সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর, হুগলি:

মিশনারিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর মিশন উনবিংশ শতাব্দীতে অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে জর্জরিত  বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনে এক  নবজাগরণের সূত্রপাত করেছিল। এই ব্যাপারে পথ প্রর্দশক ছিলেন শ্রীরামপুর ত্রয়ী নামে খ্যাত  উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড। কেরী ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে লেইস্টারসে ‘ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটি’ গঠন  করেন। কেরী ও ডঃ টমাস এই সোসাইটির  প্রতিনিধি হিসাবে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় আগমন করেন। কেরী প্রথমে মালদহের কাছে মদনাবতী নীলকুঠীতে চাকরী করতেন। মদনাবতীতে থাকাকালীন উইলিয়াম কেরী বাইবেলের অনুবাদ, বিদ্যালয় স্থাপন ও ধর্ম প্রচার প্রভৃতির মাধ্যমে  মিশনের কাজ শুরু করেন। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ডঃ মার্শম্যান ও ওয়ার্ড এবং তাঁদের দুজন সঙ্গী খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে পদার্পণ করেন। সেইসময় ফ্রান্সের সাথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ চলছিল। তদানীন্তন  ব্রিটিশ গভর্নর লর্ড ওয়েলেসলি তাঁদেরকে ফরাসী গুপ্তচর  মনে করে ভারত ছাড়তে হুকুম দেন। কিন্তু রেভারেন্ড ডেভিড ব্রাউন ওয়েলেসলির ভ্রান্ত ধারণা দূর করার পর এই বাংলায় থাকার অনুমতি পায়। ইংরেজদের বাধাদানে মার্শম্যান ও ওয়ার্ড কলকাতায় থাকতে না পেরে ডেনিসদের অধীনে শ্রীরামপুরে বাস করার অনুমতি পান স্বয়ং ডেনিস গভর্ণরের কাছ থেকে। পরে কেরী শ্রীরামপুরে এসে  মার্শম্যানদের সাথে যোগ দেন।

ভারতে শিক্ষাবিস্তার ও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য ডেনিস গভর্ণর মিশনারিদের শ্রীরামপুরে স্থান দেওয়ায় উইলিয়াম কেরী, উইলিয়াম ওয়ার্ড, জন ফাউন্টেন এবং জশুয়া মার্শম্যান ২৫ এপ্রিল ১৮০০  খ্রিস্টাব্দে ডেনিস গভর্ণর কর্ণেল বাই-কে এক ধন্যবাদ জ্ঞাপন পত্র পাঠিয়ে লেখেন – ‘শ্রীরামপুরে স্থান না পাইলে তাহাদিগকে এই দেশ ছাড়িয়া  চলিয়া যাইতে হইত'। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ১০  জানুয়ারি কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড এই তিনজন মিলে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এই মিশন  ছিল ভারতের প্রথম নিজস্ব প্রচারক সংঘ। এই মিশন হুগলি জেলার দুটি স্থান থেকে খ্রিস্টের বাণী প্রচারের সূচনা করে। শ্রীরামপুর মিশনের অধীনে স্থাপিত ‘মিশনস্কুল’-এ কলকাতা থেকে সমস্ত ইউরোপীয় ছাত্ররা পড়তে আসত। 'কলিকাতা গেজেটে’ প্রায়ই ‘The Mission School At Serampur under Mr. Carey' বলে বিজ্ঞাপন বের হত। কেরী ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুরে একখানি  বাড়ী কিনে ডঃ মার্শম্যান ও ওয়ার্ডকে সঙ্গে নিয়ে  শ্রীরামপুর ‘ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস' নামক মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করেন।

পঞ্চানন কর্মকার দ্বারা প্রস্তুত প্রথম কাঠের তৈরী বাংলা হরফ দিয়ে বাইবেলের বঙ্গানুবাদ এই প্রেস থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। দুই হাজার খন্ড বাইবেল বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে তৎকালীন সময়ে মোট খরচ পড়েছিল ৬১২ পাউন্ড। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে  রামরাম বসুর রচিত ‘প্রতাপাদিত্য চরিত’ শীর্ষক পুস্তকটি মিশন প্রেস মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়। বলা হয় এটাই বঙ্গদেশের প্রথম মুদ্রিত গদ্য পুস্তক। বাংলার গদ্য ও সাহিত্যকর্মের প্রসারে মিশন  গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছিল। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মে এই প্রেস হতে বাংলা ভাষার  প্রথম সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশিত হয়।  ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসে বিধ্বংসী অগ্নিকান্ড ঘটে যায়। অগ্নিকান্ডে প্রেসের প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল। এই বিপুল বিপর্যয় সামলে  পরবর্তী কালে প্রেসটিকে পুর্নগঠিত করা হয়।

কেরী শ্রীরামপুর মিশনের  অর্থ তহবিলের ভার নেন। মার্শম্যান বিদ্যালয় এবং ওয়ার্ড মুদ্রণ পরিচালনার  দায়িত্ব নেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল  শ্রীরামপুর মিশন চার্চের উদ্বোধন হয়। কেরী হলেন  চার্চের পুরোহিত এবং মার্শম্যান ও ওয়ার্ড সহকারী পুরোহিতের ভার নেন। কেরীদের এই মিশন  নিজেদের স্বপোর্জিত অর্থেই চলত। মার্শম্যান  বিদ্যালয়, ওয়ার্ড প্রেস এবং কেরী ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনা করে নিজেদের ভরণপোষণ ও  মিশনের কাজ চালাতেন।  

ইংরেজ সরকারের বাধাদানের দরুণ এই মিশনারিদের ধর্ম প্রচারের কাজ আশানুরূপ হয়নি।  কিন্তু বাইবেল অনুবাদ,পুস্তক মুদ্রণ, বিদ্যালয় স্থাপন  ইত্যাদি জনহিতকর কাজে শ্রীরামপুর মিশন যথেষ্ট সাফল্য লাভ করে। বাংলার গদ্য ও সাহিত্যকর্মের প্রসারে মিশন গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছিল। সমাজ সংস্কারে শ্রীরামপুর মিশন তৎকালীন সময়ে  অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। জনহিতকর কর্মপরিধি  প্রসার লাভ করায় মিশনের শাখা পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের বহু জায়গায় স্থাপিত হয়েছিল।  

শ্রীরামপুর মিশনের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল দেশীয়দের শিক্ষাদানের জন্য শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা। ধর্মনিরপেক্ষ উচ্চশিক্ষাদান এই কলেজের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। ডেনিস সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীরামপুর কলেজ একসময় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নিত হয়। কিন্তু ১৮২২ থেকে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে উলিয়াম ওয়ার্ড ও কেরীর বড় ছেলে ফেলিক্সের হঠাৎ মৃত্যু হলে শ্রীরামপুর মিশনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে।  হুগলা নদীর বন্যায় মিশনের ঘড়-বাড়ীর ক্ষতিসাধন  হলে মিশন কর্তৃপক্ষ আরও সমস্যায় পড়ে যায়।  সমস্যার টানাপোড়নে বাধ্য হয় ইংল্যান্ডের ‘ব্যাপটিস্ট মিশনারি সোসাইটি’-র সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে। ফলে শ্রীরামপুর মিশন স্বাধীন মিশনারি সোসাইটি হিসাবে কাজকর্ম শুরু করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁদের পিছু  ছাড়েনি। কলকাতার যে কোম্পানীতে  তাঁরা মিশনের টাকা গচ্ছিত রাখতেন সেটি হঠাৎ একদিন নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করে বসে। মিশনের এই  অসহায় অবস্থায় ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে  কেরী এবং ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে মার্শম্যান  পরলোকগমন করেন। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে কয়েকবছর চলার পর ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশনের কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়।

(www.theoffnews.com - Shreerampore Mission)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours