তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
রবীন্দ্রনাথ খুবই কম কথা বলতেন, উনি উপলব্ধি
করেছিলেন উনি বলতে আসেননি, লিখতে এসেছিলেন। উনি যা দেখতেন, যা শুনতেন তাঁকে নিজের উপলব্ধিতে সাজিয়ে এক আন্তরিক দার্শনিক স্তরে পেশ করতেন।
উনি ছিলেন এক অদ্ভুত ব্লটিং পেপার, যা দেখতেন উনার বিশ্বজনীন ও ব্যক্তিগত দৃষ্টি দিয়ে তা শুষে নিতেন যা আজকের ডিজিটাল টেকনোলজিকেও হার মানায়। উনার চিঠি পত্র তাঁরই প্রমান। আজকে চিঠির যুগ নেই, অপেক্ষা নেই, তাই হয়তো ভালোবাসার গভীরতা নেই।
উনার চিঠি শুধু চিঠি নয়, এ এক আন্তর্জাতিক সাহিত্যি। উনি সংগীত নিয়ে যে চিঠি লিখেছেন সংগীতজ্ঞ ধূর্জটি মুখোপাধ্যায়কে, তা শুধু অনবদ্য নয়, এক বিরাট শিক্ষা ভান্ডারের পরিচয় দেয়। আজ সেই সব আলোচনা করবো না, আজ তাঁর যে পত্র সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের অন্যতম প্রধান অঙ্গ- কৃতি হিসেবে তাঁর গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, গীতির চেয়ে কোনও অংশেই কম নয়।
পত্রের একটা অতি বিশিষ্ট ভূমিকা কবি ব্যাখ্যা করেছেন ছিন্নপত্রের ১৪১-সংখ্যক পত্রে, যেটি পুরোপুরিই উদ্ধৃতিযোগ্য:
পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়। চিঠির দ্বারা পৃথিবীতে একটা নূতন আনন্দের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মানুষকে দেখে যতটা লাভ করি, তার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে যতটা লাভ করি, চিঠিপত্র দ্বারা তার চেয়ে আরও একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি। চিঠিপত্রে যে আমরা কেবল প্রত্যক্ষ আলাপের অভাব দূর করি তা নয়, ওর মধ্যে আরও একটু রস আছে যা প্রত্যক্ষ দেখা-শোনায় নেই। মানুষ মুখের কথায় আপনাকে যতখানি ও যে রকম করে প্রকাশ করে লেখার কথায় ঠিক ততখানি করে না। আবার লেখায় যতখানি করে মুখের কথায় ততখানি করতে পারে না। এই কারণে, চিঠিতে মানুষকে দেখবার এবং পাবার জন্য আরও একটা যেন নতুন ইন্দ্রিয়ের সৃষ্টি হয়েছে। আমার মনে হয়, যারা চিরকাল অবিচ্ছেদে চব্বিশ ঘণ্টা কাছাকাছি আছে, যাদের মধ্যে চিঠি লেখালেখির অবসর ঘটেনি, তারা পরস্পরকে অসম্পূর্ণ করেই জানে। যেমন বাছুর কাছে গেলে গরুর বাঁটে আপনি দুধ জুগিয়ে আসে তেমনি মনের বিশেষ বিশেষ রস কেবল বিশেষ বিশেষ উত্তেজনায় আপনি সঞ্চারিত হয়, অন্য উপায়ে হবার জো নেই। এই চার পৃষ্ঠা চিঠি মনের যে রস দোহন করতে পারে, কথা কিম্বা প্রবন্ধ কখনওই তা পারে না। আমার বোধ হয় ওই লেফাফার মধ্যে একটি সুন্দর মোহ আছে- লেফাফাটি চিঠি প্রধান অঙ্গ, ওটা একটা মস্ত আবিষ্কার।
কিন্তু মনের বিশেষ রস নিঃসরণের জন্যে বিশেষ পাত্র-পাত্রী চাই, যাকে উপলক্ষ করে রসটি স্বতঃনিসৃত হয়। ১৬ অক্টোবর ১৯৩৩ সালে শ্রীমতী হেমন্তবালা দেবীকে লিখিত পত্রে (পত্র সংখ্যা ১৪২, চিঠিপত্র, নবম খ-) রবীন্দ্রনাথ লিখছেন :
তোমাকে উপলক্ষ্য করে আমি অনেক কথা বলি কিন্তু তোমাকে বলি নে। দেশের অসীম দুর্গতির কথায় মন যখন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তখন চুপ করে থাকতে পারি নে।…দেশের জন্যে আমি তোমাকেও ভাবাতে চাই।
বিশ্ব মুসলিম সমাজের সৌভ্রাতৃত্বের তুলনায় হিন্দুজাতের ধর্মে ও নিরর্থক আচারে শতধা বিভক্তির দুর্বলতা এই পত্রের উপজীব্য। এমনি হাজারও বিষয়ে বক্তব্য, মন্তব্য, ভাষা, ব্যাখ্যা উপযোগী কোনও সম্বোধিতকে উপলক্ষ করে কবি হাজারও পত্রে লিখে গিয়েছেন। অবিশ্বাস্য প্রাচুর্যের আধার অজস্র ধারার পত্রাবলীতে রবীন্দ্রনাথ কখনও দেশকে-জাতিকে, কখনও চলমান ক্ষণকে, কখনও সদা সক্রিয় মনকে, কখনও মনের খেয়াল-খুশিকেই বিশ্বস্তরূপে রেকর্ড করে গিয়েছেন।
এবারে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও জনপ্রিয় ছিন্নপত্র প্রসঙ্গ। শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা আটখানি চিঠিসহ, ১৮৮৭-১৮৯৫ সালে শ্রীমতী ইন্দিরা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত পত্র লিখেছেন, ১৫৩ টি পত্র-সংকলিত গ্রন্থখানি তা থেকে সংকলন। এ সময়ে লিখিত চিঠিপত্র (সব চিঠি নয়) ইন্দিরা দেবী দুটি খাতায় স্বহস্তে নকল করে কবিকে উপহার দিয়েছিলেন। এই খাতা দুটি অবলম্বনে, অনুলেখিকা অথবা পত্রকার স্বয়ং যতটা সঙ্কলন যোগ্য মনে করেছিলেন তাই নিয়ে ১৩১৯ সালে ছিন্নপত্র প্রকাশিত হয়। বহু চিঠিই রবীন্দ্রনাথ তখন গ্রন্থভুক্ত করেননি; অনেক পত্রের কোনও কোনও অংশ সাধারণের সমাদর যোগ্য নয় মনে করেও বর্জন করেন। মূল খাতা-দুখানি অবলম্বনে ১৯৬০ সালে ছিন্নপত্রাবলী নামে যে গ্রন্থখানি প্রকাশিত হয়, তাতে পাওয়া যাবে বর্জিত অনেকগুলি পত্র এবং পত্রাংশ। (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours