তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ১৭৮৪ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ নীলমণি এই দুর্গাপূজা শুরু করেন। দুর্গাপূজা প্রধানত ধনী পরিবার গুলোতেই আয়োজিত হতো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৩ সালে বোলপুর থেকে কাদম্বরী দেবীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর মতবাদ লিখেছিলেন। তার মতে, ঈশ্বর সাকার ও নিরাকার দুই-ই। শুধু ঈশ্বর নয়, তাঁর মতে আমরা প্রত্যেকেই সাকার এবং নিরাকার দুই-ই। তিনি ঈশ্বরবাদ নিয়ে কোনও বাদ-বিবাদে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি আকারে, রূপে, কর্মে ঈশ্বরের উপাসনা করাতেই বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মুর্তি পূজা করতে চাইতেন না। তবে প্রতিমা নিয়ে তাঁর কোনও দ্বিমত ছিল না। তাঁর মতে, যদি কোনও বিশেষ মুর্তির মধ্যেই ঈশ্বরের আবির্ভাবকে বিশেষ সত্য বলে না মনে করা যায় তাহলেই তাতে আর কোনও সমস্যা থাকে না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন সৌদামিনী দেবীর একটি লেখা থেকে জানা যায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পূজার বাড়িতে থাকতেন না। পূজার সময় ঠাকুরবাড়িতে যত আচার-অনুষ্ঠানই হোক না কেন সেখানে রবিঠাকুরের মা স্বামীকে ছাড়া কোনওভাবেই নিজেকে শামিল করতে পারতেন না। ষষ্ঠীর দিন শুধু ছেলে-মেয়েরাই নয়, আত্মীয়-স্বজন, কর্মচারী, ভৃত্য এবং ঝিদের নতুন জামাকাপড় বিলি করে দেওয়া হতো ঠাকুরবাড়ি থেকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ দ্বারকানাথ অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন এবং তিনি প্রচুর খরচ করতেন। পূজার সময়ে মোয়া, ক্ষীর প্রভৃতি মিশিয়ে ফুটবলের মতো দেখতে একটি বৃহদাকার মিঠাই তৈরি করা হতো সবার জন্য।

রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেকালের ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, পূজার দিনগুলোতে তাঁরা সন্ধ্যার দিকে দালানে যেতেন। সেখানে ধূপ জ্বালানো হতো। বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন বাদ্যযন্ত্রীরা। সন্ধ্যার আরতি দেখার জন্য এবং ঠাকুরকে প্রণাম করার জন্যই তাঁরা দালানে যেতেন। বিজয়ার দিন প্রতিমার নিরঞ্জনের মিছিলে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা যোগ দিতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবীর কথায়, ঠাকুরবাড়িতে যখন দুর্গোৎসব হতো তখন ছেলেরা বিজয়ার দিনে নতুন জামাকাপড় পরে প্রতিমার সঙ্গে যেত। আর মেয়েরা তখন তেতলার ছাদে উঠে প্রতিমা বিসর্জন দেখত। সৌদামিনী দেবীর লেখায় এও জানা যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজয়ার রাতে শান্তিজল সিঞ্চন ও ছোট-বড় সবার মধ্যে কোলাকুলি করাটা খুব পছন্দ করতেন।

ছাড়াও, সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, বিজয়ার দিন তাঁদের বাড়িতে গৃহনায়ক বিষ্ণু আগমনী ও বিজয়ার গান করতে আসতেন। অবনীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানা যায়, বিজয়া তাঁদের জন্য খুব আনন্দের দিন ছিল। সেদিনও কিছু পার্বণী পাওয়া যেত। ঠাকুরবাড়ির যত কর্মচারী ছিলেন সবার সঙ্গে তাঁরা কোলাকুলি করতেন। বুড়ো চাকররাও এসে ঠাকুরবাড়ির ছোট-বড় সবাইকে প্রণাম করত। পরবর্তীকালে ঠাকুরবাড়িতে অনুষ্ঠিত “বিজয়া সম্মিলনী” প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের লেখায় জানা যায়, সেদিন ঠাকুরবাড়িতে মস্ত জলসা বসত। খাওয়া-দাওয়া হতো খুব। ওস্তাদ তানপুরা নিয়ে গানে গানে মাত করে দিতেন ঝাড়বাতির আলোয় আলোকিত সেই ঠাকুরবাড়ি। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গাকে খাঁটি সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হতো এবং সালঙ্কার সেই প্রতিমাকে বিসর্জন দেওয়া হতো। প্রতিমা ভাসানোর সময়ও সেই স্বর্ণালঙ্কার খুলে নেওয়া হতো না। নৌকার মাঝি অথবা অন্য কর্মচারীরা পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ওইসব গয়না তুলে আনত। কিন্তু সেই গয়না ফের ঠাকুরবাড়িতে নেওয়া হতো না।

তত্ত্বাবোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ১০ বছর পরও ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজা হতো। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ছোট ভাই নগেন্দ্রনাথের মতে, দুর্গোৎসব সমাজের সবার সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপনের একটি উৎকৃষ্ট উপায়। তাই সবার প্রতি তাঁর আহ্বান ছিল দুর্গোৎসব নিয়ে কোনও হস্তক্ষেপ না করার। সম্ভবত, রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজের ছোট কাকার এই ধারণাই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশকিছু প্রবন্ধে দুর্গা সম্পর্কে নানাভাবে আলোচনা করেছেন। “লোকসাহিত্য”-এর অন্তর্ভুক্ত “ছেলেভুলানো ছড়া” প্রবন্ধটিতে একটি বহু প্রচলিত ছড়া প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখা রয়েছে। সেখানে জানা যায়, আমাদের বাংলাদেশের এক কঠিন অন্তরবেদনা আছে, মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো। অল্পবয়স্ক মেয়েদের বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সংসার করতে হয়। আর মেয়ের এই ত্যাগের জন্য পুরো বাংলাদেশে সবারই হৃদয় কাঁদে। সেই করুণ স্নেহ বারবার শারদীয় দুর্গোৎসবে স্বর্গীয়তা লাভ করে। তাই রবিঠাকুর একে বাঙালির অম্বিকাপূজা অথবা বাঙালির কন্যাপূজা বলেছেন। আগমনী এবং বিজয়া হলো বাংলার মাতৃহৃদয়ের গান।

এই পূজা-পার্বণ যে সমাজের সব মানুষকে একত্র করে মিলনে বাঁধে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একমাত্র এ বিষয়টিই টেনেছে। তিনি সবসময় বোঝাতে চেয়েছেন মিলনের মধ্য দিয়ে অসীমকে পাওয়া যায়, কোনও দেবতাকে নয়। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক মানুষ। তাই দুর্গাপূজার সময়গুলোতে তিনি পূজার চেয়েও বেশি আনন্দ উপভোগ করতেন মানুষের মিলন মেলায় এসে।

দুর্গোৎসব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের চোখে পড়ার মতো প্রথম কবিতা প্রকাশ হয় ১২৯১ (১৮৮৪ ইং)-এর কার্তিক মাসে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রচার পত্রিকায়। সেই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন দীর্ঘ কবিতা—আনন্দময়ীর আগমনে/আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে/হেরো ওই ধনীর দুয়ারে/দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে।রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’ নামের শারদীয় বার্ষিকীতেই প্রথম পূজার লেখা দেন। ‘পার্বণী’ হলো প্রথম বাংলা বার্ষিকী। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৫ সালে। ‘পার্বণী’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘পার্ব্বণী’র প্রথম পূজাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ‘শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’ গানটি ‘শরতের গান’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন। ১৯৩৫ সালে ‘আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে পূজা সংখ্যায় লেখা দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে ‘একশো টাকা বায়না’ দেওয়া হয়। ঘটনাটির উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালের ২৯ আগস্ট শান্তিনিকেতন থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখেন, ‘এখানকার বন্যা পীড়িতদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহ-চেষ্টায় ছিলুম। ব্যক্তিগতভাবে আমারও দুঃসময়। কিছু দিতে পারছিলুম না বলে মন নিতান্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এমন সময় দেশ ও আনন্দবাজারের দুই সম্পাদক পূজার সংখ্যার দুটি কবিতার জন্যে একশো টাকা বায়না দিয়ে যান, সেই টাকাটা বন্যার তহবিলে গিয়েছে। আগেকার মতো অনায়াসে লেখবার ক্ষমতা এখন নেই। সেইজন্যে ‘বিস্ময়’ কবিতাটি দিয়ে ওদের ঋণশোধ করব বলে স্থির করেছি। ক্লান্ত কলম নতুন লেখায় প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।’ শারদীয় সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা পাওয়ার জন্য সম্পাদকের চেষ্টার অন্ত থাকত না।

আসলে পথে ঘাটে যে উমারা বঞ্চিত হচ্ছে বিভিন্ন যন্ত্রনায় উনি সেই দিকটা গুরুত্ব দিয়েছেন অনেক বেশি, মুর্তি উৎসবে নয়, কারণ এটা শুধু নয় তিনি ব্রাহ্ম, এটাই বোঝাবার চেষ্টা করেছেন মানবতা বা মনুষ্যত্ব একমাত্রই কাম্য এবং প্রয়োজন যে কোনও ঠাকুর পুজোর উৎসবের চেয়ে। কারণ দুর্গারা ছড়িয়ে আছে আমাদেরই সমাজ জীবনের বিভিন্ন প্রান্তে। তাই দুর্গা একই সাথে নিরাকার ও সাকার।

(www.theoffnews.com - Rabindranath Durga Puja)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours