তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

এদিকে এই পৃথিবীও বিপন্ন হয়ে উঠল। শতবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টিতে পৃথিবীর নদ-নদী, জলাশয় এমনকী কুয়ো পর্যন্ত শুকিয়ে গেল। অবস্থা দেখে শান্তচিত্ত ব্রাহ্মণরাও তপস্যা আরম্ভ করলেন শিবা-ভবানীর। দেবতা-ব্রাহ্মণদের স্তব এবং করুণ তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দেবী শক্তি এক অদ্ভুতরূপে তাঁদের সামনে আবির্ভূত হলেন। দেখা গেল— তাঁর অনত্ত চক্ষু, নীল পদ্মের পাপড়ির মতো টানা টানা শত শত আঁখিপাতে জল নিয়ে তিনি দেখা দিলেন—

অনন্তাক্ষিময়ং রূপং দর্শয়ামাস পার্বতী।

নীলাঞ্জনসমপ্রখ্যং নীলপদ্মায়তেক্ষণম্।।

তিনি চতুর্ভুজা মুর্তিতে ডান দিকের অধোহস্তে অনেকগুলি বাণ মুষ্টি পাকিয়ে ধরে আছেন, আর ডাইনে ওপরের হাতে পদ্ম। বাম দিকে ওপরের হাতে পুষ্প-পল্লব, ফল-মূল-শাক, আর বাম দিকের নীচের হাতটিতে ধনুক। এই অদ্ভুতরূপে সবার সামনে আসার পর তাঁর অনন্ত সংখ্যক চক্ষু দিয়ে বৃষ্টির ধারার মতো জল গড়াতে শুরু করল। তাতে পৃথিবীর সর্বস্থানে নয় দিন ধরে নিরন্তর বহুল বৃষ্টিপাত হল। নদ-নদী-কূপ-তড়াগ ভরে উঠল জলে। দেবতারা, মানুষেরা যে যেখানে আত্মগোপন করেছিল সবাই বেরিয়ে এসে দেবীর স্তব করতে করতে বললেন— আপনি যখন আমাদের এই অনাবৃষ্টির ভয় নিবারণ করার জন্য নিজ শরীরে শত শত অক্ষি (চক্ষু) ধারণ করেছেন, তাই আপনি শতাক্ষী নামে বিখ্যাত হবেন—

অস্মচ্ছান্ত্যর্থমতুলং লোচনানাং সহস্রকম্।

ত্বয়া যতো ধৃতং দেবি শতাক্ষী ত্বং ততো ভব।।

দেবতারা-ব্রাহ্মণেরা এবার মহাদেবীর স্তব করতে করতেই তাঁকে বললেন— আমরা খাবারদাবার পাইনি এতকাল, তাই ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর, আমাদের ভালো করে স্তব করার শক্তিটুকু পর্যন্ত নেই। হে অম্বিকে, হে মহেশানী! আপনি নিজগুণে কৃপা করে বেদের উদ্ধার সাধন করুন। দেবতা-ব্রাহ্মণদের মুখে এত করুণ আর্তি শুনে মহেশানী অম্বিকা তাঁর নিজের হাতে ধরে থাকা ফলমূল এবং শাক অর্থাৎ শক্তিদায়ী নানাপ্রকারের উদ্ভিদ দেবতা এবং মানুষদের দান করলেন। যতদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে নতুন শস্য-শাকের উৎপত্তি না হলো, ততদিন সেই দেবী সমস্ত মানুষকে আহারের উপযোগী নানা রস-সমৃদ্ধ খাদ্য এবং পৃথিবীর সমস্ত পশুদের ঘাস পাতার জোগান দিলেন তিনি। এই শাকান্ন দানের ফলেই মহেশানীর নতুন আর একটি নাম হল শাকম্ভরী—

নানাবিধানি চান্নানি পশুভোজ্যানি যানি চ।

কাম্যানন্তরসৈর্যুক্তান্যানবীনোদ্ভবং দদৌ।

শাকম্ভরীতি নামাপি তদ্দিনাং সমভূন্নৃপ।।

এইভাবে বৃষ্টি এবং পুষ্টিদায়ক খাদ্যলাভের পর দেবতা-মানুষ সকলের মধ্যে যখন আনন্দ-কোলাহল তৈরি হলো, তখন দূতের মুখে সব খবর পেলেন দুর্গমাসুর। দেবতাদের ওপর এবং ব্রাহ্মণদের ওপর শরবর্ষণ করতে আরম্ভ করলো। দেবী শতাক্ষী এই অবস্থায় চতুর্দিকে একটি তেজোময় বলয় তৈরি করে দেবতা ও ব্রাহ্মণদের প্রাথমিক সুরক্ষা প্রদান করলেন। তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে এলেন বহুতর শক্তি মুর্তি— কালী, তারা, মাতঙ্গী, মোহিনী, ছিন্নমস্তা এবং দশমহাবিদ্যা-সহ আরও অনেক শক্তি মুর্তি। দুর্গমাসুর এবং তাঁর সৈন্যবাহিনী দশ দিন ধরে যুদ্ধ করলেন মহাশক্তির বিভিন্ন রূপের সঙ্গে। দুর্গমাসুরের সৈন্যক্ষয় হয়ে গেল দশ দিনের মধ্যেই। এবার দুর্গমাসুর এলেন যুদ্ধ করতে, অন্যদিকে উপস্থিত হলেন মহাদেবী স্বয়ং। ভীষণ যুদ্ধ হলো দেবী এবং দৈত্যের। অবশেষে মারা গেলেন দুর্গম দৈত্য। ব্রহ্মাদি সমস্ত দেবতারা দেবী অম্বিকার স্তব করলেন। পরমতুষ্টা দেবী দেবতাদের কল্যাণ কামনা করে বললেন— দুর্গমাসুরকে আমি হত্যা করেছি বলে আজ থেকে আমার নাম হলো দুর্গা। এই দুর্গা নাম এবং শতাক্ষীর নাম যে গ্রহণ করবে, সে সমস্ত সাংসারিক মায়া জয় করতে পারবে—

দুর্গমাসুরহন্ত্রীত্বাদ্ দুর্গেতি মম নাম যঃ।

গৃহ্নাতি য শতাক্ষীতি মায়াং ভিত্ত্বা ব্রজত্যসৌ।।

শতাক্ষী, শাকম্ভরী, দুর্গা— এই তিনটি স্বরূপই ভগবতী মহাশক্তির কার্যভেদে তিনটি নাম; স্বরূপত তাঁদের মধ্যে কোনও ভেদ নেই বলেই দেবীভাগবতের টীকাদার শৈব নীলকণ্ঠ লিখেছেন— এখানে শতাক্ষী, শাকম্ভরী এবং দুর্গা— দেবতাদের যেহেতু এই তিন রূপে তিনি জলদান, অন্নদান এবং দৈত্যবধের উপকার সাধন করেছিলেন, তাই তিনটি হলো মহাদেবীর কর্মভেদ মাত্র এবং কর্মভেদের জন্যই তাঁর নামেও ভেদ হয়েছে, কিন্তু এগুলি তাঁর অবতার-ভেদ নয়।

দেবী ভাগবতের টীকাদার শৈব নীলকণ্ঠের কণ্ঠলগ্ন হয়েই আমরা দুর্গা নামের বহুল ব্যবহার এবং জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্ত শোনাতে চাই। খেয়াল করে দেখুন, নীলকণ্ঠ দুর্গার বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন শতাক্ষী-শাকম্ভরীর পরিণতি হিসেবে, আরও লৌকিক এবং জড়দৃষ্টিতে জলদান, অন্নদানের পর সেই অন্নপানে বাধা সৃষ্টিকারী অসুরনাশের পরিণতিতে। এর অর্থ মানুষের যত দুর্গতি হয় জলাভাবে খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায়, যে দুর্গতি হয় অনাহারে, অর্ধাহারে অথবা যে দুর্গতি তৈরি করে জাত বৈরী শত্রুরা, সেই দুর্গতি শতাক্ষীর করুণাঘন নয়নাশ্রু বৃষ্টিধারায় সিঞ্চিত করে, নতুন শস্য না ওঠা পর্যন্ত ফল-মূল-শাকম্ভরীর ক্ষুধার অন্ন দান করে— আনবীনোদ্ভবং দদৌ— অবশেষে অন্নপানের বাধাসৃষ্টিকারী দুর্গতির মূর্ত স্বরূপ দুর্গাসুরকে বধ করে দেবী হলেন দুর্গা— দুর্গা দুর্গতিনাশিনী।

আমরা এখানেই যেন বুঝতে পারছি যে, দুর্গ বা দুর্গম কোনও অসুর বা দৈত্য নন, আমাদের জীবন ধারণের যত দুর্গতি— যে দুর্গতি আমরা রোধ করতে পারি না, আমাদের কাছে যেটা দুর্গম, অসাধ্য, সেই দুর্গতিই আসলে দুর্গাসুর অথবা দুর্গম দৈত্য এবং সেই দুর্গতি নিঃশেষে যিনি দূর করে দেন, তিনিই দুর্গা। লক্ষণীয়, এই দুর্গাসুরের মধ্যেই মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর শুম্ভ-নিশুম্ভ-কাহিনীর রসাভাস আছে, আবার এই দুর্গার মধ্যেই মহিষাসুর-নিধন কালে হস্তী থেকে মহিষ, মহিষ থেকে পুনরায় অসুরের যোদ্ধা বেশের আরোপন ঘটেছে। এই দুর্গার মধ্যেই মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডীকার মতোই অন্যান্য শক্তি দেবতার উৎসারণ ভূমি। ফলত দুর্গতিনাশিনী দুর্গাই পরবর্তীকালে অন্যান্য শক্তি দেবতার, বিশেষত শরৎকালীন মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডীরও নামান্তর হয়ে উঠেছেন।

দুর্গা কি মাত্রিকা শক্তি  কালীর বিবর্তনের

পথ ধরে এসেছে। কারণ শক্তির আদি রূপ হলো

অব্যক্ত অদ্যাশক্তি কালী। দেবী কালী রূপে পূজিত

হলেও তাঁর রূপ দুর্গা কালী রূপী।

চিৎপুরের দুর্গা মন্দির এই কথারই সাক্ষ্য দেয়। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - name Durga)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours