তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গানের ইতিহাস বলতে মোটামুটি ৩০০ টি গানের  ইতিহাস পাওয়া যায়। শুধু তাই নয় এই ৩০০ গানই রবীন্দ্র তথা বাংলা সংগীতে কান্ডারি হিসেবে আজও সগৌরবে অমলিন। রবীন্দ্রনাথের প্রথম আর শেষ রচনা কোনটি। অনেকেই মনে করেন প্রথম গান হল: 

গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,

আসুন দেখা যাক সত্যটা কি। রচনাকাল: ১২৭৯ (১৮৭৩), কবির বয়স: ১৩ প্রকাশ: ফাল্গুন, ১২৮১, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। সঙ্গীত কল্পতরু (স্বামী বিবেকানন্দ সম্পাদিত) গীতবিতান(পর্যায়;#/পৃ): পূজা ও প্রার্থনা-পূজা ও প্রার্থনা; ১/৮২৭ রাগ / তাল: দেশ / ঝাঁপতাল স্বরলিপি: ব্রহ্মসঙ্গীত ২; স্বরবিতান ৬৪। স্বরলিপিকার: কাঙালীচরণ সেন; ঐ পাদটিকা: অন্য-ভাঙা গান, 'গগনময় থাল্‌, রবি চন্দ্র দীপক বনে', গুরু নানকের বিখ্যাত পাঞ্জাবী (শিখ) ভজনের প্রথমাংশের অনুবাদ ( জয়জয়ন্তী, তেওরা)। 

দেশ/ঝাঁপতাল

গগনময় থাল, রবি চন্দ্র দীপক বনি,

তারকা-মণ্ডলা জনক মোতি।

ধূপ মলয়ানিলো, পবন চঁবরো করে,

সকল বনরাই ফুলন্ত জ্যোতি।

ক্যায়্‌সী আরতি হোরে ভবখণ্ডনা তেরী আরতি,

অনাহত শব্দে বাজন্ত ভেরী।

--প্রচলিত শিখ ভজন (আরতি গান) উন্দেফিনেদ -- তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১২৮১ [অন্য সংকলনে ঈষৎ ভিন্ন পাঠ, স্বরলিপি এবং পরের ছত্রসমূহও পাওয়া যায়] --গ্রন্থপরিচয়, গীতবিতান।

'গগনের থালে রবি চন্দ্র' গানটি কলকাতায় ১২৮১ বঙ্গাব্দের ১১ মাঘ (২৫শে জানুয়ারি ১৮৭৫) আদি ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে ৪৫তম সাম্বৎসরিক মাঘোৎসবে সন্ধ্যাবেলায় গীত হয়। ফাল্গুন মাসে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় গানটি মুদ্রিত হয়। আদি ব্রাহ্মসমাজ থেকে প্রকাশিত 'ব্রহ্মসঙ্গীত-স্বরলিপি' দ্বিতীয় ভাগ গ্রন্থে এই গানটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের রচনা হিসেবে উল্লিখিত। বিশ্বভারতী পত্রিকার ১৩৫৬ বঙ্গাব্দের তৃতীয় সংখ্যায় ইন্দিরাদেবী লিখেছেন: "জ্যোতিরিন্দ্রনাথ একেবারে প্রায় অক্ষরে অক্ষরে অনুবাদ করেছেন।... কেউ কেউ ভুল করে ভাবেন এটি রবীন্দ্রনাথের।"

গানটি শিখ ভজন, গুরু নানকের ভজনের প্রথমাংশের অনুবাদ। অনূদিত গানের রচয়িতা সম্পর্কে সংশয় থাকলেও রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথের রচনা হিসেবে স্বীকৃত। শনিবারের চিঠি পত্রিকার ১৩৪৬ মাঘ সংখ্যায় এ-বিষয়ে লেখা হয়:

"আদি ব্রাহ্মসমাজ হইতে প্রকাশিত ব্রহ্মসঙ্গীত স্বরলিপি (দ্বিতীয় ভাগ) পুস্তকে ইহা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নামে বাহির হইয়াছে। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন, এটি তাঁহার রচনা।" যেহেতু রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন যে, এটি তাঁরই রচনা সেজন্য রবীন্দ্র-রচিত গান হিসেবেই গৃহীত হয়েছে। --গ্রন্থপরিচয়, স্বরবিতান ৬৪, বিশ্বভারতী ১৪১০। তবে পদ্যানুবাদটি রবীন্দ্রনাথেরই কৃত। ফাল্গুন সংখ্যায় অনুবাদ-সহ মূল রচনাটি প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে বোলপুর হয়ে অমৃতসরে আসেন। খুবই সম্ভব যেন তিনি তত্ত্ববোধিনী  মারফত রচনাটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। অমৃতসরে পিতার সঙ্গে যখন গুরু-দরবারে উপস্থিত থাকতেন তখন অন্যান্য শিখ-ভজনের সঙ্গে এই গানটিও তিনি শুনেছিলেন, এমন সম্ভাবনার কথা সহজেই ভাবা যেতে পারে। আর এই যোগাযোগের অভিঘাতে রবীন্দ্রনাথ ভজনটির বঙ্গানুবাদ করেন।

গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে,

তারকামণ্ডল চমকে মোতি রে॥

ধূপ মলয়ানিল, পবন চামর করে,

সকল বনরাজি ফুলন্ত জ্যোতি রে॥

কেমন আরতি, হে ভবখণ্ডন, তব আরতি--

অনাহত শব্দ বাজন্ত ভেরী রে॥

১৮৭৫ সনের পশ্চাৎপট: ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন প্রথম অমৃতসর যান, তখন গুরুদ্বারে গিয়ে নানকের রচিত এই ভজনটি শুনেছিলেন। তার বর্ণনা দিয়েছেন 'আত্মজীবনী'-তে: "আমি আবার সন্ধ্যার সময় মন্দিরে গেলাম। দেখি যে, তখন আরতি হইতেছে। এক জন শিখ পঞ্চপ্রদীপ লইয়া গ্রন্থের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আরতি করিতেছে। অন্য সকল শিখেরা দাঁড়াইয়া জোড় করে তাহার সঙ্গে গম্ভীর স্বরে পড়িতেছে-- 'গগনমৈ থাল, রবি চন্দ্র দীপক বনে ..."

উপনয়নের পরে যখন রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে অমৃতসর গেলেন (১৮৭৩), তখন তিনি নিশ্চয়ই স্বর্ণমন্দিরে এই গানটি শুনেছিলেন, এবং হয়তো তখনই তিনি এটির বঙ্গানুবাদ করেন। মূল ভজনটির অনুসরণে সুরটি সম্ভবত আরোপ করেন দেবেন্দ্রনাথ নিজেই-- তিনি সুকণ্ঠ ছিলেন, গানের চর্চাও করেছিলেন,তাঁর পক্ষে এ কাজ খুব কঠিন ছিল না। গানটি গাওয়া হল ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দের মাঘোৎসবে, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। ... 'তত্ত্ববোধিনী'-র প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই, কিন্তু আমরা ধরে নিতে পারি সুকণ্ঠ বালক রবীন্দ্রনাথ এই অনুষ্ঠানে গানটি গেয়েও থাকবেন। --সমীর সেনগুপ্ত, গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথ, প্যাপিরাস, কলকাতা, ২০০৮। নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়।

এই রবীন্দ্রনাথের প্রথম গান। রচনাকাল:  ১২৮৫ ( ১৮৭৮)।কবির বয়স: ১৭, প্রকাশ: ফাল্গুন, ১২৮৭, ভারতী। ভগ্নহৃদয় র-র অচ১; স্বপ্নময়ী নাটক (নাট্যকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর); রবিচ্ছায়া (বিবিধ); কাব্যগ্রন্থাবলী (কৈশোরক,১৩৯৩) গীতবিতান (পর্যায়;#/পৃ): নাট্যগীতি-ভগ্নহৃদয়; ৩/৭৬৮। রাগ / তাল: মিশ্র বেহাগ-পূরবী-কাফি / মধ্যমান। স্বরলিপি: গীতিমালা; স্বরবিতান ২০, স্বরলিপিকার: জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর; ঐ পাদটিকা: ৬ষ্ঠ সর্গ, কবি (গান)। রবিচ্ছায়ার প্রথম গান। আড়াঠেকা [ কা-সূ ]। এ শাহিবাগ-প্রাসাদের চূড়ার উপরকার একটি ছোটো ঘরে আমার আশ্রয় ছিল। কেবল একটি চাকভরা বোলতার দল আমার এই ঘরের অংশী। রাত্রে আমি সেই নির্জন ঘরে শুইতাম এক-একদিন অন্ধকারে দুই-একটা বোলতা চাক হইতে আমার বিছানায় উপর আসিয়া পড়িত যখন পাশ ফিরিতাম তখন তাহারাও প্রীত হইত না এবং আমার পক্ষেও তাহা তীক্ষ্ণভাবে অপ্রীতিকর হইত। শুক্লপক্ষের গভীর রাত্রে সেই নদীর দিকের প্রকাণ্ড ছাদটাতে একলা ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ানো আমার আর-একটা উপসর্গ ছিল। এই ছাদের উপর নিশাচর্য করিবার সময়ই আমার নিজের সুর দেওয়া সর্বপ্রথম গানগুলি রচনা করিয়াছিলাম। [সর্বপ্রথম গান:  নীরব রজনী দেখো] তাহার মধ্যে' বলি ও আমার গোলাপবালা' গানটি এখনো আমার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আসন রাখিয়াছে। (৩৫৭) --রবীন্দ্রনাথ, "স্বাদেশিকতা" - জীবনস্মৃতি, র-র ১৭।  

নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় [রবীন্দ্রজীবনীবিদ] লিখছেন: "সেদিন ২৩ শে চৈত্র [১৩৪৭]। আমার প্রশ্নের উত্তরে কবি বললেন: 'প্রথম গান যেটি রচনা করেছিলাম আমেদাবাদে, তা রাখবার সাহস তখন হয়নি। তাতে ছিল গানের একটি সত্যকারের মুক্তরূপ। একটিমাত্র কলি তার মনে পড়ছে (কবি গেয়ে উঠলেন)-- নীরব রজনী দেখ মগ্ন জ্যোছনায়'।

নীরব রজনী দেখো মগ্ন জোছনায়।

ধীরে ধীরে, অতি ধীরে, অতি ধীরে গাও গো॥

ঘুমঘোরময় গান বিভাবরী গায়--

রজনীর কণ্ঠ-সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো॥

নিশার কুহকবলে       নীরবতাসিন্ধুতলে

মগ্ন হয়ে ঘুমাইছে বিশ্বচরাচর--

প্রশান্ত সাগরে হেন       তরঙ্গ না তুলে যেন

অধীর উচ্ছ্বাসময় সঙ্গীতের স্বর।

তটিনী কী শান্ত আছে--   ঘুমাইয়া পড়িয়াছে

বাতাসের মৃদুহস্ত-পরশে এমনি

ভুলে যদি ঘুমে ঘুমে       তটের চরণ চুমে

সে চুম্বনধ্বনি শুনে চমকে আপনি।

তাই বলি, অতি ধীরে,  অতি ধীরে গাও গো--

রজনীর কণ্ঠ-সাথে সুকণ্ঠ মিলাও গো॥

শেষ গান বা রচনা:

ঐ মহামানব আসে।

দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে

মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে॥

সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,

নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক--

এল মহাজন্মের লগ্ন।

আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত

ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।

উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ'

নবজীবনের আশ্বাসে।

জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়'

মন্দ্রি-উঠিল মহাকাশে॥

১৯৪১ সনের পশ্চাৎপটে রবীন্দ্রনাথের জগৎ:  জন্মদিনের বাণী 'সভ্যতার সঙ্কট'। পঁচিশে বৈশাখ ভারতব্যপী জন্মোৎসব। শেষ গান 'হে নূতন দেখা দিক আরবার'। ত্রিপুরারাজ উপাধি দিলেন 'ভারতভাস্কর'। অসুস্থ অবস্থায় শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় আনা হলো। বাইশে শ্রাবণ, ৭ই অগাস্ট তিরোভাব। প্রকাশ: আরোগ্য (কবিতা), জন্মদিনে (কবিতা), গল্পসল্প (গল্প), সভ্যতার সংকট (ভাষণ), আশ্রমের রূপ ও বিকাশ (প্রবন্ধ), গীতবিতান ১ ও ২ (গানের সংকলন), ছড়া, শেষ লেখা, স্মৃতি (চিঠিপত্র), Crisis of Civilization.

বহির্বিশ্বে: ২৬শে জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র পুলিশ পাহারা এড়িয়ে অন্তরীণ অবস্থা থেকে পালালেন। হাওড়া ব্রিজ খোলা হলো। নাৎসী বাহিনীর যুগোস্লাভিয়া এবং অক্ষশক্তির রাশিয়া আক্রমণ। ৭ই ডিসেম্বর জাপান পার্ল হারবার, ফিলিপিন এবং মালয় দ্বীপপুঞ্জ আক্রমণ করলো, ৮ই ডিসেম্বর আমেরিকা যুদ্ধ ঘোষণা করে। দার্শনিক বেগসঁরের মৃত্যু। উল্লেখযোগ্য সাহিত্য: পয়েণ্ট্‌স অফ ভিউ (এলিয়ট), বিটুইন টু ওয়ার্ল্ড্‌স (সিন্‌ক্লয়ার), বিটুইন দি অ্যাক্‌ট্‌স (উল্‌ফ), দি ডন ফ্লোজ টু দি সী (শোলোকোভ), দি সেঞ্চুরি ওয়াজ ইয়ং (আরাগঁ)। --প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনকথা, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা ১৩৯২ এবং চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদক, রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ ৪, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা ১৯৯৮।

২৬শে মে, ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ বলছেন: "কিন্তু গানটা শুনলেই আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। এই সুরগুলি কারও কাছে ধার করা নয়। কোথা থেকে এসেছে বলতে পারিনে। আপনার ইচ্ছেমতো গলায় এসেছে, গেয়েছি; গান হয়ে উঠেছে। তাই ফিরে শুনি যখন, বিস্মিত হই এবং আমি নিজেকে বলি-- তোমার গান রইল, এ আর কাল অপহরণ করতে পারবে না। " (৭৩) --পার্থ বসু, "গায়ক রবীন্দ্রনাথ", আনন্দ - ১৩৯৩-তে উদ্ধৃত।  

১৩৪৭ বঙ্গাব্দে চৈত্রের শেষপাত। নিজের হাতে শেষ গানটি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ঐ মহামানব আসে’। জীবনের শেষ চৈত্র। যদিও, ‘শেষ লেখা’য় বা ‘সভ্যতার সংকট’-এ এই গানের রচনাকালের উল্লেখ রয়েছে পয়লা বৈশাখ। ‘রচনাকাল’ যদি নিছক একটি দিন বা মুহূর্ত না হয়, যদি তার প্রস্তুতি বলেও আবহমান কিছু সত্যি হয়, তাহলে এই গানের শুরুটা ঘটে গেছে চৈত্রেই।

সে চৈত্র বড় সুখের সময় নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বেঁচে থাকার মতো একটা ন্যূনতম চাহিদাকেও ঘোরতর অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রক্তফাটা মাটিতে দাঁড়িয়েও স্বপ্ন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভেবেছিলেন, এই ধ্বংসের ভিতর দিয়েই আত্মপ্রকাশ হবে নতুন সৃষ্টি। মনে হয় রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারছেন জীবন আর খুব বেশি সময় দেবে না তাঁকেও। এমনই একদিন আসন্ন নববর্ষের প্রভাতে বৈতালিকের জন্য একটা নতুন গানের আবদার জোড়েন শান্তিদেব ঘোষ। এদিকে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাবিও ছিল মানবের জয়গান গেয়ে একটা কবিতা লিখে দেওয়ার। বাসভবন উদয়নে সদ্য লেখা সেই কবিতাতেই সুরারোপ করলেন রবীন্দ্রনাথ। বড় কবিতায় সুরারোপের ধকল একবারে নিতে পারে না শরীর। তাই সুর হল দুদিনে। স্বরলিপি করে দিলেন শান্তিদেব ঘোষ। ভৈরবী আঙ্গিকের গান। সকালের প্রথম প্রহরের। যে ভোর নবজীবনের বোধন গাইছে।

চারপাশে স্থায়ী ধ্বংস। একসময় যে ইউরোপকে আধুনিক সভ্যতার দূত মনে হয়েছিল, তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের রক্তমুখ দেখে, সেই বিশ্বাসও টাল খেয়েছে। খোদ ইউরোপের মানুষরাই নিজেদের অপার, নিরর্থক শূন্যের ভিতরে আবিষ্কার করছে ক্রমশ। এরমধ্যেও কোন আশ্চর্য দরজা দিয়ে প্রত্যয় এসে বাসা বাঁধে জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির মনে। একই সময়ে নববর্ষের অভিভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’-এ তিনি বলছেন – “জীবনের প্রথম-আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম যুরোপের সম্পদ অন্তরের এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি—পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব।” অমিয় চক্রবর্তীকে বলছেন--- আর সময় নেই, যা বলার এখনই বলে যেতে হবে। বলছেন এক শাশ্বত বিশ্বাসের কথা। নবজীবনের আশ্বাস নিয়ে মহামানবের আসার কথা। সময় ফুরিয়ে আসছে জেনে আরও নিবিড়ভাবে তিনি নতজানু হচ্ছেন গভীর সত্যের কাছে। কী অনন্ত বিশ্বাসে লীন সেই স্বপ্ন ও সত্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের মহামানব আজও আসেনি। ধংসের পর সৃষ্টি আসে এটা ইতিহাস এটাই অভিজ্ঞতা। হয়তো সময় এখনো আসেনি।

সেই স্বপ্নেরই ফসল—“ঐ মহামানব আসে,/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে”। এরপর, ভরা গ্রীষ্মে, নিজের শেষ জন্মদিনের আগে অবশ্য আরও একটি গানের জন্ম দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তথ্যগতভাবে এটিই তাঁর শেষ গান। ‘হে নূতন দেখা দিক আরবার’। কিন্তু, গানটি কবিতা হিসেবে রচিত ঢের আগে। ১৩২৯ বঙ্গাব্দে লেখা ‘পূরবী’র ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতার একটা অংশকেই সামান্য বদলে সুর দিয়েছিলেন তিনি। এটিও ভৈরবী আঙ্গিকের গান। ‘হে নূতন/ তোমার প্রকাশ হোক কুজ্ঝটিকা করি উদ্‌ঘাটন/ সূর্যের মতন”-- চারপাশে ওলোটপালট করা ক্ষয়ের মধ্যে, ধ্বংসের মধ্যে দাঁড়িয়েও এভাবে ভাবতে পারেন কেউ। এইটুকু মাত্র বুনে তারপর থেমে যেতে পারেন চিরকালের মতো।হ্যাঁ অবশ্যই ভাবতে পারেন। কারণ তিনি উপনিষদের ঋষি রবীন্দ্রনাথ যা আজও অম্লান এত ক্ষয়ের মধ্যেও।

(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours