তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

শব্দকল্পদ্রুমে দুর্গা শব্দটার প্রধান অর্থ প্রকাশ করা হয়েছে বর্ণ ভেঙে প্রত্যয় যুক্ত করে। সমস্ত প্রকার দুর্গতি নাশের এই অর্থ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে উল্লিখিত হয়েছে। আরও লক্ষণীয়, মহাভারতে অজ্ঞাতবাসের জন্য বিরাট নগরে প্রবেশ করার আগে সমস্ত বিপদ থেকে মুক্তি পাবার জন্য পাণ্ডবরা যে শক্তি-দেবতার স্তুতি করলেন— তিনি কিন্তু দুর্গা— অগমন্মনসা দেবীং দুর্গাং ত্রিভুবনেশ্বরীম্। যুধিষ্ঠির-কৃত এই দুর্গাস্তুতির মধ্যে দেবীর সমস্ত রূপেরই বর্ণনা আছে প্রায়। এই বর্ণনার ক্রমে যখন দুর্গার নামটি এসেছে, তখন যুধিষ্ঠির বলেছেন— তুমি সমস্ত বিপদ-আপদ-ভয় থেকে ত্রাণ করো বলেই তোমাকে লোকে দুর্গা বলে। যারা অরণ্য-কান্তারের মধ্যে পথ হারিয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, যারা মহাসমুদ্রে মগ্ন হয় (সংসার-সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে), দস্যুরা যাঁদের বন্দি করেছে— তাদের সকলের গতি তুমি। এমন সংকটাপন্ন অবস্থাতেও যদি তোমাকে কেউ স্মরণ করে, তারা কিন্তু আর বিপন্ন হয় না—

দুর্গাত্তারয়সে দুর্গে তস্মাদ্ দুর্গা স্মৃতা জনৈঃ।

দুর্গ বা বিপদ থেকে ত্রাণ করেন বলেই তাঁর নাম দুর্গা— মহাভারতের এই কথাটার প্রতিধ্বনি আছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এবং মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে। ব্রহ্মবৈবর্তে তিনি ‘দুর্গে দুর্গতিনাশিনী’। দুর্গানাম স্মরণ করলেই তিনি দুর্গতি থেকে ত্রাণ করেন—

নারায়ণি মহাভাগে দুর্গে দুর্গতিনাশিনি।

আর দুর্গাসপ্তশতী চণ্ডীতে স্তুতি করে বলা হচ্ছে— হে দেবী! তুমি আমাদের সকল ভয় থেকে পরিত্রাণ করো, তাই দেবী দুর্গা হে! তোমাকেই প্রণাম করছি—

ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো দেবি দুর্গে নমো’স্তুতে।

দুর্গার এই রক্ষাদায়িনী, ত্রাণকারিণী ভূমিকা থেকেই সেকালে রাজারা শত্রুর পক্ষে অভেদ্য যে দুর্গগুলি তৈরি করতেন, সেই দুর্গের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা হিসেবে দুর্গার মুর্তি প্রতিষ্ঠা করতেন। দুর্গা হলো বিপদ তারিণী মাতা। ফলত একটি অভেদ্য, দুরধিগম্য দুর্গ যেভাবে রাজাকে সুরক্ষা দেয়, সেই দুর্গের ভাবনা থেকেই দুর্গার সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করেন। দেবী পুরাণে দেবী দুর্গাকেই দুর্গের রক্ষাকর্ত্রী দুর্গেশ্বরী বলে সম্বোধন করা হয়েছে এবং রাজা-রাজরাদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, দুর্গগুলিতে তাঁরা যেন মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার মূর্তি স্থাপন করেন— কেননা দুর্গের মধ্যে অবস্থিত হয়েই তিনি পরাক্রম দেখান—

দুর্গা এইখানে পাহারাদার। যে দুর্গকে রক্ষা করে সেই দুর্গা।

ত্বং হি দুর্গে মহাবীর্যে দুর্গে দুর্গপরাক্রমে।

দেবীভাগবত পুরাণে দুর্গ শব্দটি ব্যবহার না করে বহুদুর্গসমন্বিত কাশী নগরীর উল্লেখ করে বলা হয়েছে— দেবী দুর্গা যেন নগরে স্থিত হয়ে নগরকে রক্ষা করেন। কাশীর রাজা সুবাহু দুর্গার কাছে প্রার্থনা জানিয়ে বলছেন— আপনি সেই পরমা শক্তি। আপনি দুর্গা দেবী নামে বিখ্যাত হয়ে সব সময় এ বারাণসী নগরীতে অবস্থান করবেন এবং চিরকাল রক্ষা করবেন এই বারাণসী নগরীকে—

নগরে’ত্রত্বয়া মাতঃ স্থাতব্যং মম সর্বদা।

দুর্গাদেবীতি নাম্না বৈ ত্বং শক্তিরিহ সংস্থিতা।।

দেবীভাগবত পুরাণের এই শ্লোকটিতে যে নগরী শব্দটি বলা হলো, এই নগরী, নগর, পুরী আসলে দুর্গেরই নামান্তর। এটা বোঝা যাবে সপ্তাঙ্গ রাষ্ট্রের সাতটি অঙ্গের মধ্যে অন্যতম অঙ্গ দুর্গকে অনেকেই ‘পুর’ বলে অভিহিত করেছেন। স্বয়ং মনুই বলেছেন পুর। কিন্তু দুর্গ তৈরি করার সঙ্গে নগর-নির্মাণের একটা বড় সম্বন্ধ আছে বলেই কৌটিল্য দুর্গ নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গেই নগর নির্মাণের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। ফলে দেবীভাগবতে দেবী দুর্গাকে বারাণসী নগরীর রক্ষাকর্ত্রী বা পালিকা হিসেবে দেখতে চাইছেন রাজা, সেটা আসলে বারাণসীর দুর্গপালিকার কথা।

যে বারাণসী নগরীতে নগরপালিকা হিসেবে দুর্গার কথা বলা হলো, বারাণসী বা কাশীর সুরক্ষা নিয়ে স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে স্বয়ং মহাদেব তাঁর পরিচর নন্দীকে আদেশ দিয়ে বলছেন— কাশী নগরী রক্ষার জন্য প্রতিটি দুর্গে দুর্গামূর্তি স্থাপন করো—

প্রতিদুর্গং দুর্গারূপাঃ পরিতঃ পরিবাময়।

প্রভু মহাদেবের আদেশ পেয়ে নন্দীও প্রতিটি দুর্গে দুর্গামূর্তি স্থাপন করেছেন—

আহূয় সর্বতো দুর্গাঃ প্রতিদুর্গং ন্যবেশয়ৎ।

রাজা-রাজরাদের দুর্গের মধ্যে দুর্গামূর্তি প্রতিষ্ঠা করার এই পৌরাণিক নির্দেশ কিন্তু এমন একটা ইঙ্গিত দেয় যে, দুর্গরক্ষিণী দেবী হিসেবেই দুর্গার প্রথম রূপকল্পনা হয়েছিল।

দুর্গা নামের আর একটি অন্যতম প্রসিদ্ধ উৎস হল—মহাশক্তিরূপিণী দেবী দুর্গম বা দুর্গ নামে এক অসুরকে বধ করেছিলেন বলেই তাঁর নাম হয়েছে দুর্গা। দেবীভাগবত পুরাণ এবং স্কন্দ পুরাণের কাশী খণ্ডে এই দুর্গ বা দুর্গমাসুর বধের কাহিনি বিবৃত হয়েছে— যদিও স্কন্দপুরাণের কাহিনিতে দুর্গাসুরের সঙ্গে মার্কণ্ডেয় পুরাণের শুম্ভ-নিশুম্ভ দৈত্যের ব্যবহারিক মিল পাওয়া যায় কিছু; আর দেবীভাগবতের কাহিনিতে দুর্গার সঙ্গে শতাক্ষী এবং শাকম্ভরী দেবীর একটা পর্যায়ক্রমিক একাত্মতা তৈরি হয়।

দেবীভাগবত পুরাণে দুর্গম বা দুর্গ দৈত্যের বধ অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় এবং তা দুর্গতিনাশের একটি ক্রমিক পর্যায় হিসেবে এসেছে বলে অসুর বধের চাইতেও এখানে দুর্গার দুর্গতিনাশিনী ভূমিকা বড়ো হয়ে ওঠে। এখানে রুরুদৈত্যের ছেলে দুর্গম দৈত্য মনে মনে এটা আগে বুঝে নিলেন যে, দেবতারা আসলে বেদের ওপর বেঁচে আছেন। ব্রাহ্মণরা বেদবিহিত যজ্ঞকর্মাদি করে দেবতাদের বল-শক্তি বাড়িয়ে দেন। ব্রাহ্মণরা যজ্ঞে ঘি ঢালেন, সেই ঘি খেয়ে দেবতারা পুষ্ট হন এবং তাঁরা অসুরদের বিনাশ করেন। কিন্তু এই সমস্ত প্রক্রিয়ার উপাদান এবং উৎস যেহেতু বেদ, অতএব বেদকেই যদি অবলুপ্ত করে দেওয়া যায় তাহলেই দেবতাদের বিনাশ ঘটবে— এই ভাবনা নিয়ে দুর্গম দৈত্য ব্রহ্মার তপস্যা আরম্ভ করলেন। তপস্তুষ্ট ব্রহ্মা বর দিতে চাইলে দুর্গম সকাতরে বললেন— এই তিন ভুবনে দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের কাছে যে বেদমন্ত্র আছে, সেগুলি আওমস্ত আমার কাছে থাকবে আর আপনি আমাকে এমন শক্তি দিন, যাতে আমি দেবতাদের পরাজিত করতে পারি—

ত্রিষু লোকেষু যে মন্ত্রা ব্রাহ্মণেষু সুরেষ্বপি।।

বিদ্যন্তে তে তু সন্নিধ্যং মম সন্তু মহেশ্বর।

বলঞ্চ দেহি যেন স্যাদ্দেবানাঞ্চ পরাজয়ঃ।।

ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে ‘তথাস্তু’ বলে চলে গেলেন বটে, কিন্তু সেই থেকে ব্রাহ্মণেরা বেদমন্ত্রে বিস্মৃত হলেন। স্নানাচিহ্ন, যজ্ঞ-জপ, শ্রাদ্ধ-হোম— সব বন্ধ হয়ে গেল। দেবতারা আর যজ্ঞে আহূত হন না, তাঁদের অন্ন-পান বন্ধ হয়ে গেল, শরীর হয়ে উঠল নিস্তেজ। এই অবস্থায় দুর্গম দৈত্য স্বর্গ অধিকার করে নিলেন। দুর্গমাসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোনও শারীরিক ক্ষমতাই তাঁদের রইল না। দেবতারা স্বর্গ থেকে পালালেন। নিরুপায় হয়ে তাঁরা আশ্রয় নিলেন হিমালয় পর্বতের গিরিগুহায় এবং অবশেষে পর্বতসানুতে বসে জগদম্বিকা শিবার ধ্যানে মগ্ন হলেন। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - name Durga)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours