দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:

"ডাকিছে মেঘ হাঁকিছে হাওয়া, সময় গেলে হবে না যাওয়া"—বুঝতে পারছি কিন্তু আমাদের এবারের গন্তব্যে পৌঁছনোর আগে ব্রজকিশোরী দেবী হাতটি ধরে থামিয়ে দিয়েছেন।

কে ব্রজকিশোরী দেবী?

অম্বিকা কালনার লালজী মন্দির ঘুরে দেখতে হলে, সবটুকু জানতে হলে ব্রজকিশোরী দেবীকে না জানলে কিছুটা ফাঁকিতে পড়ে যাব আমরাই। তাঁর কিছুই আসবে-যাবে না। ব্রজকিশোরী দেবী বৃন্দাবন দর্শনের মানত পূরণার্থে লালজী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন, এটি হচ্ছে মন্দিরটি তৈরির মূল কথা। কিন্তু অনুসন্ধিৎসু পাঠক মাত্রেই জানতে চাইবেন কে ইনি?শোনা যায় ব্রজকিশোরী দেবী কীর্তিচাঁদের মাতা।তাই কি? 

এখানেই কিছু কথা এসে যায়। আজকের এই দিন বদলের যুগে কোনও নারী যখন শুধুমাত্র 'কারও মা', 'কারও স্ত্রী' হিসাবে পরিচিতি পেতে লজ্জা বোধ করে, তখন এই ব্রজকিশোরী দেবীর কথা জানলে মনে হবে কারও 'মা' বা 'স্ত্রী' হয়ে পরিচিতি লাভ করলেও ব্যক্তি মানুষটির ব্যক্তিত্ব মলিন হয়ে যায় না। আর যদি 'মা' বা 'স্ত্রী'র পরিচয়টিই বড়ো হয়ে দাঁড়ায় তবে সত্য পরিচয়টি উদ্ঘাটন না করলে তাঁকে অসম্মানিত করা হয়। 

ব্রজকিশোরী দেবী রাজমাতা কিন্তু কীর্তিচাঁদের মাতা নন। ইতিহাস বলছে, ১৬৮৯ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের এক ফরমান অনুসারে কৃষ্ণরাম রায় পরগনা বর্ধমানের জমিদার ও চৌধুরী পরিচয়ে সম্মানিত হন। কীর্তিচাঁদ উত্তরাধিকার সূত্রে ৪৯টি মৌজার জমিদারি লাভ করেন। ১৭২৮ - ১৭৩২ খ্রীষ্টাব্দে কীর্তিচাঁদের পুত্র চিত্রসেন রায় ফরমান বলে বহু অঞ্চল লাভ করেন। ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে কীর্তিচাঁদের মৃত্যুর পর চিত্রসেন রায় মুঘল সনদ অনুযায়ী 'রাজা' উপাধি সহ পিতার জমিদারি লাভ করেন। (তথ্য-'বর্ধমানের ধর্মীয় জীবনে বর্ধমান রাজের ভূমিকা') 

অতএব, কীর্তিচাঁদকে রাজা বলা যায় না। চিত্রসেন রায় বর্ধমান রাজ বংশের প্রথম রাজা। ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে জমিদারি লাভ করার অধিকার বলেই অম্বিকা কালনায় সিদ্ধেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা তিনি করেন।

ওই বৎসরই লালজী মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়, কীর্তিচাঁদের মাতা নয়, কীর্তিচাঁদের মহিষী ব্রজকিশোরী দেবীর ইচ্ছায়। এখানে আবার প্রশ্ন আসতে পারে 'মহিষী' কেন 'মাতা'র আজ্ঞাতেও তো হতে পারে! হতেই পারে। কিন্তু বর্ধমানের রাজ অন্তঃপুরিকাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এমন কি স্বয়ং বর্ধমান রাজবংশের বংশধর প্রণয়চাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বলছে বর্ধমান রাজবংশের রাজকুমারী সত্যবতীর আগে তেমন কোনও রাজ অন্তঃপুরিকার নাম শোনা যায়নি। এই সত্যবতী হলেন কৃষ্ণরাম রায়ের কন্যা যিনি চিতুয়া বরোদার শোভা সিংহের আক্রমণের হাত থেকে বর্ধমান রাজবংশকে রক্ষা করেছিলেন। বর্ধমান রাজপুরীতে শোভা সিংহের মৃত্যু তো ঐতিহাসিক ঘটনা! তখন কোথায় ব্রজকিশোরী দেবী! রাজ অন্তঃপুরিকাদের ইতিহাসেই পাওয়া যাচ্ছে "সত্যবতীর পর যে রাজপুরনারীর নাম" জনপ্রিয়তার শীর্ষে, নানা রকম জনহিতকর কাজে, তিনি "কীর্তিচাঁদের মহিষী" ব্রজকিশোরী দেবী। অর্থাৎ তিনি রাজা চিত্রসেন রায়ের মাতা।ব্রজকিশোরীর আজ্ঞাতেই রাজা চিত্রসেন লালজী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বর্ধমান রাজাদের আগে-পরে নামের তালিকায় (কীর্তিচাঁদ —চিত্রসেন —তিলোক বা ত্রিলোক চাঁদ —তেজচাঁদ—প্রতাপচাঁদ—মহাতাবচাঁদ -আফতাব চাঁদ —বিজয়চাঁদ—উদয় চাঁদ) সকল 'চাঁদ' এর আড়ালে প্রথম রাজা চিত্রসেনই ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন। মা হয়ে সইতে পারেন? তাই সত্য উদ্ঘাটনের জন্য রাজমাতা লালজী মন্দিরে প্রবেশের মুহূর্তে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। 

ব্রজকিশোরীর পর থেকে সকল রানির নাম এমনকি একজন রাজার একাধিক রানির নাম জানা যাবে সহজেই। 

এবার পরম ভক্তিমতি রাজমাতার আতিথ্যে ভগবানের সান্নিধ্যে আসব লালজী বাড়িতে, যাকে ওই চত্বরের প্রধান মন্দির বললেও ভুল হবে না কারণ এখনও কিছু স্থানীয় মানুষ 'রাজবাড়ি যাচ্ছি' বলে ওই লালজী বাড়ি যাওয়ার কথাই বোঝান।রাজবাড়ি চত্বরে প্রথম মন্দির ওই লালজী মন্দির (১৭৪০)। লালজী বাড়ির বিগ্রহ নিয়েও রয়েছে অনেক গল্প।

রাজমাতা চলেছেন গঙ্গাস্নানে। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Ambika Kalna)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours