সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:

কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ঘোষিত নয়া কৃষি নীতি প্রত্যাহার করে নিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। কি যেন নামটার পরিচয়? আসলে সবাই বলেন 'নরেন্দ্র মোদী'। তিনি গতকাল জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন, "সার্বিক পর্যায়ে নয়া কৃষি নীতি প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। এটাকে কারও হারজিৎ হিসেবে দেখতে চাইছি না। আমরা এই নয়া কৃষি নীতির কার্যকারিতা সম্পর্কে দেশের মানুষকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। আন্দোলনকারী কৃষকদের অনুরোধ করবো, আপনারা যে যার আবাসে ফিরে যান। আবার কৃষি কার্যে মনোনিবেশ করুন। আমাদের সরকার আপনাদের পাশে আছে।"

অযাবৎ মোদীর এই ঘোষণা হল এক অপরূপ পলিটিকাল ক্যাচ লাইন। প্রকৃত প্রধানমন্ত্রীর মুখেই তো মানায় এমন জেদহীন সহমতের রাজনৈতিক ঘোষণা। আপেক্ষিক ভাবে সেটাই তো মনে হয়, তাই না? ভারতীয় রাজনীতির একদা হিমালয় বর্তমানের মুষিক কংগ্রেস দলের পারিবারিক পাপ্পু রাহুল গাঁধী তো মোদীর এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বলে বসলেন, "আমরা কেন্দ্রীয় সরকারকে কালা কৃষি কানুন নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য করালাম।" সাম্প্রতিককালে সীতারাম ইয়েচুরি ও প্রকাশ কারাটের লালিত দল সিপিএমের ক্ষয়িষ্ণু ধারাবাহিকতা কেমন যেন করোনা সংক্রমণের থাবাকে পিছনে ফেলে দেয়। তাঁরাও এহেন মুহূর্তে শীতের লেপ ছেড়ে বলতে শুরু করেছেন, এই জয় তাঁদের লাগাতার আন্দোলনের সুফল। স্বৈরাচারী মোদীকে নতিস্বীকার তাঁরা করিয়েই ছেড়েছেন।

একটা পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিই। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। তিনি ভাবী কালের তাঁর আজকের উত্তরসূরিকে নিশ্চয় অনুমান করতে পেরেছিলেন। তাঁর বিচক্ষণতার আতস কাঁচে তিনি মোদীর ক্যামোফ্লেজিং আচরণকে বিলক্ষণ যে চিনেছিলেন তার প্রমাণ আজও মনে করায় সেই ঐতিহাসিক পরামর্শে। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী নিজের পাশের আসনে বসিয়ে মোদীকে প্রকাশ্যে বলেছিলেন রাজধর্ম পালন করতে। সেদিন মোদীও অম্লান বদনে হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, "স্যার আমি রাজধর্মই পালন করছি।" আজও কিন্তু মোদী হাসি হাসি একই রকমের অম্লান মুখে কি মসৃণভাবেই না কৃষি নীতি হিম ঘরে পাঠিয়ে দিলেন সেই রাজধর্ম পালন করতে করতে।

বিরোধীরা মোদীর এই পশ্চাদ বিচরণকে তাদের রাজনৈতিক জয় অ্যাখা দেবেই এটা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এই পদক্ষেপ যে মোদীর পরাজয় এটা ভাবতে গেলে কিন্তু অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে এসে যায়। কারণ মোদীর সরকার পরিচালনায় পিছিয়ে আসার দৃষ্টান্ত খুব কমই লক্ষনীয়।

এটা ঠিক যে মোদী ঘোষিত কৃষি আইন যেন ক্রমেই ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন হয়ে বিজেপিকেই ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করে। দেশীয় রাজনৈতিক ময়দানে তো বটেই। আর এই বিপদের গন্ধটা মোদী শাহ নাড্ডা কোঠারি ঠিক বুঝে গেছেন অন্তত বাংলায় বিধানসভা ভোটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ল্যাজে গোবরে হবার পর। পাবলিক নার্ভের উপর প্রচার সর্বস্ব সরকারি মেশিনারি প্রয়োগ করলেই যে ভোট বৈতরণী পার হওয়া বহুলাংশে সম্ভব নয়, এই দাম্ভিকতা আপাতত গেরুয়া শিবির পরিত্যাগ করেছে তা মোদীর এই ঘোষণা প্রমাণ করে।

আবার বলি এতে বিরোধীদের কেন্দ্র বিজয়ের তামাক খাওয়ার মতো তেমন কিছুই ঘটেনি। কারণ মোদী সরকার কোনও আর্থিক দুর্নীতি করেছে এই কৃষি নীতি নিয়ে এমন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কোথাও নেই। এটা একটা সরকার গৃহীত সিদ্ধান্ত মাত্র। যা গতকাল সরকারের তরফে আপাতত ফিরিয়ে নেওয়া হলো। আর্থিক তছরূপ ঘটলে এই ইস্যুকে সুদূরপ্রসারী করাই যেত অনায়াসেই। কিন্তু গৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল হলো এহেন প্রসঙ্গকে বছর খানেক জিয়িয়ে রাখা ছত্রভঙ্গ বিরোধী নেতাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। কারণ আচমকা কিছু না ঘটলে আগামী লোকসভা ভোট বাজারে আসতে এখনও নূন্যতম দেড় বছর বাকি। তাই কৌশলী মোদী কৃষি নীতি প্রত্যাহারের সময়টা সুকৌশলে বেছে নিয়ে কার্যত বিরোধীদের বুঝিয়ে দিলেন, এখন না হয় শীতঘুম ভেঙ্গে একটু না হয় তুর্কি নাচ নাচো কিন্তু লোকসভার ভোট ময়দানে তোমরা এখন অস্ত্রশূন্য হয়ে গেলে। আর আগামী দেড় বছরের সময়ের স্রোতে তুরুপের তাসের মতো কত যে সহায়ক ইস্যু নিয়ে এসে জনমানসের মন থেকে কৃষি নীতিকে ভুলো মনের পরিণত করবে নাড্ডা থিং ট্যাঙ্ক, তার কি ইয়ত্তা আছে। একটাই মনে রাখা আবশ্যক, মোদীর গ্রিনরুমের এখন একটাই অর্জুনের পাখির চোখ। তা হলো ২০২৩ এর নির্বাচনে বিজেপির একক ভাবে সংখ্যা গরিষ্ঠের মাইলফলকে পৌঁছানো। তাই অনেক ভেবেই কৃষি নীতির মতো যন্ত্রণাদায়ক দাঁতটাই এখন তুলে ফেলে দিলেন মোদী নিজেই। একই সঙ্গে বিরোধীদের এটাই বার্তা দিলেন, না থাকবে বাঁশ না বাজবে বাঁশি।

তাই রাজনৈতিক পাশা খেলায় এতো তাড়াতাড়ি হারজিতের ফলাফল ঘোষণা করা ঠিক হবে না। অন্তত মোদীকে যারা রাজনৈতিক ভাবে জানেন ও চেনেন তারা এই বিষয়ে 'ওয়েট এন্ড সি' নীতিতে চলবে। কারণ মোদীর ব্যক্তি ঘরাণায় 'না' বা 'পিছনে ফিরে যাওয়া' বলে কোনও শব্দ লেখা নেই। যুদ্ধের আগে নিজের অধিকৃত অবস্থান থেকে পাঁচ পা পিছিয়ে যাওয়া একটা কৌশল মাত্র। 'ফাঁদ' পাতার মতো এটা আসলে একটা চতুর রণনীতির ইস্কাবনের টেক্কা ব্যবহার মাত্র। সামনে ভোটযুদ্ধ। মোদী বাহিনী যদি সদর্পে জেতে তবে তিনি যে ফের পঁচিশ পা এগিয়ে যাবেন না কৃষি নীতির থলি নিয়ে এমন গ্যারান্টি এখনই দেওয়া যাবে না। আর যদি নড়বড়ে ভাবে জেতে বা হারে তবে মোদীর আজকের পিছিয়ে যাওয়াকে পরাজয় তকমা দেওয়া যেতেই পারে। তাই মার্কশিট ঘোষণা করার সময় নির্ধারণ করতে আরও বছর খানেক অপেক্ষা করতেই হবে মোদীর উৎসুক বিরোধীদের। কারণ মোদীর ঘোষণাতেই এই ফাঁদের ফনা কিন্তু ঘাপটি মেরে রয়েছে। তিনি বলেছেন, "একটা কমিটি গঠন করা হবে। কৃষি নীতির যাবতীয় বিষয় এই কমিটি পর্যবেক্ষণ করবে।" তাহলে কি...

(www.theoffnews.com - Narendra Modi Agriculture Bill)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours