তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

৯০ বছর আগে মহালয়া কেমন ছিল, মহালয়ার বিবর্তনই বা কেমন, এসব প্রাসঙ্গিক কিছু পৌরাণিক ইতিহাস নিয়ে আজ একটু নাড়াচাড়া।

মহালয়ার ইতিহাস বলতে শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের কাহিনী অনুসারে:- প্রলয়কালে পৃথিবী এক বিরাট কারণ-সমুদ্রে পরিণত হলে শ্রীবিষ্ণু সেই সমুদ্রের উপর অনন্তনাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হলেন। এই সময় বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্যে নির্গত হয়ে বিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত ব্রক্ষ্মাকে বধ করতে উদ্যত হল। ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করবার জন্য তাঁর নয়নাশ্রিতা যোগনিদ্রাকে স্তব করতে লাগলেন। এই তপস্যায় দেবী শ্রীবিষ্ণুকে জাগরিত করলে তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও কৈটভের সাথে মহাযুদ্ধে রত হলেন। পিতৃপক্ষ আর দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষন হচ্ছে মহালয়া। ভাদ্র মাসে কৃষ্ণ প্রতিপদ শুরু হয়ে পরবর্তী অমাবস্যা পর্যন্ত সময়কে পিতৃপক্ষ বলে। পুরাণ মতে ব্রহ্মার নির্দেশে পিতৃ পুরুষরা এই পনেরো দিন মনুষ্য লোকের কাছাকাছি চলে আসেন। তাই এই সময় তাঁদরে উদ্দেশ্যে কিছু র্অপণ করা হলে তা সহজেই তাদের কাছে পৌঁছায়। তাই গোটা পক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষদেব স্মরণ ও মননের মাধ্যমে তর্পণ করা হয়। যার চুড়ান্ত প্রকাশ বা মহালগ্ন হল এই মহালয়া। অনেকেই এই দিনটিকে দেবীপক্ষের সূচনা বলে থাকেন। যদিও এটি একটি জনপ্রিয় ভ্রান্ত ধারণা। মহালয়া পিতৃপক্ষের শেষ দিন। পরের দিন শুক্লা প্রতিপদে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। সেই দিন থেকে কোজাগরী পূর্ণিমা পযন্ত পনেরো দিনই হল দেবীপক্ষ। মহালয়া শব্দরে অর্থ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে মহান+আলয় =মহালয়। সঙ্গে স্ত্রীকারাত্মক আ যুক্ত হয়েছে। আবার মহ শব্দের অর্থে পাই পূজা এবং উৎসব অর্থাৎ মহালয়া একটি অর্থে দাঁড়ায় পুজা বা উৎসবের আলয়। অন্যদিকে, মহালয়া বলতে পিতৃলোককে বোঝায়।

মহালয়ার মূল মন্ত্রর দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে তারমধ্যে এক বিশ্বজনীন চেতনা লক্ষ্য করা যায়। সেখানে বলা হচ্ছে, মায়া দত্তনে তোয়নে তৃপ্যান্ত ভুবনত্রয়ম। অর্থাৎ স্বর্গ, মর্ত, পাতাল এই তিন ভুবনকেই এই মন্ত্রর মাধ্যমে স্মরণ করা হয়। এর মাধ্যমে বিদেহী পিতৃপুরুষ ও তাঁদের পূর্বপুরুষকে স্মরণ করা হয়। এখানে কোনও জাতপাত বা শ্রেণি বৈষম্য নেই, আত্মীয়- অনাত্মীয় ভেদ নেই, হিন্দু ও অহিন্দু দ্বন্দ্ব নেই। দেশের কালের সীমা নেই। এই মন্ত্র উচ্চারন করলে ব্রহ্ম থেকে পদতলে তৃণ পর্যন্ত সকলেরই উদ্দেশ্যেই তর্পণ করা হয়। মহালয়ার এই তর্পণ ভারতীয় সংস্কৃতির এক অন্যতম ঐতিহ্য যা সর্বজনীন তথা বিশ্বজনীন  চেতনা  থেকে উদ্ভুত।

পিতৃপক্ষের অবসানে, অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি, তখনই সেই মহালগ্নটি আমাদের জীবনে মহালয়ার বার্তা বহন করে আনে। এক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই হচ্ছেন সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরণের লগ্নটির নাম মহালয়া। একটি অর্থ অনুসারে মহান আলয়টি হচ্ছে পিতৃলোক। আশ্বিন মাসে কৃষ্ণপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনায় যে অমাবস্যাকে আমরা মহালয়া হিসাবে চিহ্নিত করি, সেই দিনটি হচ্ছে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার সন্ধিলগ্ন। পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার মাধ্যমে এই দিনটিতে আমরা আমাদের এই মানব জীবনকে মহান করে তুলতে প্রয়াসী হই বলেই এই পূণ্যলগ্নটিকে মহালয়া বলা হয়।

মহালয়া এলেই বাংলার মাটি-নদী-আকাশ প্রস্তুত হয় মাতৃপূজার মহালগ্নকে বরণ করার জন্য। কাশফুল ফুটলে শরৎ আসে, না, শরৎ এলে কাশফুল, এসব নিয়ে বিস্তর তর্ক চলতে পারে। কিন্তু মহালয়া এলেই যে দুর্গাপূজা এসে যায়, তা নিয়ে তর্কের কোনও অবকাশ নেই। মহালয়া এলেই সেই দেবী-বন্দনার সুর ধ্বনিত হয় বাংলার হৃদয়ে। দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ। বুকের মধ্যে জাগে আনন্দ-শিহরিত কম্পন, মা আসবেন।

মহালয়া মানে দুর্গাপূজার দিন গোনা। মহালয়ার ছয় দিন পরেই আসে মহাসপ্তমী। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। শ্রীরামচন্দ্র অকালে অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়। আসল দুর্গাপূজা হলো বসন্তে, সেটাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। সনাতন ধর্মে কোনও শুভ কাজ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বজ-সহ সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পন করতে হয়, কার্যাদি-অজ্ঞলি প্রদান করতে হয়। তর্পন মানে হল খুশি করা। ভগবান শ্রীরাম লঙ্কা বিজয়ের আগে এই দিনে এমনই করেছিলেন। অনন্তকাল ধরে এই ভারতভূমিতে কোটি কোটি মানুষ মহালয়ার পূণ্য প্রভাতে- ‘ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যান্ত ভুবনত্রয়ম, আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্তং তৃপ্যন্তু’- এই মন্ত্র উচ্চারণ করে তিন গন্ডুষ জল অঞ্জলি দিয়ে স্মরণ করে চলেছেন তাঁদের বিদেহী পিতৃপুরুষ এবং পূর্বপুরুষকে।

পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। ব্রহ্মার বর অনুযায়ী কোনও মানুষ বা দেবতা কখনও মহিষাসুরকে হত্যা করতে পারত না। ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতারিত করে এবং বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের অধীশ্বর হতে চায়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব ত্রয়ী সন্মিলিত ভাবে ‘মহামায়া’ এর রূপে অমোঘ নারীশক্তি সৃষ্টি করলেন এবং দেবতাদের দশটি অস্ত্রে সুসজ্জিত সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা নয় দিন ব্যপী যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করলেন।

১৯৩২ খ্রীস্টাব্দের চৈত্র মাসে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পূজার সন্ধিক্ষণে প্রথম সম্প্রচারিত হয় বসন্তেশ্বরী শীর্ষক অনুষ্ঠান, যা মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর উপর ভিত্তি করে বাণীকুমারের লেখা একটি বেতার লিপিলিখন। বসন্তেশ্বরী শীর্ষক অনুষ্ঠানের অনুকরণেই কিছু পরিমার্জনের মাধ্যমে সেই বছরই দুর্গাষষ্ঠীর দিন অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত করা হয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, চণ্ডীপাঠ করেন বাণীকুমার স্বয়ং এবং নাট্যকথা সূত্র এবং গীতাংশ গ্রহণে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।পরবর্তীতে ১৩৩১-৩৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতিবছরই কিছু পরিমার্জন করে নতুন স্তবস্ততি, দেবীসূক্তি, নতুন গান এবং পুরাতন গানের সুরের পরিবর্তন ঘটিয়ে অনুষ্ঠানটির সম্প্রচার করা হয়। ১৯৩৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটি মহিষাসুর বধ, শারদ বন্দনা নামে সম্প্রচারিত হয়, যার সঙ্গীত পরিচালনা করেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক এবং শ্লোকপাঠ ও গ্রন্থনা করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দে এই অনুষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে মহিষাসুরমর্দিনী রাখা হয়, যা এখনও একই নামে সম্প্রচারিত হয়ে চলেছে। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Mahalaya Durgapuja)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours