দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:
সৌন্দর্য বস্তুটা যে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে তা রাজবাড়ির মাঠ থেকে নেমে এসেই ছোট্ট, কোমর পর্যন্ত উচ্চতার রিভলভিং গেট দিয়ে অম্বিকা-কালনার রাজবাড়ির মন্দির অঙ্গনে প্রবেশ করলে, মানতেই হয়। রাজবাড়ির মাঠ থেকেই চোখে পড়ে একই আকাশের নীচে সুবিশাল মন্দির প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণে প্রশস্ত মাঠ, কেয়ারি করা ছোটো ছোটো বাহারি গাছের মাঝখান দিয়ে ইটে বাঁধানো রাস্তা, শীতে যেতে পারলে কিছু মরশুমি ফুল। এখানে রয়েছে অসাধারণ স্থাপত্যের নিদর্শন টেরাকোটার ছোট, বড়, মাঝারি মাপের মন্দির, ছাদবিহীন রাসমঞ্চ। কোনও কোনও মন্দির ঘিরে রয়েছে মন ভোলানো গল্প। বছরের যে কোনও সময় দর্শনার্থীর ভিড় এখানে।
ছোট্ট ঘোরানো গেট পেরিয়ে মন্দির আঙিনায় ঢুকেই রয়েছে বাঁদিকে উঁচু বারান্দা ঘেরা টেরাকোটার ফলক দিয়ে তৈরি রূপেশ্বর শিবমন্দির। অর্ধগোলাকৃতি কয়েকটি সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দিরে উঠলে দেখা যাবে মন্দিরের গর্ভগৃহে বড়ো কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। বছরের যেকোনও সময় বিকেলে দেখা যাবে মন্দিরের উঁচু দাওয়া আলো করে বসে থাকা বয়স্ক মানুষদের। স্বয়ং মহাদেবও সব সময় নির্জনতা পছন্দ করেন বলে মনে হবে না। সেজন্য অম্বিকা কালনাকে 'বারাণসী সমতুল' না বলে 'বার্ধক্যের বারাণসী' বলাই ভালো মনে হয়।
এই মন্দিরের পাশে পাঁচটি নাতিউচ্চ শিবমন্দির বা পঞ্চরত্ন মন্দির। মন্দিরগুলিতে ততদিন শিবলিঙ্গ ছিল যতদিন রাজা পাহারাদার রেখেছিলেন। রাজন্য প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় দারোয়ান পদের বিলুপ্তি ঘটে।আর পাহারা না থাকলে বিগ্রহের বুঝি মন্দিরে বসে থাকতে ভালো লাগে না। ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকারে বিলীন হয়ে যান। পড়ে থাকে শূন্য বেদী। এই মন্দিরগুলির ফাঁক (প্রশস্ত পথ নয় বলেই 'ফাঁক ফোঁকর' শব্দটা মাথায় এল) দিয়েই পৌঁছতে হবে মন্দিরগুলির ঠিক পিছনেই কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরে।
বাইরে সাধারণ কিন্তু উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা মন্দির প্রাঙ্গণে ঢুকতে হবে ছোট্ট এক দরজা দিয়ে। ঢুকে বিশাল এক মন্দির প্রাঙ্গণে এসে মুগ্ধ হতেই হবে। ৬৫ ফুট উচ্চতার এই মন্দিরটি ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে বর্ধমানের মহারাজা তিলক চাঁদ বাহাদুরের মাতা লক্ষ্মী কুমারী দেবী প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ২৫ টি চূড়া বিশিষ্ট। মন্দিরে আড়াই ফুট উচ্চতার শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ এবং ২ ফুট উচ্চতার শ্রীরাধারাণীর বিগ্রহ রয়েছে।মন্দিরের গায়ে রয়েছে টেরাকোটার ফুলকারি কাজের সঙ্গে বকাসুর বধ, নৌকাবিলাস, অশ্বমেধ যজ্ঞের চিত্র।
রাধাকৃষ্ণের মন্দির থেকে নেমে একই উঠানের পূর্বদিকে শ্রীরামচন্দ্রের মন্দির। মন্দিরে তিন ভাইয়ের সঙ্গে শ্রীরামচন্দ্র, সীতাদেবী, হনুমান এবং জাম্ববানের মূর্তি রয়েছে। পশ্চিমে বদ্রিনারায়ণের মন্দির। তাহলে তো কালনায় একবার আসতে পারলে ভারত ভ্রমণের আনন্দ পেতেই পারেন! দক্ষিণে বিরাট রন্ধনশালায় রয়েছে বিগ্রহের নিত্য সেবার ভোগের ব্যবস্থা। মন্দিরের মধ্যেই নিত্য সেবার জন্য ফুলের বাগান। একটি ইঁদারা রয়েছে জলের যোগানের জন্য। জনসাধারণের ছোটোখাটো লৌকিক অনুষ্ঠানে, দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত প্রসাদ পাওয়ানোর ব্যবস্থাও করা যায় এই মন্দির প্রাঙ্গণে। আবার, কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার মতো জায়গাও রয়েছে এখানে। ভোরের হাওয়া গায়ে মেখে শরীরচর্চাতেও বাধা দেবে না কেউ। এরপরও কি বলা যাবে 'এ মন্দিরে দেবতা নাই?' না ভালবেসে পারা যাবে কি এই মন্দিরকে?
এখনও শেষ হয়নি!
'বিজয় বৈদ্য’ নামে আলাদা করে ঘেরা একটি বিশাল শিবমন্দির রয়েছে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরের বিগ্রহের পিছনদিকে একই মন্দির প্রাঙ্গণে। মন্দিরে ঢুকেই সামনে সোজা একটু গিয়েই মন্দিরটি। আগে অর্থাৎ আমাদের ছোটোবেলায় এই মন্দিরটি গাছ-আগাছায় এমনভাবে অন্ধকার হয়ে থাকত, সাপের আড়ৎ আছে মনে হতো। কৃষ্ণচন্দ্র ভোররাত থেকে হাতছানি দিলেও 'ভোলে বাবা' ভয়ই দেখাতেন। তাই সব শেষে এই মন্দিরটির কথা বললাম। এখন সংস্কার করার ফলে অঙ্গনের অনুপম স্থাপত্য শিল্পকলা এই মন্দিরের আকর্ষণে জোয়ার এনে দিয়েছে। রাজবাড়ির মাঠের দিকে যাওয়ার জন্য একটি দরজাও রয়েছে মন্দিরটিতে। মহারাজা তিলক চাঁদ মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন পিতা মিত্রসেন রায় ও মাতা লক্ষ্মীকুমারী দেবীর সৌজন্যে।
করোনা কালে মন্দির চত্বর আগাছায় ঢেকেছে ঠিকই কিন্তু মন্দিরগুলি সংস্কার করা হচ্ছে এই অবসরে। আশা রাখি, সুসময় সত্যিই সুন্দর হয়ে ফিরে আসবে আমাদের কাছে। এবার লালজিবাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যাই। (ক্রমশঃ)
(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)
(www.theoffnews.com - Ambika Kalna)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours