তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রে প্রকৃতি, পরিবেশ, নন্দনতত্ত্ব, সৌন্দর্যতত্ত্ব, কাব্যতত্ত্ব, শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ, গ্রামগঠন— সমস্ত বিষয়েই কথাবার্তা আছে। আছে ব্যক্তিগত দুঃখবোধ, মৃত্যু চিন্তা, আনন্দ-হর্ষ, মুগ্ধতা, প্রেম, বাৎসল্য— সব কিছুই। কিন্তু কবির মৃত্যুর ৮০ বছর পেরোবার পরও তাঁর সমস্ত চিঠির হদিশ আমরা জানি না। অথচ বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের মতো একটি বড়সড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে— তারা কি পারে না চিঠিপত্রের বাকি খণ্ডগুলি তৈরি করতে!
শেষে একটি কথা পরিহাসছলে বলি, প্রশান্তকুমার পাল ঠাকুরবাড়ির হিসাবের খাতা ব্যবহার ও বিশ্লেষণ করে বহু অজানা তথ্যের সন্ধান দিয়েছেন। বিশ্ব ডাক দিবসে আমরা কি দাবি জানাতে পারি না যে, কবি সারা জীবনে পাঁচ-দশ হাজার চিঠি লিখে ডাক-তার বিভাগকে কত মাশুল জুগিয়েছেন— তার হিসাব নির্মাণের!
রবীন্দ্রনাথ সমগ্র জীবনে যে পরিমাণ চিঠি লিখেছেন এ পর্যন্ত কোনও সাহিত্যিক এত চিঠি লেখেননি।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিঠি পেতেও ভালবাসতেন লিখতেও ভালবাসতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম চিঠি লিখেছিলেন তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। সন-তারিখের হিসেবে সেটা সম্ভবত ২৩ অগস্ট ১৮৭০ (বাংলায় ৮ ভাদ্র ১২৭৭)। তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ১০ বছর ৩ মাস। আর শেষ চিঠি লেখেন ৩০ জুলাই ১৯৪১ (১৪ শ্রাবণ ১৩৮৪)। তখন তাঁর বয়স ৮১ বছর তিন মাস। চিঠি লেখার দিনটি ছিল বুধবার। শেষ চিঠিটি লিখেছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীকে।
জোড়াসাঁকো থেকেই তিনি প্রথম চিঠি লিখেছিলেন এবং শেষ চিঠিটিও লিখেছিলেন এই জোড়াসাঁকো থেকেই। রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংখ্যা প্রায় আট হাজার। ৭১ বছর ধরে দেশী ও বিদেশী ভাষায় সহস্রাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিঠি লিখেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র নিয়ে বেশ কয়েকটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল বিশ্বভারতীর ১৯ টি খন্ডে প্রকাশিত ‘চিঠিপত্র’ সংকলন। এতে ৭০ জনকে লেখা চিঠিপত্রের সংখ্যা হল ২৫৬৮ টি। অন্যদিকে ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ ও ‘ছিন্নপত্র’ মিলিয়ে মোট চিঠির সংখ্যা ২৭৮০। হিসেব মতো রবীন্দ্রনাথের ৬০ শতাংশ চিঠি এখনও সংকলিত করাই সম্ভব হয়নি। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, বিভিন্ন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়ে গেছে বহু চিঠি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিপুল সাহিত্য কর্মের মতোই তার চিঠিপত্রের সংখ্যাও বিপুল। তার সাহিত্য মূল্যের পাশাপাশি ঐতিহাসিক মূল্যও কম নয়। একবার ক্ষিতিমোহন সেনকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমার লেখার চেয়ে কম হবে না আমার চিঠি। প্রত্যেকের কাছে আমার স্টাইল ভিন্ন। কিছুতেই একজনকে অন্যের লেখা স্টাইলে লিখতে পারিনে।’
মহিলাদের লেখা রবীন্দ্রনাথের ১৪১৬ টি চিঠিপত্রের সংকলনকে এবার ৭৬ টি সিডির সংকলন করে প্রকাশ করল ‘ভাবনা রেকর্ডস অ্যান্ড ক্যাসেটস’— ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠিপত্র’ নাম দিয়ে। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি ভবনে ‘ভাবনা’-র কর্ণধার বিশ্ব রায়ের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সংকলনটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে তা সর্বসাধারণের জন্য প্রকাশ করেন।
চিঠিপত্রের মধ্যে দিয়ে যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা আবিষ্কার করি তিনি সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। বিষয়ী, সংসারী, তিনি অনেক কাছের মানুষ। চিঠিতে অম্লমধুর মন্তব্য, সরস টিপ্পনী, বিতর্ক, প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমেই মনের কথা বলেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘‘যারা ভাল চিঠি লেখে তারা মনের জানালার ধারে বসে লেখে, আলাপ করে যায়— তার কোনও ভারও নেই, বেগও নেই, স্রোত আছে। এইসব চলতি ঘটনার ’পরে লেখকের বিশেষ অনুরাগ থাকা চাই, তা হলেই তাঁর কথাগুলি পতঙ্গের মতো হালকা পাখা মেলে হাওয়ার উপর দিয়ে নেচে যায়। অত্যন্ত সহজ বলেই জিনিসটি সহজ নয়— ছাগলের পক্ষে একটুও সহজ নয় ফুলের থেকে মধু সংগ্রহ করা। ভারহীন সহজের রসই হচ্ছে চিঠির রস। সেই রস পাওয়া এবং দেওয়া অল্প লোকের শক্তিতেই আছে। পৃথিবীতে চিঠি লেখায় যারা যশস্বী হয়েছে তাদের সংখ্যা অতি অল্প। যে দু’-চারজনের কথা মনে পড়ে তারা মেয়ে।’’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি লেখার তালিকায় যে ২৯ জন মহিলা আছেন, এঁরা হলেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবী (৩৬ টি চিঠি), পুত্রবধূ প্রতিভা দেবী (১১৫ টি চিঠি), জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা দেবী (৫ টি চিঠি), কনিষ্ঠা কন্যা মীরা দেবী (৮১ টি চিঠি), দৌহিত্রী নন্দিতা দেবী (১০ টি চিঠি), জ্ঞানদানন্দিনী দেবী (১ টি চিঠি), নন্দিনী দেবী (১৯ টি চিঠি), অবলা বসু (৮ টি চিঠি), কাদম্বিনী দেবী (৯৯ টি চিঠি), নির্ঝরিনী দেবী (২৪ টি চিঠি), হেমন্তবালা দেবী (২৬৪ টি চিঠি), বাসন্তী দেবী (৩২ টি চিঠি), লেডি রাণু মুখোপাধ্যায় (২৬৭ টি চিঠি), সরযূবালা অধিকারী (৫ টি চিঠি), আশা অধিকারী (৪ টি চিঠি), যাদুমতী মুখোপাধ্যায় (১ টি চিঠি), ভক্তি অধিকারী (২ টি চিঠি), ইন্দিরা দেবী (৩৩৬ টি চিঠি), নির্মলাকুমারী মহলানবীশ (৫৯ টি চিঠি), অনিন্দিতা দেবী (২ টি চিঠি), জ্যোৎস্নিকা দেবী (১ টি চিঠি), সীতা দেবী (৫ টি চিঠি), সুধারানী দাস (১ টি চিঠি), উমারানী দাস (১ টি চিঠি), মীরা চৌধুরী (৮ টি চিঠি), ঈষিতা দেবী (১ টি চিঠি), অরুন্ধতী চট্টোপাধ্যায় (৬ টি চিঠি), রমা দেবী (২ টি চিঠি), শান্তা দেবী (২১ টি চিঠি)।
এইখানে শুধু মৃণালিনী দেবীকে লেখা কিছু চিঠি তুলে ধরছি পাঠকদের জন্য। প্রেক্ষাপট: মৃণালিনী দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের মোট চিঠি ছিল ছত্রিশ। কখনও শিলাইদহ থেকে, কখনও এলাহাবাদ, কালিগ্রাম, কুষ্টিয়া, কলকাতা, শান্তিনিকেতন, শাহজাদপুর। জমিদারি বা অন্যান্য কাজে বিভিন্ন সময় যখন স্ত্রী’র থেকে দূরে থাকতেন তখন দৈনন্দিনের নানা খুঁটিনাটি, কথাবার্তা, কুশল জিজ্ঞাসা এই চিঠি। তাতে বিভিন্ন আলোচনার পাশে জায়গা নিত প্রাত্যহিকের নানা ছোটখাটো ঘটনা — রান্নাবান্না, ছেলেমেয়ের খোঁজ-খবর, মিশে থাকত ভালোবাসা স্নেহ যত্ন। মৃণালিনীকে কবি ডাকতেন — ভাই ছুটি। চিঠির শেষে ছোট্ট করে লিখতেন, তোমার রবি।
সেদিনের সেই ‘রবি’-র সমবয়সী আজকের অস্ত — কবি অস্তনির্জন দত্ত। দিল্লিতে চাকরি… দীর্ঘদিন প্রবাসী। প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার দূরত্বের দেউলটিতে রয়ে যায় দুই সন্তান সহ তাঁর স্ত্রী। অস্তনির্জন চাকরি করেন, একা সময় কাটান, রান্না করেন, মোবাইল ঘাটেন আর এই সারাদিনের ফাঁকে-ফোঁকরে তাঁর সঙ্গী হয়ে ওঠে দেউলটির প্রাত্যহিক।
প্রবাসের প্রয়োজন, পরিস্থিতি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ এবং অস্তনির্জন হয়ত একই জায়গায় অবস্থান করেন না, তবু যে একটি শব্দ শতাধিক বর্ষের দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা এই দুই কবিকে একই পরিসরে এনে ফেলে তা হলো — প্রতীক্ষা। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours