তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে, তাঁর ১৩ থেকে ২১ বছর বয়স কালে, লেখা চিঠিগুলির একক তাৎপর্য স্বয়ং পত্রকারই সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেছেন ৭ অক্টোবর ১৮৯৪ সালে লেখা চিঠিখানিতে। ইন্দিরা দেবীকে লেখার বিষয়-বৈশিষ্ট্য কি, সেটা স্বয়ং লেখকের জবানি শোনা যাক:

আমার অনেক সময় ইচ্ছা করে, তোকে যে সমস্ত চিঠি লিখেছি সেই গুলো নিয়ে পড়তে পড়েত আমার অনেক দিনকার সঞ্চিত অনেক সকাল দুপুর সন্ধ্যার ভিতর দিয়ে আমার চিঠির সরু রাস্তা বেয়ে আমার পুরাতন পরিচিত দৃশ্যগুলির মাঝখান দিয়ে চলে যাই। কত দিন কত মূহুর্তকে আমি ধরে রাখবার চেষ্টা করেছি- সে গুলো বোধ হয় তোর চিঠির বাক্যের মধ্যে ধরা আছে…আমাকে একবার তোর চিঠিগুলি দিস- আমি কেবল ওর থেকে আমার সৌন্দর্য সম্ভোগগুলো একটা খাতায় টুকে নেব…আমার গদ্যে-পদ্যে কোথাও আমার সুখ দুঃখের দিনরাত্রিগুলি এ রকম করে গাঁথা নেই (শিলাইদহ। ১১ মার্চ ১৮৯৫, সংযোজন, ছিন্নপত্র)।

ছিন্নপত্রের যে-কোনও একটি চিঠি পড়লেই দেখা যাবে কবির অনুপ্রাণিত মনে বহির্জগতের ক্রিয়াগুলি যে-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তাকেই সত্যরূপে পত্রগুলি বিশ্বস্তভাবে ধারণ করে আছে। যেমন প্রকৃতির বক্ষলগ্ন কবির প্রাণিত অনুভব:

ওই-যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পরে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি- ওর এই গাছপালা নদী মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্তটা-সুদ্ধ দুহাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে আমরা যে-সব পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন কি কোনও স্বর্গ থেকে পেতুম? স্বর্গ আর কী দিত জানি নে, কিন্তু এমন কোমলতা দুর্বলতাময়, এমন সকরুণ আশঙ্কা-ভরা, অপরিণত এই মানুষগুলির মতো এমন আপনার ধন কোথা থেকে দিত!…আমি এই পৃথিবীকে ভারী ভালোবাসি। এর মুখে ভারী একটি সুদূরব্যাপী বিষাদ লেগে আছে- যেন এর মনে আছে, আমি দেবতার মেয়ে, কিন্তু দেবতার ক্ষমতা আমার নেই। আমি ভালোবাসি, কিন্তু রক্ষা করতে পারি নে। আরম্ভ করি, সম্পূর্ণ করতে পরি নে। জন্ম দিই, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারি নে। এই জন্যে স্বর্গের উপর আড়ি করে আমি আমার দরিদ্র মায়ের ঘর আরও বেশি ভালোবাসি- অসহায়, অসমর্থ, অসম্পূর্ণ, ভালোবাসার সহস্র আশঙ্কায় সবর্দা চিন্তাকাতর বলেই (পত্র ১৮, ছিন্নপত্র)।

কাদম্বিনী দত্ত (১২৮৫(?)-১৩৫০) উচ্চশিক্ষিতা বা সুপরিচিতা কোনও ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। কিন্তু তাঁর ঈশ্বর-জিজ্ঞাসা এবং অসামান্য ধীশক্তি রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল। প্রায় ত্রিশ বছর কাল উভয়ের মধ্যে পত্রযোগে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলেছিল। কবি কি-প্রাঞ্জল ভাষায় এই শোকাতুরা বাল্য বিধবাকে শান্তির আমোঘ বাণী শুনিয়েছেন, এখানে তার কিছু নমুনা দেওয়া আলোচনার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে।

ঈশ্বর তাঁর পরম দানগুলিকে দুঃখের ভিতর দিয়াই সম্পূর্ণ করেন- তিনি বেদনার মধ্য দিয়া জননীকে সন্তান দেন- সেই বেদনার মূল্যেই সন্তান জননীর এত অত্যন্তই আপন। সেই কথা মনে রাখিয়া, যখন ঈশ্বরের কাছে সত্য চাই, আলোক চাই, অমৃত চাই তখন অনেক বেদনা অনেক ত্যাগের জন্য নিজেকে সবলে প্রস্তুত করিতে হইবে। মা, ঈশ্বর যদি তোমাকে বেদনা দেন তবে নিজের দোষে সেই বেদনাকে ব্যর্থ করিও না- তাহাকে সফল করিবার জন্য সমস্ত হৃদয় মনকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করিয়া জাগ্রত হও (পত্র ৪, ঐ)।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বিনী দত্তের পত্র ব্যবহারের মূল বিষয় ছিল- এ সংসারে মানুষের সুখ দুঃখের স্বরূপ। হেমন্তবালার সঙ্গে পত্রালাপের মুখ্য বিষয় মানুষের ধর্মমত, এবং ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে কবির আত্মপরিচয়।

তিনি নানা প্রশ্ন করে এমনভাবে চিঠি লিখতেন যে, রবীন্দ্রনাথ সারবান উত্তর লিখতে উদ্বুদ্ধ হতেন। বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণকারিণী এই গরীয়সী রমণীর মুখ্য প্রশ্নটি ছিল আপনি এমন কবি ও ভাবুক হয়েও বৈষ্ণবধর্মকে কেন সমর্থন করেননি, এবং সাকার-উপাসনার বিরুদ্ধে বলেন কেন?

এ সম্পর্কে কবি বহু পত্রে বহু কথা লিখেছেন। এখানে আমি কেবল দ্বিতীয় পত্রখানি থেকে দীর্ঘ একটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রসঙ্গটি শেষ করবো।

আমি র্নিগুণ নিরঞ্জন নির্বিশেষের সাধক এমন একটা আভাস তোমার চিঠিতে পাওয়া গেল। কোনও একদিক থেকে সেটা হয়তো সত্য হতেও পারে- যেখানে সমস্তই শূন্য সেখানেও সমস্তই পূর্ণ-যিনি তিনি আছেন এটাও উপলব্ধি না করব কেন? আবার এর উল্টো কথাটাও আমারই মনের কথা। যেখানে সব-কিছু আছে সেখানেই সবার অতীত সব হয়ে বিরাজ করেন এটাও যদি না জানি তাহলে সেও বিষম ফাঁকি। আজ এই প্রৌঢ় বসন্তের হাওয়ায় বেলফুলের গন্ধ সিঞ্চিত প্রভাতের আকাশে একটা রামকেলী রাগিণীর গান থাকে ব্যপ্ত হয়ে- স্তব্ধ হয়ে একা একা বেড়াই যখন, তখন সেই অনাহত বীণার আলাপে মন ওঠে ভরে। এই হলো গানের অন্তর্লীন গভীরতা। তার পরে হয়তো ঘরে এসে দেখি গান শোনবার লোক বসে আছে- তখন গান ধরি “প্যালা ভর ভর লায়ীরি”। সেই ধ্বনিলোকে দেহমন সুরে সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে, যা কিছুকে সেই সুর স্পর্শ করে তাই হয় অপূর্ব। এও তো ছাড়বার জো নেই। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Rabindranath Tagore)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours