তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

এখন দুর্গা পূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে শারদীয়া বা পূজা সংখ্যা। প্রথম পূজা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১২৭৯ বঙ্গাব্দে। কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সুলভ সমাচার’ ১২৭৯ বা ইংরেজি ১৮৭২-এ ‘ছুটির সুলভ’ নামে প্রথম শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ করে।

পূজার সময়ে নামী লেখকদের লেখা পাওয়ার জন্য পত্রপত্রিকার সম্পাদকেরা পূজার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের সময়েও এ ব্যাপার ছিল। নানা সম্পাদকের কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের কাছে তাদের পত্রপত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় লেখা দেওয়ার জন্য অনুরোধ আসত। যতদূর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’ নামের শারদীয় বার্ষিকীতেই প্রথম পূজার লেখা দেন। ‘পার্বণী’ হলো প্রথম বাংলা বার্ষিকী। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩২৫ সালে। ‘পার্বণী’ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘পার্বণী’র প্রথম পূজাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ‘শরতে আজ কোন অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’ গানটি ‘শরতের গান’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন। আর লিখেছিলেন ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্প ও ‘ঠাকুর্দ্দার ছুটি’ কবিতা। ‘পার্বণী’ প্রথম শারদীয় বার্ষিকী হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’র সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লিখেছিলেন,

‘তোমার ‘পার্বণী’ পড়িয়া বিশেষ আনন্দ পাইয়াছি। ইহা ছেলে বুড়ো সকলেরই ভালো লাগিবে। তোমার পরিশ্রম সার্থক হইয়াছে। দেশের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত লেখকদের ঝুলি হইতে বাংলাদেশের ছেলেদের জন্য এই যে পার্বণী আদায় করিয়াছ ইহা একদিকে যত বড়ই দুঃসাধ্য কাজ অন্যদিকে তত বড়ই পুণ্য কর্ম। বস্তুত ইহার বৈচিত্র্য। সৌষ্ঠব ও সরসতা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি—অথচ ইহার মধ্যে পাঠকদের জানিবার ভাবিবার বুঝিবার কথাও অনেক আছে। তোমার এই সংগ্রহটি কেবলমাত্র ছুটির সময় পড়িয়া তাহার পরে পাতা ছিঁড়িয়া, ছবি কাটিয়া, কালি ও ধুলার ছাপ মারিয়া জঞ্জালের সামিল করিবার সামগ্রী নহে—ইহা আমাদের শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে নিত্য ব্যবহারের জন্যই রাখা হইবে। প্রথম খণ্ড ‘পার্বণী’তে যে আদর্শে ডালি সাজাইয়াছ বৎসরে বৎসরে তাহা রক্ষা করিতে পারিলে মা ষষ্ঠী ও মা সরস্বতী উভয়েরই প্রসাদ লাভ করিবে। আজকাল কাগজ প্রভৃতির দুর্মূল্যতার দিনে কেমন করিয়া দেড় টাকা দামে তুমি এই বই বাহির করিলে বুঝিতে পারিলাম না। বোধ করি সংগ্রহ করিবার উৎসাহে লাভ লোকসান খতাইয়া দেখিবার সময়ও পাও নাই।

ইতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

৯ই আশ্বিন, ১৩২৫।’

১৯৩৫ সালে ‘আনন্দবাজার’ ও ‘দেশ’ পত্রিকার পক্ষ থেকে পূজা সংখ্যায় লেখা দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে ‘একশ টাকা বায়না’ দেওয়া হয়। ঘটনাটির উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৫ সালের ২৯শে আগস্ট শান্তিনিকেতন থেকে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখেন,

‘এখানকার বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে অর্থসংগ্রহ-চেষ্টায় ছিলুম। ব্যক্তিগতভাবে আমারও দুঃসময়। কিছু দিতে পারছিলুম না বলে মন নিতান্ত ক্ষুব্ধ ছিল। এমন সময় ‘দেশ’ ও ‘আনন্দবাজার’-এর দুই সম্পাদক পূজার সংখ্যার দুটি কবিতার জন্য একশ টাকা বায়না দিয়ে যান, সেই টাকাটা বন্যার তহবিলে গিয়েছে। আগেকার মতো অনায়াসে লেখবার ক্ষমতা এখন নেই। সেজন্য ‘বিস্ময়’ কবিতাটি দিয়ে ওদের ঋণশোধ করব বলে স্থির করেছি। ক্লান্ত কলম নতুন লেখায় প্রবৃত্ত হতে অসম্মত।…’

শারদীয়া সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা পাওয়ার জন্য সম্পাদকের চেষ্টার অন্ত থাকত না। যে সম্পাদক তার কাছ থেকে পূজার লেখা আদায় করতে সক্ষম হতেন না, তিনিও রবীন্দ্রনাথের কাছে অনুযোগ করতেন। এ ব্যাপারে কখনও কখনও উড়ো খবরও প্রচারিত হতো। যেমন, ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বুদ্ধদেব বসুর কাছে খবর এল যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি সে বছর পূজাতে সঞ্চয় ভট্টাচার্যের পত্রিকায় লেখা দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের উত্তরে বুদ্ধদেব বসুকে শান্তিনিকেতন থেকে ১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট একটি চিঠিতে লিখলেন, ‘নিজের কাজের ভিড় জমে উঠেছে—তাছাড়া শরীর ক্লান্ত। লিখে ওঠা সম্ভব হবে না।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে দুর্গাপূজা সামাজিক মিলনের একটি উদার ক্ষেত্র স্থল হিসেবেই পরিগণিত হয়েছে। এখানে মলিনতা নেই, হীনতা নেই, নেই কোনও ছোট-বড়র হিসাব কিংবা অভিজাত্যের বড়াই। এখানে সবাই সব ভুলে মিলবে, মেলাবে, ‘যাবে না ফিরে’। এখানে সবার আমন্ত্রণ রয়েছে।

আগে পূজায় তেমন জাঁকজমক হতো না, তাই ছুটিরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। প্রথম দুর্গাপূজায় ছুটির উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৮৭ সালে। কলকাতার পূজার বাজারকে গ্রামের মানুষদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১৯২৭ সালে পূর্ববঙ্গ রেলওয়ে (ই. বি. রেলওয়ে) কর্তৃপক্ষ পূজার আগে ‘পূজা বাজার স্পেশাল’ নামে তিন কামরার একটি ট্রেন প্রায় মাস খানেক ধরে বিভিন্ন স্টেশনে চালিয়েছিল। গ্রামের মানুষদের কাছে বিক্রির উদ্দেশ্য নিয়ে মোট ১৬টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ওই ট্রেনে পশরা সাজিয়ে যোগ দিয়েছিল।

মা দুর্গার দশ হাতের দশটি অস্ত্র। কিন্তু এই দশটি অস্ত্রের মাহাত্ম্য কি!  জেনে নেওয়া যাক:-

ত্রিশূল-»

ত্রিশূল হলো মা দূর্গার প্রধান অস্ত্র। পুরাণ অনুযায়ী, মা দূর্গা যখন মহিষাসুরবধ করেছিলেন সেই সময় সমস্ত দেবতারা দেবীকে একটি একটি করে অস্ত্র দিয়েছিলেন। তার মধ্যে মহান অস্ত্র হল ত্রিশূল। এই অস্ত্র দান করেছিলেন মহাদেব। এই অস্ত্র দিয়েই মহিষাসুরকে বধ করেন দেবী দুর্গা। ত্রিশূল তিনটি গুণের প্রতীক।

সতঃ, এই গুণটি হল দেব গুণ। এই গুণ একমাত্র দেবতাদের মধ্যে থাকা সম্ভব।

রজঃ, এই গুণটি হল মানুষের গুণ। জীবকুলের মায়া বলতে এই গুণকে বোঝায়।

তমঃ, এই গুণটি হল রাক্ষসের শক্তির প্রকাশ।

ত্রিশূল যার স্পর্শে এই তিনটি গুণ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়।

শঙ্খ-»

বরুণদেব মা দুর্গাকে এই শঙ্খ দিয়েছিলেন। শঙ্খ হল জাগরণের প্রতীক। তাইতো যে কোনো যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে শত্রুপক্ষকে সতর্ক করার জন্য শঙ্খ বাজানো হয়। এ তো গেল পৌরাণিক কাহিনী। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বলা হয় পৃথিবীর সৃষ্টির শুরু হয়েছিল জলের মধ্যে। জলের মধ্যে প্রথম প্রাণের স্পন্দন পাওয়া গিয়েছিল অ্যামিবা নামে এক এককোষী প্রাণীর মধ্যে দিয়ে। শঙ্খ এক ধরনের জলজ প্রাণী। তাই ধরে নেওয়া হয়, শঙ্খের মধ্যেই প্রথম প্রাণের স্পন্দন দেখা যায়।

চক্র-»

সুদর্শন চক্র হল এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতীক। হিন্দু শাস্ত্রে বর্ণিত সুদর্শন চক্রের গতিময়তার সঙ্গে নাসার বিজ্ঞানীদের আবিষ্কৃত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কিত যে সমস্ত তথ্য তার সঙ্গে অনেক মিল পাওয়া যায়। শাস্ত্র অনুযায়ী, দেবী দুর্গা হলেন এই ব্রহ্মাণ্ড প্রসবিনী।

খড়্গ-»

হাতে থাকা খড়্গ দিয়ে দেবী অসুরের মাথা ছিন্নভিন্ন করে সেই মাথা গুলিকে মুণ্ডমালা ধারণ করেছিলেন নিজের কন্ঠে। দেবীর হাতে থাকা এই খড়্গ হল মোক্ষ লাভের প্রতীক। এই মোক্ষই একমাত্র মানুষকে মুক্তি লাভের পথ দেখাতে পারে।

গদা-»

গদা বা কাল দণ্ডকে দেবী দুর্গার হাতে দেখা যায়। এটি হলো আনুগত্যের প্রতীক।

ধনুর্বাণ-»

দেবী দুর্গাকে ধনুর্বাণ দিয়েছিলেন পবনদেব। জীবনের প্রতিটি যুদ্ধে জয়লাভ করতে সঠিক পথ নির্বাচন করতে হয়। একমাত্র সঠিক পথ নির্বাচন করলেই জীবনের সমস্ত পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। আর এই কাল্পনিক তীর-ধনুকই হল সেই জীবনের লক্ষ্যভেদ এর একমাত্র অস্ত্র যা দেবী দুর্গার হাতে থাকে।

ঘন্টা-»

দেবী যখন মহিষাসুরকে যুদ্ধে আহবান করেছিলেন তখন সেইখানে সতর্কবার্তা স্বরূপ দিয়ে অট্ট হাসি এবং আশপাশ থেকে শঙ্খধ্বনি ও ঘন্টা বেজে উঠেছিল। নির্দেশ দিয়েছিল এইবার যুদ্ধ শুরু হবে।

নাগপাশ-»

এই অস্ত্রটি বরুন দেব দেবীকে দান করেছিলেন। তবে এ নিয়ে আবার মতানৈক্য আছে। অনেকে বলেন, অনন্তনাগ এটি দান করেন। দেবী তার হাতে নাগপাশে আবদ্ধ করে অসুরকে ধরেন এবং অসুরের উরুতে নিজের বাঁ পা রেখে সেই অসুরকে বধ করেন।

বজ্র-»

এই অস্ত্রটি দেবীকে দান করেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র। এটি কঠোর এবং সংহতির প্রতীক। জীবনে চলার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই চরিত্রের মধ্যে কঠোরতা প্রয়োজন। তাই স্বয়ং দুর্গাই এই অস্ত্রকে ধারণ করেছে।

পদ্ম, কমণ্ডলু, অক্ষমালা-»

দেবী দুর্গাকে এই তিনটি দান করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। পদ্ম পাঁকে জন্মগ্রহণ করেও সে পবিত্র। অন্ধকারের মধ্যেও তার মধ্যে রয়েছে একটা আলোয় উত্তরণের পথ। শুধুমাত্র অক্ষমালা, কমণ্ডলু দুটোই পবিত্রতার প্রতীক। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - Mahalaya Durgapuja)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours