দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
শুধু ঠাঁই হলো না বললে ভুল বলা হবে, দূর ছাই করে তাড়িয়ে দেওয়া হলো দ্বিজেন্দ্রনাথের আলাপিনী সমিতিকে। ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলো সমস্ত মূল্যবান জিনিস পত্র। যার মধ্যে রয়েছে নেতাজীর ভ্রাতুস্পুত্রী চিত্রাদেবী যে চেয়ারে এসে বসতেন, সেটিও।
একশো পাঁচ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মহিলা সমিতির ঘর আগেই সীল করে দিয়েছিলেন বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। কোনও আলাপ আলোচনার সুযোগ আলাপিনী সমিতিকে তিনি দিতে চাননি, এমন অভিযোগ বার বার উঠেছে। বুধবার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এমন নির্মম সিদ্ধান্তে অনেকেই দুঃখিত। তবে আলাপিনী সমিতি তার কাজ চালিয়ে যাবে এবং ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানান সমিতির অন্যতম সদস্যা মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, বিশ্বভারতীতে উপাচার্য আসবেন, যাবেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য ছিল আলাপিনী সমিতি। আশ্রমের সাথে তার সম্পর্ক অটুট। আজকে অতিমারীর সময়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চলে যেতে হলো। প্রশাসনিক বল প্রয়োগ করে আজকে সমস্ত জিনিস পত্র নিয়ে যেতে বাধ্য করা হলো। তবে ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন জারি থাকবে।
জানা গেছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুপ্রেরণায় ও তাঁর দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগিতার ১৯১৬ সালে বিশ্বভারতীতে গড়ে উঠেছিল "আলাপিনী মহিলা সমিতি"। সমিতির নামটি তাঁর দেওয়া। কবিপত্নী, পুত্রবধূ, ভ্রাতৃকন্যা থেকে শুরু করে অমর্ত্য সেনের মা-সহ বিশিষ্টরা এই সমিতির সদস্যা ছিলেন।
সমিতির উদ্যোগে "শ্রেয়শী" নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে আসছে। এই পত্রিকাটির নামকরণ করেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে সমিতির নির্দিষ্ট কোনও ঘর ছিল না। বিভিন্ন জায়গায় সমিতির সভা বসত। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ইন্দিরাদেবী চৌধুরানি এই সমিতির সদস্যা ছিলেন।১৯৫৬ সালে তিনি বিশ্বভারতীর উপাচার্য হন। তখন আশ্রমের ভিতর পাঠভবনের গায়ে আলাপিনী মহিলা সমিতির জন্য একটি ঘর দিয়েছিলেন। সেই ঐতিহ্যবাহী মহিলা সমিতির স্মৃতিটুকু মুছে দিতে পদক্ষেপ নিল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ।
মাটির বাড়ি, খড়ের ছাউনি। এই বাড়িতেই মাসে দু'বার করে বসতো মহিলা সমিতির সভা। শান্তিনিকেতন আশ্রমের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিল এই সমিতি।
শুধু তাই নয়, সমাজকল্যাণ এবং সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন আলাপিনীর সদস্যারা। আশ্রমের প্রথম দিকে গ্রেসন গ্রিন নামে এক বিদেশিনী আসেন শান্তিনিকেতনে, যিনি ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি এসে এই ধাত্রীবিদ্যা ও প্রাথমিক চিকিৎসা শেখান আশ্রমের মেয়েদের। সেই সময় সমিতির সদস্যা কিরণবালা সেন ও ননীবালা দেবী ধাত্রীবিদ্যা শিখে আশ্রম ও আশ্রম সংলগ্ন এলাকার প্রসূতিদের সেবায় নিয়োজিত হন। বছর কয়েক আগে পর্যন্তও ফি বছর রবীন্দ্র সপ্তাহে একটি দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন ও পরিবেশনা এবং শারদোৎসবে নাটক পরিবেশন করতেন সমিতির সদস্যারা।
সমিতির অভিযোগ, বর্তমান উপাচার্য আসার পরে সেই পরিসর বন্ধ হয় একটু একটু করে। পরে পুরোপুরি বন্ধ করতে ঘর সীল করে দেওয়া হয়। প্রতি বছর ৭ পৌষ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া নাম অনুসারে তাঁরা 'শ্রেয়সী' নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করেন। একসময় পাঠভবনের ছাত্রীনিবাস ও ক্যান্টিনে গিয়ে ছাত্রীদের খাওয়া দাওয়া ও পোশাকেরও নিয়মিত তদারকি করতো সমিতির সদস্যারা। মেধাবী পড়ুয়াদের বইও উপহার দেওয়া হতো।
জানা গেছে, ১৯৫৩ সালে আলাপিনীর সদস্যারাই আনন্দ পাঠশালার সূচনা করেন। যা এখন ‘মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা’ নামে পরিচিত। এখান থেকে প্রতি বছর বিশ্বভারতীর একটা ভাল পরিমাণ টাকা আয় হতো।
এযাবৎ কোনও উপাচার্য এতকাল এই ধরনের কাজ করেননি । বরং সমিতিকে সহযোগিতা করেছিলেন। আজ থেকে পুরোটাই স্মৃতি। সৌজন্যে মহামহিম বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, বলছেন আশ্রমিক থেকে শিক্ষক পড়ুয়া অনেকেই।
(www.theoffnews.cm - Alapini samiti Visva Bharati University)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours