দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:
গাজনের সন্ন্যাসী একটা শূল বিঁধিয়ে চড়কি নাচন দেখায়; নেহাতই এক সংসারী মানুষ হয়ে আমি, পিঠে সাতটি শূল গেঁথে কী চড়কি পাক খাচ্ছি! বসে আছে বন্ধুরা কালনা রাজবাড়ির পিত্যেশে! আর আমি —হা-পিত্যেশ!
এবার সত্যি এসে গেছি। চলো!
রাজবাড়ি চত্বর! হ্যাঁ, কালনায় শুধু 'রাজবাড়ি' নয়, 'রাজবাড়ি চত্বর'। আগের পর্বে রাজাদের নাম আর ইতিহাস খানিকটা বলে রেখেছিলাম এই কারণে, যে, আমাদের রাজবাড়ির সঙ্গে যে নামগুলি জড়িয়ে থাকবে তাঁদের আর অচেনা লাগবে না। রাজা কীর্তিচাঁদ থেকে প্রতাপচাঁদ পর্যন্ত নাম পাওয়া যাবে কালনার মন্দিরগুলি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। মহাতাবচাঁদ থেকে উদয়চাঁদ পর্যন্ত (রাজন্য প্রথা বিলোপ পর্যন্ত) রাজাদের পাব তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে।
এখন যে জায়গাকে ফটক দ্বার বলা হয়, সেখানে ছিল রাজবাড়ির 'ফটক' অর্থাৎ দরজা। এখন শুধু নামটুকু আছে। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া না থাকলেও রাজার গরু থাকত 'গয়লা পাড়া'য়।সেই নামটি এখনও আছে; বলা বাহুল্য, রাজার না হোক; গরু এবং তার সেবক এখনও আছে সে পাড়ায়, তাই আমাদের জন্য গরুর দুধও আছে।
ফটক দ্বার পেরিয়ে চক্ বাজারের মধ্যে দিয়ে গিয়ে রাজবাড়ির প্রধান দরজা। এই দরজা ধরে রেখেছে আস্ত একখানি বাড়ি। এই বাড়ির উপরে নহবতখানায় এককালে ভোরবেলা ভোরের রাগিণী বাজিয়ে কালনাবাসীর ঘুম ভাঙানো হতো। নীচতলায় থাকত রাজ কর্মচারী। শিব চতুর্দশী থেকে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত রাজবাড়িতে চলত রামগান। যাঁরা গান শোনাতে আসতেন তাঁরাও থাকতেন এই বাড়িটিতে। ১৯৭২ খ্রীষ্টাব্দে বাড়িটি আঠারো হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়, সিপিএম পার্টির কার্যালয় হয় সেখানে। আর এখান থেকেই শুরু এখনকার রাজবাড়ি চত্বর।
অম্বিকা কালনার রাজবাড়ি, তথাকথিত আর কয়েকটি রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ির আদলে নয়। রাজার বাসস্থানকে যদি রাজবাড়ি বলা হয়, তবে এখানেই বলে রাখা ভালো, এখানে রাজার বাসস্থানটি বাইরে থেকেই দর্শন করতে হবে। তাঁদের ব্যবহৃত খাট-পালঙ্ক, বিষয় বৈভব কিছুরই দর্শন মিলবে না। বাড়িটি এই চত্বরের একটি পাশে পড়ে আছে। সুন্দর আলসে দেওয়া বড় তিন তলা রাজবাড়িটি আজ অযত্নে শ্রীহীন। ছোটোবেলায় সেখানে মিলিটারিদের দেখেছি, সঙ্গে দেখেছি বন্দুকও। কখনও পিসিমণি, কখনও বাবার সঙ্গে ভিতরে ঢুকেছি কিন্তু তখন এত ছোটো ছিলাম পরিষ্কার করে কিছু মনে পড়ে না। চোখে ভাসে, ভিতরে বড়ো বাঁধানো উঠোন মতো, একখানা ঘর খোলা। যে ক'টি মানুষ রয়েছে তাঁদের গায়ে মিলিটারিদের পোশাক আর বন্দুক। সে রাস্তা একটু নির্জন থাকাতে বেশি যেতাম না। পরে শুনেছি একটা অংশে ভূমি সংস্কার (সেটেলমেন্ট) আপিস বসানো হয়েছে। কিন্তু সে বাড়ি এখন তালাবন্ধ। জীর্ণ অবস্থা বাড়িটির। আশার কথা এই যে, রাজার এই বাসাবাড়িতে যাত্রীনিবাস তৈরির পরিকল্পনা চলছে। এটা আমাদের কাছে বড় আনন্দের বিষয়।
আমরা রাজার বাসাবাড়ি বাইরে থেকে দেখে, প্রধান দরজার এক্কেবারে সোজা রাস্তাটি ধরব। দু'পাশে দুটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মাঠের মাঝখান দিয়ে লাল মোরামের পথ। ওই দু'টি মাঠে রাজাদের গোলাপ বাগান ছিল। বিভিন্ন রঙের গোলাপ ফুটত সেই বাগানে। আমাদের ছোটোবেলায় এই মাঠ দু'টিতে স্কাউট এবং গাইডের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। আর মাঝের ওই পথের বাঁদিক ঘেঁষে ছিল এক বিশাল বকুল গাছ। তার তলায় উঁচু বেদিতে ছিল এক কামান। কামানটিতে বেলা বারোটা বাজলে তোপ দাগা হতো। কামানের গোলা বেরিয়ে যেত প্রধান দরজার উপরে তৈরি নির্দিষ্ট গোলাকার পথে। বর্তমানে কামানটি তুলে নিয়ে প্রতাপেশ্বর মন্দিরের পাশে দর্শন যোগ্য করে রাখা হয়েছে।
আরও একটু সোজা এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে উঁচু পাঁচিলে ঘেরা এক মন্দির। প্রবেশ পথে পৌঁছতে মন্দিরকে ডান হাতে রেখে পেরোতে হবে আরও অনেকটা পথ। সেই পথ পেরোতে গেলে বাঁহাতে পাব বিশাল এক মাঠ। এই হলো আমাদের রাজবাড়ির মাঠ। আগে রাস্তা থেকে অনেকটা উঁচু ছিল এই মাঠ। এখন রাস্তা উঁচু হয়েছে, না মাঠের মাটি ধ্বসে গেছে জানি না, অনেকটা নীচু লাগে। ওই মাঠে রাজার আমলে কী ছিল? (ক্রমশঃ)
(www.theoffnews.com - Ambika Kalna)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours