তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

মৃণালিনীদেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি:

ভাই ছুটি

আজ ঢাকা থেকে ফিরে এসে তোমার চিঠি পেলুম। আমি তাহলে একবার শীঘ্ৰ কালিগ্রামের কাজ সেরে কলকাতায় গিয়ে যথোচিত বন্দোবস্ত করে আসব। কিন্তু ভাই, তুমি অনৰ্থক মনকে পীড়িত করো না। শান্ত স্থির সন্তুষ্ট চিত্তে সমস্ত ঘটনাকে বরণ করে নেবার চেষ্টা কর। এই একমাত্র চেষ্টা আমি সৰ্বদাই মনে বহন করি এবং জীবনে পরিণত করবার সাধনা করি। সব সময় সিদ্ধিলাভ করতে পারিনে— কিন্তু তোমরাও যদি মনের এই শান্তিটি রক্ষা করতে পারতে তাহলে বোধ হয় পরস্পরের চেষ্টায় সবল হয়ে আমিও সন্তোষের শান্তি লাভ করতে পারতুম। অবশ্য তোমার বয়স আমার চেয়ে অনেক অল্প, জীবনের সর্বপ্রকার অভিজ্ঞতা অনেকটা সীমাবদ্ধ, এবং তোমার স্বভাব এক হিসাবে আমার চেয়ে সহজেই শান্ত সংযত এবং ধৈর্য্যশীল। সেইজন্যে সৰ্ব প্রকার ক্ষোভ হতে মনকে একান্ত যত্নে রক্ষা করবার প্রয়োজন তোমার অনেক কম। কিন্তু সকলেরই জীবনে বড় বড় সঙ্কটের সময় কোন না কোন কালে আসেই– ধৈৰ্য্যের সাধনা, সন্তোষের অভ্যাস কাজে লাগেই। তখন মনে হয় প্রতিদিনের যে সকল ছোট খাটো ক্ষতি ও বিঘ্ন, সামান্য আঘাত ও বেদনা নিয়ে আমরা মনকে নিয়তই ক্ষুব্ধ ও বিচলিত করে রেখেছি সে সব কিছুই নয়। ভালবাসব এবং ভাল করব— এবং পরস্পরের প্রতি কৰ্তব্য সুমিষ্ট প্রসন্নভাবে সাধন করব— এর উপরে যখন যা ঘটে ঘটুক। জীবনও বেশি দিনের নয় এবং সুখদুঃখও নিত্য পরিবর্তনশীল। স্বার্থহানি, ক্ষতি, বঞ্চনা — এ সব জিনিষকে লঘুভাবে নেওয়া শক্ত, কিন্তু না নিলে জীবনের ভার ক্রমেই অসহ্য হতে থাকে এবং মনের উন্নত আদর্শকে অটল রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই যদি না হয়, যদি দিনের পর দিন অসন্তোষে অশান্তিতে, অবস্থার ছোট ছোট প্রতিকূলতার সঙ্গে অহরহ সংঘর্ষেই জীবন কাটিয়ে দিই — তা হলে জীবন একেবারেই ব্যর্থ। বৃহৎ শাস্তি, উদার বৈরাগ্য, নিস্বার্থ প্রীতি, নিষ্কাম কর্ম— এই হল জীবনের সফলতা। যদি তুমি আপনাতে আপনি শান্তি পাও এবং চার দিককে সান্তনা দান করতে পার, তাহলে তোমার জীবন সাম্রাজ্ঞীর চেয়ে সার্থক। ভাই ছুটি— মনকে যথেচ্ছ খুৎখুৎ করতে দিলেই সে আপনাকে আপনি ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। আমাদের অধিকাংশ দুঃখই স্বেচ্ছাকৃত। আমি তোমাকে বড় বড় কথায় বক্তৃত দিতে বসেছি বলে তুমি আমার উপর রাগ করো না। তুমি জান না অন্তরের কি সুতীব্র আকাঙ্খার সঙ্গে আমি এ কথাগুলি বলছি। তোমার সঙ্গে আমার প্রীতি, শ্রদ্ধা এবং সহজ সহায়তার একটি সুদৃঢ় বন্ধন অত্যন্ত নিবিড় হয়ে আসে, যাতে সেই নিৰ্ম্মল শান্তি এবং সুখই সংসারের আর সকলের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে, যাতে তার কাছে প্রতিদিনের সমস্ত দুঃখ নৈরাশ্য ক্ষুদ্র হয়ে যায়— আজ কাল এই আমার চোখের কাছে একটা প্রলোভনের মত জাগ্রত হয়ে আছে। স্ত্রী-পুরুষের অল্প বয়সের প্রণয়মোহে একটা উচ্ছ্বসিত মত্ততা আছে কিন্তু এ বোধ হয় তুমি তোমার নিজের জীবনের থেকেও অনুভব করতে পারছো— বেশি বয়সেই বিচিত্র বৃহৎ সংসারের তরঙ্গ দোলার মধ্যেই স্ত্রী-পুরুষের যথার্থ স্থায়ী গভীর সংযত নিঃশব্দ প্রীতির লীলা আরম্ভ হয়— নিজের সংসার বৃদ্ধির সঙ্গে বাইরের জগৎ ক্রমেই বেশি বাইরে চলে যায়— সেইজন্যেই সংসার বৃদ্ধি হলে এক হিসাবে সংসারের নির্জনতা বেড়ে ওঠে এবং ঘনিষ্ঠতার বন্ধনগুলি চারদিক থেকে দুজনকে জড়িয়ে আনে। মানুষের আত্মার চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই, যখনই তাকে খুব কাছে নিয়ে চিঠিপত্র এসে দেখা যায়, যখনই তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ মুখোমুখি পরিচয় হয় তখনই যথার্থ ভালবাসার প্রথম সূত্রপাত হয়। তখন কোন মোহ থাকে না, কেউ কাউকে দেবতা বলে মনে করবার কোন দরকার হয় না, মিলনে ও বিচ্ছেদে মত্ততার ঝড় বয়ে যায় না— কিন্তু দূরে নিকটে সম্পদে বিপদে অভাবে এবং ঐশ্বর্যে একটি নিঃসংশয় নির্ভরের একটি সহজ আনন্দের নিৰ্ম্মল আলোক পরিব্যাপ্ত হয়ে থাকে। আমি জানি তুমি আমার জন্যে অনেক দুঃখ পেয়েছ, এও নিশ্চয় জানি যে আমারই জন্যে দুঃখ পেয়েছ বলে হয়ত একদিন তার থেকে তুমি একটি উদার আনন্দ পাবে। ভালবাসায় মার্জন এবং দুঃখ স্বীকারে যে সুখ, ইচ্ছাপূরণ ও আত্মপরিতৃপ্তিতে সে সুখ নেই। আজকাল আমার মনের একমাত্র আকাঙ্খা। এই, আমাদের জীবন সহজ এবং সরল হোক, আমাদের চতুর্দিক প্রশান্ত এবং প্রসন্ন হোক, আমাদের সংসার যাত্রা আড়ম্বর-শুন্য এবং কল্যাণপূর্ণ হোক, আমাদের অভাব অল্প উদ্দেশ্য উচ্চ চেষ্টা নিঃস্বার্থ এবং দেশের কার্য আপনাদের কাজের চেয়ে প্রধান হোক— এবং যদি বা ছেলেমেয়েরাও আমাদের এই আদর্শ থেকে ভ্ৰষ্ট হয়ে ক্রমশঃ দূরে চলে যায় আমরা দুজনে শেষ পর্যন্ত পরস্পরের মনুষ্যত্বের সহায় এবং সংসার ক্লান্ত হৃদয়ের একান্ত নির্ভরস্থল হয়ে জীবনকে সুন্দরভাবে অবসান করতে পারি। সেইজন্যেই আমি কলকাতার স্বার্থ দেবতার পাষাণ মন্দির থেকে তোমাদের দূরে নিভৃত পল্লীগ্রামের মধ্যে নিয়ে আসতে এত উৎসুক হয়েছি— সেখানে কোনমতেই লাভক্ষতি আত্মপরকে ভোলবার যে নেই— সেখানে ছোটখাট বিষয়ের দ্বারা সৰ্বদা ক্ষুব্ধ হয়ে শেষ কালে জীবনের উদার উদেশ্যকে সহস্ৰ ভাগে খণ্ডীকৃত করতেই হবে। এখানে অল্পকেই যথেষ্ট মনে হয় এবং মিথ্যাকে সত্য বলে ভ্রম হয় না। এখানে এই প্রতিজ্ঞ। সৰ্বদা স্মরণ রাখা তত শক্ত নয়, যে—

সুখং বা যদিবা দুঃখং প্রিয়ং বা যদিবাপ্রিয়ংপ্রাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতা।

তোমার রবি।

প্রমথ সুরেন এবং প্রমথদের একটি গুজরাটী বন্ধু শিলাই-দহে আছে।

[ শিলাইদহ, জুন, ১৮৯৮]

প্রিয় ছুটি,

বিহারি আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পড়ে গেল। আমি জানি তুমি আমার ওপর রাগ করেছ, রাগ করো না। এই দূরে, প্রবাসে পড়ে থাকা কোনভাবেই স্বতঃস্ফূর্ত নয়, আর জীবন এতটাও সহজ হয়ত না যে চাইলেই আমি তোমার কাছে যেতে পারি। কলকাতায় একটা কাজ পেতে পারি। আমি খুব যে চেষ্টা করেছি তা নয় কিন্তু আমি যেটুকু করেছি… কলকাতা আমাকে নেয়নি। কর্পোরেট বলে একটা শব্দ আছে… শব্দ হয়, বাজে ওয়ার্ক কালচার বলে একটা শব্দ আছে… শব্দ হয়, বাজে।

ছুটি, বিহারি আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পড়ে গেল। ওর চায়ের কেটলি ছিটকে গেল।

সোসিও ইকনমিক বলে একটা শব্দ আছে… শব্দ হয়, বাজে। 

এটা এমন নয় যে আমি তোমার সঙ্গে মেয়েদের সঙ্গে থাকতে চাহিনি… তুমি আমায় বোঝ নিশ্চয়,  দূরে দূরে এই যে অসহায় আমি একা একা চুপ করে আছি…

হয়ত কখনও আমার ভাল লাগে না… জিরাফ মনে হয়, ভাষা হীন। আমি বুজতে পারি না তোমাকে ঠিক কি বলতে চেয়েছিলাম… 

মাঝে মাঝে মনে হয় আমি কি অভ্যস্ত হয়ে গেছি… গেলাম!

ছুটি, বিহারি আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পড়ে গেল। ওর চায়ের কেটলি ছিটকে গেল। গরম চা। প্লাস্টিকের কাপ।

তোমার মনে আছে, বিয়ের দুই বছর আমি কোন চাকরি করিনি, কবিতার বই বগলে ঘুরতাম, তোমার টিউশন-এর টাকায় মুড়ি ঘুগনি খেতাম সকাল সকাল। সবাই বলত, ঘরকুনো… ছিঃ ছিঃ… ও করবে চাকরি…!

ভাই, ছুটি… পেটের দায়ে সেই যে ঘর ছাড়লেম, ফেরা আর হল না! সেই শিলিগুড়ি থেকে টাটা থেকে দিল্লি… আমি ছুটেই গেলাম। কতই বা ডিসটান্স

আমাকে ভাষা নিল না। রিজেক্ট করল।

আমাকে সংসার নিল না। রিজেক্ট করল।

আমাকে খাবারের অভ্যাস নিল না। রিজেক্ট করল।

আমাকে যৌনতা নিল না। রিজেক্ট করল।

ছুটি আমি এখন কি ভাল মুগের ডাল করতে পারি, কাঁচা লঙ্কা আর জিরের ফোড়ন দিয়ে। আমি ভাত খেতে বসে দেখি… তোমাদের রাতের খাওয়া শেষ হয়েছে আর বাসন ধোয়া রঙ নিয়ে তুমি পুকুর পাড়ে বসে আছ।

আমাকে কবিতা নিল না। রিজেক্ট করল।

বিহারি আমাকে অনেকটা বুঝত! কাজের চাপে যখন দুপুরের খাওয়া হত না, বিহারি তার রুটি আমাকে দিয়ে বলত, দাদা খাইয়ে… ঘর কা বানায়া, ইয়ে তরি কা সব্জি…

ছুটি বিহারি আমার সামনে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে কথা বলতে বলতে পড়ে গেল। ওর কেটলি, গরম চা, প্লাস্টিকের কাপ। পড়ে গেল। 

ছুটি রাগ করো না …যত দূরেই থাকি…আমার  যেটুকু যতটুকু ফেরা তোমার কাছেই ফেরা… ভ্রমণ বলতে বাড়ির দিকে যাওয়া বুঝি, আমি মাঝে মঝে এমনিই আইআরসিটিসি’তে ট্রেন-এর আভেলেবিলিটি চেক করি, টিকিট বুক করি আর সেই যাওয়ার দিন চোখ বুজে দেখি এক খালি সিট দুলে দুলে একা খড়গপুর চলেছে …ট্রেন পেরিয়ে যাচ্ছে  আলিগড় … ট্রেন পেরিয়ে যাচ্ছে মুঘল সরাই …কোন এক শীত ভোর ও কুয়াশায় রেল লাইন-এ আমার যাওয়ার ফেরোমেন ছিটিয়ে আছে …ছুটি…

তোমায় বলা হয়নি …আমি কড়ি চাউল বানাতে শিখে গেছি …

এখানে ভীষণ গরম পড়েছে এখন ছুটি, একদিন  বিহারি আমার সামনে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে কথা বলতে বলতে পড়ে গেল। ওর কেটলি, গরম চা, প্লাস্টিকের কাপ। নোকিয়ার ১১০০ মোবাইল পড়ে গেল।

আমি বিহারির চায়ের ঠেলায় গিয়ে ফিরে আসতাম। ওর ঠেলার ওপর একটা ঘন সোয়াতুঁদ গাছ আছে …আমি তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে ফিরে আসতাম। বিহারি আসত না।

অপেক্ষা বলে একটা শব্দ আছে … শব্দ হয়, বাজে।

আমাকে প্রত্যাশা নিল না। রিজেক্ট করল।  

সোয়াতুঁদ গাছে ছোট ছোট ফল হয়, খয়েরি রঙের, সোয়াতুঁদ গাছের নিচে একদিন আমি দেখলাম বিহারি এসেছে… একটু ক্লান্ত…একটু রোগা বিহারি কেতলি প্লাস্টিকের কাপ-এর চা নিয়ে ফিরে এসেছে। আমাকে ডাকল আও আও… দাদা…হসপিটাল পে থা… অন্দর সিলোন হো গায়া থা…   

ছুটি, সিলোন শব্দটায় জল ভরে থাকে। আমি বুঝতে পারি সিলোন কোথাও আমাকেও ছুঁয়ে রেখেছে আমি নিচু হয়ে দেখি মেয়েরা জল ছিটিয়ে খেলা করছে, নৌকা ছাড়ছে আর ফোনে বলছে কবে আসবে ?

দিন যায়, রাত যায়, ছুটি আমি কাজ করি, কাজ শেষ করি আর কাজ এসে যায়।

সোয়াতুঁদ গাছের তলায় বিহারি নিচু হয়ে কেটলির ওপর ঝুঁকে থাকে, আমি দেখি, আমি তার বেঁকে যাওয়া সিলোনের ভেতর চা পাতি, চিনি ও দুধ দিয়ে অনন্ত কাল চামচ ঘুরিয়ে যাই।

ইতি,

তোমার রবি… (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours