তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

চিৎপুর জায়গাটাকে যদি একটা আতরের দোকানের জায়গা থেকে দেখেন তাহলেও ঐতিহাসিক মনে হবে। কিন্তু আজ আপনাকে যে দোকানের কথা বলব, গোটা কলকাতায় যার কোনও জুড়ি মেলা ভার।

নাখোদা মসজিদের একেবারে কাছেই, জাকারিয়া স্ট্রিটে এমন একটা আতরের দোকান যা শুরু হয়েছিল প্রায় দুশো বছর আগে, ১৮২৪ সালে, আর ক্লায়েন্ট লিস্ট তো দেখলে চোখ ছানাবড়া হতে বাধ্য। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। এঁদের সকলের বাড়ির আতরের বরাত যেত, আজ্ঞে হ্যাঁ, হাজি খুদা বক্স নবি বক্স পারফিউমার্স-এর কাছে।

ইতিহাস বলছে, নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কলকাতায় এসেছিলেন ১৮৫৬ সালে৷ তাঁর সঙ্গেই শহর কলকাতায় বাড়তে থাকে সুগন্ধির চাহিদা।

নবাব ওয়াজেদ আলী খাঁ আসার পরে কলকাতার সংগীত একটা অন্য মাত্রা পায়। আতরের সাথে সংগীতের যোগ বড় নিবিড়। ১৮২৪-এ কনৌজ থেকে কলকাতায় পা রেখেছিল সুগন্ধি। নিয়ে এসেছিলেন তাঁরাই, যাঁদের নামে এই দোকান। খুদা বক্স এবং তাঁর ছেলে নবি বক্স।

সে ছিল এক বিচিত্র সময়। এখনকার আলো ঝলমল, ভিড়ে ঠাসা জাকারিয়া স্ট্রিটের সঙ্গে কোনও তুলনাতেই যাবেন না। তখন সন্ধ্যের পর আলোর বন্দোবস্ত না থাকায় বেলা গড়িয়ে আঁধার হলেই বন্ধ হয়ে যেত দোকান। আর কেনাবেচা শুরু হত ক’টায়? ভোর পাঁচটা। তেমনই জানাচ্ছেন হাজি খুদা বক্স নবি বক্স পারফিউমার্স-এর নবম প্রজন্ম নিয়াজুদ্দিন আল্লা বক্স এবং সফিউদ্দিন আল্লা বক্স। আলাপে তাঁরা আরও জানাচ্ছেন, তখন নাকি কলকাতা শহরেও তৈরি হত আতর৷

কী থেকে হত?

কেন, ফুল।

কলকাতায় ফুলের বাগিচা ছিল নাকি?

ছিল তো বটেই। এখন যেখানে বেঙ্গল কেমিক্যালস, তার ঠিক উল্টো দিকেই ছিল ফুলের বাগিচা৷ চিড়িয়ামোড় থেকে বরানগর পর্যন্ত ফুলের ও পাখির বাগান। সেখান থেকে আসত ফুল, আর সেই ফুল দিয়েই অনেক আতর তৈরি হত। ফলে, কলকাতায় আতর শুধু বিক্রিই হত, তৈরি হত না, এ কথা মোটেই ঠিক নয়। এখন ভাবলেও অবাক হতে হয়, কলকাতার মধ্যে ফুলের বাগান আর সেখান থেকে আসা ফুলের সুগন্ধি চলে যাচ্ছে আতরে। নিয়াজুদ্দিন এবং সফিউদ্দিন জানালেন, ঠাকুরবাড়ির নাকি প্রিয় ছিল গোলাপ এবং জুঁই ফুলের গন্ধ।

কিন্তু, এখন কোথায় ফুল আর কোথায়ই বা বাগিচা? এখন তো চারদিকে কংক্রিটের জঙ্গল। তা হলে এখন আতর আসে কোথা থেকে? এ প্রশ্ন উঠলে উত্তর আসবে দুটো। উত্তরে কনৌজ। দক্ষিণ-পশ্চিমে মুম্বই। সেখান থেকেই শিশি-ভরা আতর পাড়ি দিচ্ছে শহর কলকাতার আদিতম আতরের দোকানে।

আর, ফুল দিয়ে হবেই বা কী? হাজি খুদা বক্স নবি বক্স পারফিউমার্স-এর আক্ষেপ, এখন তো সিন্থেটিক-এর যুগ। কেমিক্যাল দিয়ে বানানো সব সুগন্ধ চলে যাচ্ছে আতরের মধ্যে। সেখানে সত্যিকার ফুলের ঠাঁই আর কোথায়ই বা? উও শাম কুছ আজিব থি যখন হোলির আগে সমঝদারেরা ভিড় জমাতেন দোকানে, আতর কিনে মিশিয়ে দিতেন গুলালের মধ্যে। এখন আপনি সুগন্ধি আবির পাবেন, কিন্তু ওই যা বললাম, সবই তো সিন্থেটিক, কোথায় সেই আতরের বেজোড় খুশবু? না আছে সেই সংগীত না আছে সেই আতর বা খুসবু।

এই দোকানের মধ্যে ঢুকলে আজও মনে হয় যেন ঊনবিংশ শতাব্দীর  ভিতরে আছে কিন্তু পাল্টেছে ঢের, হয়তো একটু ফিকে হয়েছে সেই সুগন্ধ, কিন্তু থেকে গিয়েছে ইতিহাস। জাকারিয়া স্ট্রিটে। একটি মাত্র দোকানে যেখানে সুগন্ধের মানচিত্রে একসঙ্গে মিলে যাচ্ছে নবাবি আমল এবং ঠাকুরবাড়ি, বাংলার সে কাল আর এ কাল।

(www.theoffnews.com - attar Haji Khuda Bukhsh Nabi Bukhsh Perfumers)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours