তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

দুর্গা পুজোর সুচনা হয়েছিল বহু প্রাচীন কালেই।বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার পরিচয় আছে। দুর্গার পুজো শুরুর যথার্থ নথি না পাওয়া গেলেও, অনেকেরই মতে, সম্ভবত মোঘল আমল থেকেই ধনী পরিবারগুলিতে দুর্গা পুজো করা হত। ইতিহাস বলছে দেবীর পুজো সম্ভবত ১৫০০ শতকের শেষ দিকে প্রথম শুরু হয়। সম্ভবত দিনাজপুর- মালদার জমিদার স্বপ্নাদেশের পর প্রথম পারিবারিক দুর্গা পুজো শুরু করেছিলেন। তবে এই দুর্গার রূপ ছিল অন্যরকম। লোককথা মতে আদি দুর্গার চোখ গোলাকার ও উজ্জ্বল এবং দেবী সাদা বাঘ ও সবুজ সিংহের উপর বিরাজ করেন।

অন্য সূত্রানুসারে, তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ন বা নদীয়ার ভবানন্দ মজুমদার বাংলায় প্রথম শারদীয়া বা শরৎ দুর্গা পূজা সংগঠিত করেন। এরপরে রাজশাহির রাজা এবং বিভিন্ন গ্রামের হিন্দু রাজারা প্রতি বছর এই পুজো আরম্ভ করেন। আবার কলকাতায় ১৬১০ সালে বারিশার রায়চৌধুরী পরিবার প্রথম দুর্গা পূজার আয়োজন করেছিল বলে জানা যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর রাজা নবকৃষ্ণদেব লর্ড ক্লাইভের সন্মানে কলকাতার শোভা বাজার রাজবাড়িতে দুর্গা পূজার মাধ্যমে বিজয় উৎসবের আয়োজন করেছিলেন এবং তাঁর জন্য বিদেশ থেকে নিকি বাঈ নামে এক নর্তকীকে আনিয়ে ছিলেন। ব্রিটিশ বাংলায় এই পূজা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায় এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুর্গা পুজো স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে জাগ্রত হয়।

১৯১০ সালে কলকাতায় প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে বারোয়ারি পুজোর শুরু হয়। সনাতন ধর্মতসাহিনি সভা, বাগবাজারে সার্বজনীনে একটি দুর্গোৎসবের সুচনা করেন যা সম্ভব হয়েছিল জনসাধারণের সহযোগিতার সাহায্যে। তারপর থেকে গোটা বাংলায় দুর্গা পুজোর প্রবল প্রচার হয় এবং বর্তমানে এটি বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তাই বাংলা ছাড়িয়ে এই উৎসব পারি দিয়েছে বিদেশেও।

ভারত তথা  পৃথিবীতে দুর্গোৎসবের কালক্রমিক ইতিহাস নির্মাণ করা এখনও সম্ভব হয়নি। এ কাজের উপযোগী সুস্পষ্ট ও অনুপুঙ্খ ধারাবাহিক তথ্য-উপাত্তও পাওয়া যায়নি। কোনও ইতিহাসবিদ বা সমাজবিজ্ঞানী ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীতে দুর্গোৎসবের উদ্ভবের ইতিহাস ও আনুষঙ্গিক ঘটনাপঞ্জি নির্ভরযোগ্য দলিলপত্র ঘেঁটে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হননি। ফলে কখন, কীভাবে দুর্গোৎসব শুরু হলো তা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে পুরাণ, মহাভারত, রামায়ন, ধর্মীয় কাব্য, নানা ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও সূত্র থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় কৃষির সঙ্গে শারদীয়া দুর্গা পূজার নিবিড় সম্পর্ক আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় রঘুনন্দনের ‘দুর্গোৎসব তত্ব’-এ। এ পূজাতে সারা গায়ে লতাপাতায় সাজিয়ে ও কাদামাটি মেখে উৎসবে অংশগ্রহণ করা হতো। দুর্গা পূজার সঙ্গে মিলে আছে অরণ্য ও কৃষি সংস্কৃতির ধারা। দুর্গা পূজার সঙ্গে কৃষি সম্পর্কের প্রমাণ মেলে দুর্গোৎসব তত্ত্বে রঘুনন্দনের ‘ধত ভবিষ্য’ বচনে। রামপ্রসাদ চন্দের লিখিত ‘দুর্গোৎসব’ প্রবন্ধটির কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে, ‘…সুতরাং দুর্গা যদি মূলত শস্য প্রসবিনী দেবী হন তবে মহিষাসুরকে শস্য নামক বন্য পশুর এবং অনাবৃষ্টির বিগ্রহ মনে করা যাইতে পারে। সুতরাং মহিষাসুরমর্দিনীর পূজার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো শস্য উৎপাদনের এবং রক্ষার জন্য বসন্তে এবং শরতে শাকম্ভরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং আনন্দ উৎসব।’ প্রকৃতি তথা ব্রহ্মান্ডের প্রতি মন ও পূজাকে কেন্দ্রীভূত করা। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Mahalaya Durgapuja)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours