাবতে হবে নতুন করে।

তুই আর আমি তো সফলই!

আমরাই আমাদের স্যালুট জানাই না হয়!

(www.theoffnews.com - Bangladesh myself)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours