তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
সুরের গান, না-সুরের গান, কাকে ছেড়ে কাকে বাছবো? আমি দুইকেই সমান স্বীকার করে নিয়েছি। এক জাগয়ায় কেবল আমার বাধে। খেলনা নিয়ে নিজেকে ভোলাতে আমি কিছুতেই পারি নে। এটা পারে নিতান্তই শিশু বধূ। সাথী আছেন কাছে বসে তাঁর দিকে পিছন ফিরে খেলনার বাক্স খুলে বা একেবারেই সময় নষ্ট করা। এতে করে সত্য অনুভূতির রস যায় ফিকে হয়ে। ফুল দিতে চাও দাও না, এমন কাউকে দাও যে-মানুষ ফুল হাতে নিয়ে বলবে বাঃ। তার সেই সত্য খুসি আনন্দে গিয়ে পৌঁছায়। শিলাইদহের বোষ্টমী আমার হাতে আম দিয়ে বললে, তাঁকে দিলুম। এই তো সত্যকার দেওয়া- আমারই ভোগের মধ্যে তিনি আমটিকে পান। পূজারী ব্রাহ্মণ সকাল বেলায় গোলকচাঁপার গাছে বাড়ি মেরে ফুল সংগ্রহ করে ঠাকুরঘরে যেত- তার নামে পুলিশে নালিষ করতে ইচ্ছা করত- ঠাকুরকে ফাঁকি দিচ্ছে বলে। সেই ফুল আমার মধ্যে দিয়ে ঠাকুর গ্রহণ করবেন বলেই গাছে ফুল ফুটিয়েছেন আর আমার মধ্যে ফুলে আনন্দ আছে। ঠাকুরঘরে যে মুর্তি প্রতিদিন এই চোরাই মাল গ্রহণ করে সে তো সমস্ত বিশ্বকে ফাঁকি দিলে- মূঢ়তার ঝুলির মধ্যে ঢেকে তার চুরি। কত মানুষকেই বঞ্চিত করে তবে আমরা এই দেবতার খেলা খেলি। ঠাকুর ঘরের নৈবেদ্যের মধ্যে আমরা ঠাকুরের সত্যকার প্রাপ্যকে প্রত্যহ নষ্ট করি।
এর থেকে একটা কথা বুঝতে পারবে, আমার দেবতা মানুষের বাইরে নেই। নির্ব্বিকার নিরঞ্জনের অবমাননা হচ্ছে বলে আমি ঠাকুর ঘর থেকে দূরে থাকি এ কথা সত্য নয়- মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে বলেই আমার নালিষ। যে সেবা যে প্রীতি মানুষের মধ্যে সত্য করে তোলবার সাধনাই হচ্ছে ধর্ম সাধনা তাকে আমরা খেলার মধ্যে ফাঁকি দিয়ে মেটাবার চেষ্টায় প্রভূত অপব্যয় ঘটাচ্ছি। এই জন্যেই আমাদের দেশে ধার্মিকতার দ্বারা মানুষ এত অত্যন্ত অবজ্ঞাত। মানুষের রোগ তাপ উপবাস মিটতে চায় না, কেন না চিরশিশুর দেশে খেলার রাস্তা দিয়ে সেটা মেটাবার ভার নিয়েছি। মাদুরার মন্দিরে যখন লক্ষ লক্ষ টাকার গহনা আমাকে সগৌরবে দেখানো হলো তখন লজ্জায় দুঃখে আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। কত লক্ষ লক্ষ লোকের দৈন্য অজ্ঞান অস্বাস্থ্য ওই সব গহনার মধ্যে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। খেলার দেবতা এই সব সোনা জহরৎকে ব্যর্থ করে বসে থাকুন- এদিকে সত্যকার দেবতা সত্যকার মানুষের কঙ্কালশীর্ণ হাতের মুষ্টি প্রসারিত করে ওই মন্দিরের বাহিরে পথে পথে ফিরছেন। তবু আমাকে বলবে আমি নিরঞ্জনের পূজারী? ওই ঠাকুর ঘরের মধ্যে যে পূজা পড়ছে সমস্ত ক্ষুধিতের ক্ষুধাকে অবজ্ঞা করে সে আজ কোন শূন্যে গিয়ে জমা হচ্ছে?
হয়তো বলবে এই খেলার পূজাটা সহজ। কিন্তু সাধনাকে সহজ করো না। আমরা মানুষ, আমাদের এতে গৌরব নষ্ট হয়। দেবতার পূজা কঠিন দুঃখেরই সাধনা- মানুষের দুঃখভার পর্বত-প্রমাণ হয়ে উঠেছে সেইখানেই দেবতার আহ্বান শোনো- সেই দুঃসাধ্য তপস্যাকে ফাঁকি দেবার জন্যে মোহের গহ্বরের মধ্যে লুকিয়ে থেকো না। আমি মানুষকে ভালোবাসি বলেই এই খেলনা দেবতার সঙ্গে আমার ঝগড়া। দরকার নেই এই খেলার, কেননা প্রেম দাবী করছে সত্যকার ত্যাগের, সত্যকার পাত্রে। তোমাকে বোধ হয় কিছু কষ্ট দিলুম। কিন্তু সেও ভালো। যদি তোমাকে অবজ্ঞা করতুম তাহলে এ কষ্টটুকু দিতুম না।
এমনি স্বগতঃ ভাবনা বা ব্যক্তিগত প্রবন্ধে অতুলনীয় সৎসাহিত্য রচিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য পত্রের বেশির ভাগ জুড়ে। তবে এ সাহিত্য পত্র-মাধ্যম ছাড়া অন্য কোনও মাধ্যমে এ প্রসাদগুণ নিয়ে সৃষ্ট হতে পারতো না কেন, তাও তাঁর কাছেই শোনা ভালো। ছিন্নপত্র, ভানুসিংহের পত্রাবলী, পথে ও পথের প্রান্তে- এই তিনখানি গ্রন্থ ১৩৪৫ সালে পত্রধারা শিরোনামে চিহ্নিত হলে, তার ভূমিকাতে ছিন্নপত্র প্রসঙ্গে কবি যা লিখেছেন তা তাঁর সমগ্র পত্রসাহিত্য সম্পর্কেই প্রযোজ্য :
পত্রধারায় ছিন্নপত্র পর্যায়ে যে-চিঠির টুকরোগুলি ছড়ানো হয়েছে তার অধিকাংশই আমার ভাইঝি ইন্দিরাকে লেখা চিঠির থেকে নেওয়া। তখন আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম বাংলার পল্লীতে পল্লীতে, আমার পথ-চলা মনে সেই-সকল গ্রামদৃশ্যের নানা নতুন পরিচয় ক্ষণে ক্ষণে চমক লাগাচ্ছিল; তখনি তখনি তাই প্রতিফলিত হচ্ছিল চিঠিতে। কথা কওয়ার অভ্যাস যাদের মজ্জাগত, কোথাও কৌতুক-কৌতূহলের একটু ধাক্কা পেলেই তাদের মুখ খুলে যায়। যে বকুনি জেগে উঠতে চায় তাকে টেকসই পণ্যের প্যাকেটে সাহিত্যের বড়ো হাটে চালান করবার উদ্যোগ করলে তার স্বাদের বদল হয়।
রবীন্দ্রশতবর্ষে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ‘বাক্পতি বিশ্বমনা’। স্মরণযোগ্য এই বিশেষণ। বিশ্বের কোনও কবি বা সাহিত্যিক বোধ হয় এত কথা লেখেননি। তাঁর রচনাবলির কথা বাদ দিচ্ছি। শুধু চিঠিই লিখেছেন পাঁচ হাজারের বেশি। ইংরেজি চিঠির সংখ্যা ধরলে ন’-দশ হাজার তো হবেই। প্রমথ চৌধুরীকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘রীতিমতো ভালো চিঠি লেখা খুব একটা দুরূহ কাজ। প্রবন্ধ লেখা সহজ— খুব একটা মোটা বিষয় নিয়ে অনর্গল কলম ছুটিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু চিঠিতে এমন সকল আভাস ইঙ্গিত নিয়ে ফলাতে হয় কেবল ভাবের চিকিমিকিগুলি মাত্র— যে, সে প্রায় কবিতা লেখার সামিল বললেই হয়। কিন্তু সে রকম চিঠি লেখার দিন কি আর আছে? এক সময় ছিল যখন চিঠি লেখাতেই একটা আনন্দ পেতুম এবং বোধ হয় চিঠি লিখে আনন্দ দিতেও পারতুম।’
চিঠি লিখে যে আনন্দ পেতেন, তার অজস্র প্রমাণের মধ্যে ‘ছিন্নপত্রাবলী’, ‘পথে ও পথের প্রান্তে’, ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ কিংবা হেমন্তবালাদেবীর কাছে লেখা চিঠির কথা অবশ্যই মনে পড়বে। ‘ছিন্নপত্র’-এ চিঠির প্রাপক ছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাদেবী। ‘পথে ও পথের প্রান্তে’র চিঠিগুলি লিখেছেন নির্মলকুমারী মহলানবিশকে এবং স্নেহাস্পদ রাণুকে লেখা চিঠির সংগ্রহ ‘ভানুসিংহের পত্রালী’। যৌবনে ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি’ কিংবা পরিণত বয়সে লেখা ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি’ও তো অজস্র চিঠির সমষ্টি। ১৯৩০-এ লেখা ‘রাশিয়ার চিঠি’ও তাই। এ সব ছা়ড়া আছে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত উনিশ খণ্ডে চিঠিপত্র। তার বাইরেও রয়েছে ভূরি পরিমাণ চিঠি— সংকলিত ও অসংকলিত। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours