তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

আধ্যাত্মিকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমি কে? নিজেকে চেনা।

দুই, এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড বা সৃষ্টির কর্তা কে? কি রহস্য।

আধ্যাত্মিকতা মানে বিশেষ কোন অনুশীলন নয়। এটা জীবন যাপনের এক ধরন। সেখানে পৌঁছতে গেলে, অনেক কিছু করার আছে। এটা আপনার বাড়ির বাগানের মতন। যদি মাটি, সূর্যের আলো বা গাছ যেমন তেমন ভাবে থাকে তাহলে ফুল ফুটবে না, আপনাকে সেগুলো নির্দিষ্ট ভাবে রাখতে হবে। যত্ন নিতে হবে। সেরকম ভাবেই আপনি যদি আপনার শরীর, মন, আবেগ, শক্তি এগুলোকে বিশেষভাবে পরিচর্যা করেন তাহলে আপনার মধ্যে আলাদা কিছু একটা প্রস্ফুটিত হবে – সেটাই আধ্যাত্মিকতা। যতক্ষণ আপনার বিচারবুদ্ধি অপক্ক রয়েছে সেটা সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখে। কিন্তু যখনি সেটি পরিণত হয়, তখন সেটি সবকিছুকে এক আলাদা মাত্রায় অনুভব করতে শুরু করে।

যখনই কোনও মানুষ তার নিজের অভিজ্ঞতার  বাইরে বৃহত্তর কিছু অনুভব করেন, সেটাকেই আমরা চিরাচরিত ভাবে ভগবান বলে এসেছি। ভগবানের গোটা ধারণাটাই হল – আপনার চেয়ে বৃহত্তর কিছু। সেটা কোনও মানুষ হতে পারে, অনুভূতি হতে পারে, প্রকৃতির কোনও দিক হতে পারে। কিন্তু এটাকে কি আধ্যাত্মিক বলা যায়? না, এটা স্রেফ জীবন। যখন আমি বলছি ‘স্রেফ জীবন’ আমি কিন্তু ব্যাপারটাকে একেবারেই ছোট করছি না। জীবনই শ্রেষ্ঠতম। কিন্তু একমাত্র যখন আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা বিহ্বলকারী, প্রগাঢ় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে, তখনই আপনি এই প্রশ্ন করেন যে এটার সৃষ্টিকর্তা কে।

আপনি যদি জীবনের উৎস বা প্রক্রিয়াকে জানতে চান, তাহলে এটা মানবেন তো যে আপনার নিকটতম সৃষ্টির নজির আপনার নিজের শরীর? এই শরীরে স্রষ্টা বন্দী হয়ে রয়েছে। এটা যেন আপনার নজর এড়িয়ে না যায়। যদি আপনি নিজের মধ্যে সৃষ্টির উৎসর সন্ধান খুঁজে পান, তার মানেই আপনি আধ্যাত্মিক।

ভগবানে বিশ্বাস করা মানেই কি আধ্যাত্মিক হওয়া?

একজন অনীশ্বরবাদী আধ্যাত্মিক হতে পারেন না। একজন ঈশ্বরবাদীও আধ্যাত্মিক হতে পারেন না। এর কারণ হল এই দুজনের মধ্যে তফাৎ নেই। একজন বিশ্বাস করেন ভগবান আছেন, অন্যজন বিশ্বাস করেন ভগবান নেই। সত্য আপনার জানা নেই, এটা স্বীকার করার মতন সততা যদি আপনার না থাকে তাহলে সেটা আপনার সমস্যা। তাই, আদতে এই দুই ধরণের মানুষই এক, কেবল বিশ্বাসের বস্তুগুলো আলাদা। একজন আধ্যাত্মিক মানুষ হল সেই ব্যক্তি যিনি বুঝেছেন যে তিনি সত্য কি তা জানেন না, এবং তাই তিনি অনুসন্ধান করছেন।

কোনও কিছু বিশ্বাস করে নেওয়া মানে আপনি বাকি সবকিছুর থেকে চোখ বন্ধ করে নিলেন। এই গোটা বিশ্বের সমস্যা ভালো-মন্দ নিয়ে নয়, যেটা নাকি প্রচার করা হচ্ছে। সমস্যাটা বিভিন্ন মানুষের বিশ্বাসের মধ্যে সংঘর্ষ। কোন একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকার প্রবণতাটা যত না আধ্যাত্মিক তার চেয়ে অনেক বেশী মনস্তাত্বিক। কোন কিছুকে আঁকড়ে ধরে থাকলে নিরাপদ মনে হয়, মনে হয় আপনি অনেক কিছু জানেন। এটা অত্যন্ত অপরিণত মনের ফল। আপনি যদি সৃষ্টির সম্বন্ধে কিছুই না জানেন তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আদতে আপনি কোনও কিছুই জানেন না। এবং সেটা একটা সুন্দর ব্যাপার! আপনি এটা দেখুন নিজের অন্তরে নিজেকে কিভাবে আনন্দময় করে তুলবেন, যেটা কিনা আপনার হাতে রয়েছে।

আপনি যদি ভাবেন ,জানতে পারেন এই বিশ্ব প্রকৃতির রহস্য সমন্ধে আপনি কিছুই জানেন না, এইটুকু উপলব্ধি মানেই আপনার জ্ঞানের যাত্রা পথ শুরু হয়েছে। দার্শনিক সক্রেটিস অনেক আগে বলে গিয়েছিলেন আমি যে কিছুই জানি না এটাই আমি জানতে পেরেছি, এই অর্থে আমি জ্ঞানী আর যে মনে করে যে অনেক কিছু বুঝে গেছে অর্থাৎ সে বুঝতে পারেনি সে কিছু জানে না অর্থাৎ মূর্খ। এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড এর সাথে আমরা সবাই যুক্ত।

কিন্তু এই যোগকে বুঝতে পারে বা উপলব্ধি করতে পারে সেই হলো আত্ম জ্ঞানী পুরুষ। Unknown god (অচেনা ঈশ্বর)।

একজন প্রশ্ন করেছে, এতো করোনায় মরছে ভগবান কি আদৌ আছে।? What is unknown god? যেটা আমি প্রায় বলি। God is not known to us. Its a belief only। আর যখনই এটা বিশ্বাস করি তার মানেই সন্দেহ আছে। if you have mastery over your mind, means you can fully control your mind। তুমি দুঃখেও ভেঙে পড়ছো না আবার সুখেও উত্তেজিত নও, কিন্তু কুল আছো।

Then you are god। no 2) if cant feel that you are connected with great cosmos then god is unknown to you।

তোমার বা সবার ভিতরেই আছে চৈতন্য। কিন্তু মানুষ ছুঁতে পারে না। যে ছুঁতে পারে সেই ঈশ্বর। আর উপরওয়ালা বলে কিছু নেই, নিচওয়ালা কথাটা অনেক জীবন্ত এবং বাস্তবিক। আমাদের দেশে ভগবান বলতে কোনও অলৌকিক শক্তিকে বোঝায় না।

মানুষই ভগবান কিন্তু খুব কম মানুষ এটা অনুভব করতে পারে বা বুঝতে পারে। গৌতম বুদ্ধের একটা গল্প আছে। এইটা বলা এইখানে প্রাসঙ্গিক। একদিন সকালে এক চার্বাক পন্থী জিজ্ঞেস করলো বুদ্ধকে ঈশ্বর কি আছেন? বুদ্ধ খুব কম কথা বলতেন, উনি বুঝেছিলেন যে এই ব্যক্তি ঈশ্বর বিরোধী।

বুদ্ধ উত্তরে বললেন ঈশ্বর আছে। এইবার ওই দিন  বিকেলে আর একজন ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষ এলেন। উনি বুঝলেন বুদ্ধ হলো আত্ম জ্ঞানী মানুষ উনাকে জিজ্ঞেস করা যাক। জিজ্ঞেস করলেন ঈশ্বর কি আছে। বুদ্ধ হেসে বললেন ঈশ্বর নেই। সবাই অবাক হয়ে গেল কেন বুদ্ধ একই দিনে দুই রকম কথা বললেন। আসলে বুদ্ধ বোঝাতে চেয়েছিলেন  তোমরা অনুসন্ধান করো কেবল বিশ্বাসে থেমে  থেকো না। অর্থাৎ যে মানুষটি বিশ্বাস করে ভগবান নেই আর যে বিশ্বাস করে ভগবান আছে এরা সবাই একই জায়গায় আছে। প্রত্যেকেরই সন্দেহ আছে তাই বিশ্বাস ও অবিশ্বাস এর মধ্যে আছে। ঈশ্বর আছে কিন্তু তোমরা যে ভাবে ঈশ্বরকে দেখতে চাইছো ওই ভাবে কোনও ঈশ্বর নেই। its better to doubt than to belief।

ভিন্ন ভিন্ন পথে খুঁজে নাও। কোনও একটি পথ সত্য নয়। যত মত তত পথ। ওই কারণেই god is unknown। জয়গুরু।আপনি নিজেই একটা ব্রহ্মান্ড আবার অসীম ব্রহ্মান্ড এর অংশ। এই প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ খুব সুন্দর বলেছেন, "বার বার আমি মৃত্যুর কবলে পড়িয়াছি। কতবার দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়াছে, কতবার পায়ে নিদারুণ ক্ষত দেখা দিয়াছে, হাঁটিতে অক্ষম হইয়া ক্লান্তদেহে বৃক্ষতলে পড়িয়া রহিয়াছি, মনে হইয়াছে এইখানেই জীবনলীলা শেষ হইবে। কথা বলিতে পারি নাই, চিন্তাশক্তি তখন লুপ্তপ্রায়। কিন্তু অবশেষে ওই মন্ত্র মনে জাগিয়া উঠিয়াছে: আমার ভয় নাই, মৃত্যু নাই; আমার ক্ষুধা নাই, তৃষ্ণা নাই। আমি ব্রহ্ম, আমি ব্রহ্ম। বিশ্ব প্রকৃতির সাধ্য নাই যে, আমাকে ধ্বংস করে। প্রকৃতি আমার দাস। হে পরমাত্মন্, হে পরমেশ্বর, তোমার শক্তি বিস্তার কর। তোমার হৃত রাজ্য পুনরধিকার কর। উঠ, চলো, থামিও না। এই মন্ত্র ভাবিতে ভাবিতে আমি নবজীবন লাভ করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছি এবং আজ এখানে সশরীরে বর্তমান আছি। সুতরাং যখনই অন্ধকার আসিবে, তখনই নিজের স্বরূপ প্রকাশ করিও, দেখিবে—সকল বিরুদ্ধ শক্তি বিলীন হইয়া যাইবে। বিরুদ্ধ শক্তিগুলি তো স্বপ্ন মাত্র। জীবন-পথের বাধাবিঘ্নগুলি পর্বতপ্রমাণ, দুর্লঙ্ঘ্য ও বিষাদময় বলিয়া মনে হইলেও এগুলি মায়া ছাড়া আর কিছুই নয়। ভয় করিও না, দেখিবে উহারা দূরে চলিয়া গিয়াছে। নিষ্পেষণ কর, দেখিবে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে; পদদলিত কর, দেখিবে মরিয়া গিয়াছে। ভীত হইও না। বার বার বিফল হইয়াছ বলিয়া নিরাশ হইও না। কাল নিরবধি, অগ্রসর হইতে থাকো, বার বার তোমার শক্তি প্রকাশ করিতে থাকো, আলোক আসিবেই। জগতে প্রত্যেকের কাছে সাহায্যপ্রার্থী হইতে পারি, কিন্তু তাহাতে কি ফল হইবে? কে তোমাকে সাহায্য করিবে? মৃত্যুর হাত কে এড়াইতে পারিয়াছে? কে তোমাকে মৃত্যু হইতে উদ্ধার করিবে? তোমার উদ্ধার সাধন তোমাকেই করিতে হইবে। তোমাকে সাহায্য করার সাধ্য অপর কাহারও নাই। তুমি নিজেই তোমার পরম শত্রু, আবার তুমিই তোমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আত্মাকে জানো; উঠো, জাগো; ভীত হইও না। দুঃখ ও দুর্বলতার মধ্যে আত্মাকে প্রকাশ কর,—প্রথমে ইহা যতই ক্ষীণ ও অনুভবের অতীত বলিয়া মনে হউক না কেন। তোমার এমন সাহস হইবে যে, তুমি সিংহগর্জনে বলিয়া উঠিবে: আমিই আত্মা, আমিই ব্রহ্ম। আমি পুরুষ নই, স্ত্রীও নই; দেবতা নই, দৈত্যও নই, কোন প্রাণী বা বৃক্ষাদিও নই। আমি ধনী নই, দরিদ্রও নই, পণ্ডিত নই, মূর্খও নই। আমার স্বরূপের তুললায় এই-সকল উপাধি অতি তুচ্ছ। আমি পরমাত্মা, আমি ব্রহ্ম। ওই যে দেদীপ্যমান চন্দ্র-সূর্য গ্রহনক্ষত্র-নিশ্চয় দেখিতেছে, উহারা আমার প্রভায় উদ্ভাসিত হইয়াই আলোক বিস্তার করিতেছে। অগ্নির যে রূপ, তাহা আমিই; বিশ্বের যে শক্তি, তাহাও আমি, কারণ আমিই পরমাত্মা, আমিই ব্রহ্ম।"

‘আত্মতত্ত্ব শ্রবণ করিবে, মনন করিবে, নিদিধ্যাসন করিবে।’ হাত যখন কাজ করিবে, মন যেন তখন জপ করিতে থাকে, ‘আমি ব্রহ্ম, আমি ব্রহ্ম।’ যতদিন না এই সত্য তোমার অস্থি-মাংসের সহিত মিশিয়া যায়, যতদিন না তোমার অন্তর হইতে নিজের ক্ষুদ্রতা দুর্বলতা দুঃখ এবং অমঙ্গলের ভয়াবহ স্বপ্ন চিরতরে তিরোহিত হয়, ততদিন জাগরণে ও স্বপ্নে ইহা চিন্তা কর এবং তখনই পরম সত্য তোমার নিকট আর ক্ষণকালও আত্মগোপন করিয়া থাকিবে না।

তথ্য ঋণ-- স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, 'সুবিদিত রহস্য', ২য় খণ্ড, জ্ঞানযোগ-প্রসঙ্গে, জ্ঞানযোগ (বঙ্গানুবাদক: স্বামী শুদ্ধানন্দ)

(www.theoffnews.com - Universal Vivekananda Buddha)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours