তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

পৌরাণিক ইতিহাস গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুরী বলছেন, "দুর্গা নামটি বঙ্গদেশীয় শরৎকালীন দুর্গাপূজার সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছে বলেই প্রাথমিকভাবে আমাদের বলতে হচ্ছে যে, দুর্গাপূজার সময় আমরা যে মহিষাসুরমর্দিনীদেবীর পূজা করি, তিনি যতখানি দুর্গা, তার থেকে অনেক বেশি চণ্ডী বা চণ্ডিকা"।

এমন কি কালীর ও চন্ডী রূপ আছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ পাঠের শুরুতে তাই ‘নম চণ্ডী’র গান অথবা ‘নমশ্চণ্ডিকায়ৈ’ মন্ত্র।

দুর্গ, মতান্তরে দুর্গম নামক একটি অসুরকে শক্তিরূপিণী দেবী বধ করেছিলেন, তিনিই দুর্গা নামে কথিত হন। অন্যমতে যিনি দুর্গা উনি কালী। মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা এবং দুর্গাসুর বা দুর্গমাসুরনাশিনী দুর্গা মূল শক্তিস্বরূপে এক এবং অভিন্না হলেও তাঁরা লীলাভেদে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। এঁদের দুজনের আবির্ভাবের কাল, অসুরবধের লীলাস্থল এবং তাঁদের কাজও আলাদা আলাদা।

মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার আবির্ভাবের সময় হলো স্বায়ম্ভুব বা প্রথম মন্বন্তর, লীলাস্থল হিমালয় পর্বত এবং তার সানুদেশ, আর তাঁর কাজ মহিষাসুর বধ। আর দুর্গমাসুরনাশিনী দুর্গার আবির্ভাব-কাল বৈবস্বত মনুর কাল অর্থাৎ সপ্তম মন্বন্তর, তাঁর লীলাস্থল বিন্ধ্য পর্বত, এবং তাঁর কাজ দুর্গমাসুর নিধন করা বা দুর্গাসুর বধ। শেষোক্ত দুর্গাসুরনাশিনী দুর্গার সঙ্গে শক্তিদেবীর অন্য রূপ শাকম্ভরী, শতাক্ষীর গভীর যোগ আছে। আর আমরা বঙ্গদেশে শরৎকালীন যে দুর্গাপূজা করি, সেটি আসলে মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডীর পূজা— যা খুব সরলভাবে দুর্গাপূজা বলেই বিখ্যাত হয়েছে। তবে এই বিখ্যাত হবার কাজটাও আজকে হয়নি। কেন না বঙ্গদেশে দুর্গাপূজার সময় মার্কণ্ডেয় পুরাণের সাতশো শ্লোকের যে অংশটা আমরা মার্কণ্ডেয় চণ্ডী বা ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’ নামে পাঠ করি, সেই চণ্ডী কিন্তু অনেক আগে থেকেই দুর্গা-সপ্তশতী নামে পরিচিত, যার অন্য নাম দেবীমাহাত্ম্য কিংবা সপ্তশতী চণ্ডী। ইনি চন্ডী বা দুর্গার চন্ডী রূপ।

তবে দুর্গানামটি শক্তিরূপিণী দেবীর একটি সাধারণ নাম হিসেবে প্রচলিত হওয়ার রহস্যটা ওই দুর্গা নামের মধ্যেই নিহিত আছে। বস্তুত মানুষের মনের মধ্যে অহরহ বিপদ-মুক্তির যে প্রার্থনা থাকে, সেখানেই দুর্গা নামের জনপ্রিয়তা তৈরি হয়ে যায়। ‘দুর্গ’ শব্দের সাধারণ অর্থই হল সংকট, বিপদ। যে কোনওরকম বিপদ বা দুর্গ থেকে যিনি ত্রাণ করেন, তিনিই দুর্গা। এই ভয়, সংকট বিপন্নতা— যা দুর্গ শব্দের অর্থ— সেগুলি, তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতিতে কেমন ছিল, তার একটা বিবরণ দিয়ে ‘শব্দকল্পদ্রুম’ বলেছে— দুর্গ শব্দের অর্থ যেমন দৈত্য অর্থাৎ সেই দুর্গাসুর যেমন হতে পারে, তেমনই দুর্গ-শব্দের অর্থ মহাবিঘ্ন, দুর্গ মানে এই সংসারের মায়ার বাঁধন বা ভববন্ধন এবং দুর্গ মানে কুকর্ম—

দুর্গো দৈত্যে মহাবিঘ্নে ভববন্ধে কুকর্মণি।

মহাবিঘ্ন এবং ভববন্ধন থেকে মুক্তি পাবার জন্য দুর্গাকেই তো চিহ্নিত করা হয়েছে মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর মধ্যেই। এখানে দেবস্তবে বলা হয়েছে— তুমি দুর্গা, এই দুস্তর (দুর্গ) ভবসাগর পার হবার নৌকা হলে তুমি—

দুর্গাসি দুর্গভবসাগর-নৌরসঙ্গা

এই শ্লোকের পরে পরেই দেবতারা আবার বলছেন— হে দুর্গা, তোমাকে স্মরণ করা মাত্রই তুমি সমস্ত প্রাণীর ভয়ভীতি হরণ করে থাকো—

দুর্গে স্মৃতা হরসি ভীতিমশেষজন্তোঃ

এই শ্লোকের ‘দুর্গে’ শব্দটিকে সম্বোধন পদ হিসেবে না ধরে দুর্গ শব্দের সাধারণ অর্থ করলে মানে দাঁড়াবে— বিপদে-আপদে তোমার নাম স্মরণ করলেই তুমি সমস্ত প্রাণীর বিপদের ভয় দূর করে দাও।

দুর্গ শব্দের অর্থ মহাবিঘ্ন ধরে নিয়েই শব্দকল্পদ্রুম দুটি-তিনটি শ্লোক উদ্ধার করে বলেছে— দুর্গ শব্দের অর্থ মহাবিঘ্ন, সংসার-বন্ধন, কুকর্ম, শোক, দুঃখ, নরক, পরলোকে যমদণ্ডের ভয়, পুনর্জন্মের ভীতি, মহাভয়, অতিরোগ ইত্যাদি। আর এই মহাভয়াত্মক দুর্গ শব্দটির সঙ্গে ‘আ’ বর্ণটি ব্যবহৃত হয় হন্তা বা ‘নাশ করা’ অর্থে অর্থাৎ দুর্গ বা মহাভয়-বিঘ্নকে যিনি নাশ করেন, হত্যা করেন, তিনিই দুর্গা—

দুর্গে দৈত্যে মহাবিঘ্নে ভববন্ধে কুকর্মণি।

অন্য আর একটি পরম্পরাপ্রাপ্ত শ্লোকে দুর্গা শব্দের বর্ণবিভাগ করে শব্দকল্পদ্রুম জানিয়েছে— দুর্গা শব্দে ‘দ’ বর্ণটি ব্যবহার করা হয়েছে, যেহেতু তিনি দৈত্য নাশ করেন, উ-কার ব্যবহৃত হয়েছে বিঘ্ন নাশ করেন বলে, আর এখানে রেফ বা র-বর্ণের অর্থ তিনি রোগ নাশ করেন, আর ‘গ’ বর্ণের অর্থ তিনি পাপ নাশ করেন— এই সম্পূর্ণ দুর্গ-পদটির সঙ্গে আ-কার ব্যবহার করার অর্থ হলো— তিনি ভয়, শত্রু, সব কিছু নাশ করেন, কেননা আকার বর্ণটাই নাশবাচক—

দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ।

উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মতঃ।।

রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচকঃ।

ভয়-শত্রুঘ্নবচন আকারঃ পরিকীর্তিতঃ।।

অবশেষে দুর্গা শব্দের সবচেয়ে সাধারণ অর্থ এটাই যে, দুর্গা সব প্রকারের দুর্গতি নাশ করেন—

দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - name Durga)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours