তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
মধ্য যুগে বাংলা সাহিত্যে দুর্গা পূজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঢাকার বিখ্যাত ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে আছে দুই ধরনের স্থাপত্যরীতি মন্দির। প্রাচীনতমটি পঞ্চরত্ন দেবী দুর্গার, যা সংস্কারের ফলে মূল চেহারা হারিয়েছে। মন্দিরের প্রাচীন গঠন শৈলী বৌদ্ধ মন্দিরের মত। মনে করা হয়, খ্রীস্টীয় দশম শতকে এখানে বৌদ্ধ মন্দির ছিল, পরবর্তীতে কিভাবে সেন আমলে হিন্দু মন্দিরে তা রূপান্তরিত হয়েছিল, তা ইতিহাসে লেখা নেই। খ্রীস্টীয় ১১শ বা ১২শ শতক থেকে সেখানে কালী পূজার সাথে দুর্গা পূজাও হত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন খ্রীস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময়কার নির্মাণ শৈলীর সাথে এর স্থাপত্য কলার মিল পাওয়া যায় না বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। তবে বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের গঠন ও স্থাপনার নানা ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং সেখানেও কালী পূজার সাথে দুর্গা পূজা হত।
খ্রীস্টীয় ১১শ শতকে ‘অভিনির্ণয়’-এ, মৈথিলী কবি বিদ্যাপতির ’দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’তে দুর্গা বন্দনা পাওয়া যায়। বঙ্গে খ্রীস্টীয় ১৪শ শতকে দুর্গা পূজার প্রচলন ছিল কিনা ভালভাবে জানা যায় না। ঘটা করে দুর্গা পূজা চালুর আগে কিছু কিছু উচ্চ বর্ণ হিন্দুদের গৃহকোণে অত্যন্ত সাদামাঠা ভাবে ঘরোয়া পরিবেশে এই পূজা চালু ছিল। আর ঘটা করে দুর্গা পূজার ইতিহাস, খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। তবে কখন থেকে ঘটা করে এই পূজা চালু হল, তা নিয়ে পরিষ্কার বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক কোনও প্রমান পাওয়া যায় না। যতটুকু জানা যায় তা হল, কারও মতে, ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে দিনাজপুরের জমিদার প্রথম দূর্গা পূজা করেন। আবার কারও মতে, ষোড়শ শতকে রাজশাহী তাহেরপুর এলাকার রাজা কংসনারায়ণ প্রথম দুর্গা পুজা করেন। ১৫১০ সালে কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কোচবিহারে দুর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন। অনেকে মনে করেন, ১৬০৬ সালে নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দুর্গা পূজার প্রবর্তক। ১৬১০ সালে কলকাতার বড়িশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দুর্গা পূজার আয়োজন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। ১৬১০ সালে কলকাতার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার দুর্গার ছেলে মেয়ে সহ সপরিবারে পূজা চালু করেন।
১৬১০ সাল থেকে সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার বড়িশায় তাঁদের আদি বাসভবনে দুর্গা পূজার আয়োজন করে আসছেন। এটিই সম্ভবত কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গোৎসব। বর্তমানে এই পরিবারের সাত শরিকের বাড়িতে সাতটি দুর্গা পূজা হয়। এগুলির মধ্যে ছয়টি বড়িশায় ও একটি বিরাটিতে।
১৭১১ সালে অহম রাজ্যের রাজধানী রংপুরের শারদীয়া পূজার নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের দূত রামেশ্বর নয়ালঙ্কার।
নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌল্লার আক্রমনে কলকাতার একমাত্র চার্চ ধ্বংশ হবার পর সেখানে কোন উৎসব করার অবস্থা ছিল না। পলাশীর যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য ১৭৫৭ সালে কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নব কৃঞ্চদেব লর্ড ক্লাইভের সন্মানে দুর্গা পূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন।
পলাশীর যুদ্ধের চৌদ্দ বছর বাদে, ১৭৭১-এ, হলওয়েল সাহেব কলকাতার দুর্গা পূজাকে বলেছিলেন ‘গ্র্যান্ড জেনারেল ফিস্ট অব জেন্টুস’। এই গ্র্যান্ড জেনারেল ফিস্ট’-এর বাংলা করেছেন বিনয় ঘোষ ‘সবচেয়ে জমকালো উৎসব’। সেকালের কলকাতায় বাবুদের বাড়িতে দুর্গা ঠাকুর দেখার অধিকার আর সুযোগ সবার ছিল না। কেবল অতিথিরা সেখানে প্রবেশ করতে পারতেন। দারোয়ান দাঁড়িয়ে থাকত বাড়ির গেটে, হাতে চাবুক নিয়ে। অতিথি ছাড়া আর কেউ বাড়ির মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করলেই দারোয়ান তাকে চাবুক মারত। ফলে ঠাকুর দেখতে গিয়ে চাবুক খেয়ে ফিরে আসতে হতো গরিব-দুখীদের। অথচ সাহেবদের জন্য ছিল আপ্যায়নের বিপুল ব্যবস্থা। দুর্গোৎসব বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয় এই উৎসব সার্বজনীন হওয়ার পর। অথচ সার্বজনীন দুর্গা পূজা চালু হলে সাধারণ মানুষের কাছে এই পূজার আকর্ষণ বাড়ে। প্রথমে বাড়ির পূজা, তারপর বারোয়ারি পূজা, আর সবশেষে এসেছে সার্বজনীন পূজা। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Mahalaya Durgapuja)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours