ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

নব্বই দশকের আগে পর্যন্ত বিটিভির নাটকে গল্প ছিল, ছিল জীবনের নির্যাস। মধ্যবিত্ত সমাজ ড্রয়িংরুমের টেলিভিশন পর্দায় খুঁজে পেত তাদেরই জীবনের প্রতিফলন। গ্রামের খেটে খাওয়া সহজ সরল মানুষ খুঁজে পেত নিজের জীবনের ছোঁয়া। এর পর রাজনৈতিক বা সামাজিক কারনে বিটিভির নাটকের মান কিছুটা হলেও হারাতে থাকে। একই রকমের সেট আর স্বল্প বাজেটের নির্মানে দর্শক যখন ক্লান্ত তখনই চালু হয় প্যাকেজ নাটক। ১৯৯৫ সালে প্যাকেজ নাটকের মাধ্যমে স্বাধীন ভাবে নির্মাতারা নিজের মত করে গল্প বলার সুযোগ পান। বাজেট বাড়লো, গল্পে বৈচিত্র আসলো, লোকেশনে এলো নতুনত্ব। সব মিলিয়ে প্যাকেজ নাটক হয়ে উঠলো বাংলাদেশের মানুুষের প্রধান বিনোদনের আশ্রয়। ঠিক এ সময়ে বাংলা সিনেমায় শুরু হয় অশ্লীলতা। সিনেমা প্রেমী বাঙালী তখন সিনেমা হল থেকে মুখ ফিরিয়ে বিটিভিতে মনোনিবেশ করে। সবাই বিটিভি’র নাটকের অপেক্ষায় থাকতো। রাতে নাটক দেখার পর দিনে অফিস বা ক্লাসে গিয়ে গসিপ হতো। সে সময় হুমায়ুন আহমেদ, অরুন চৌধুরী, কায়েস চৌধুরী, ফেরদৌস হাসান, মোহন খান, মামুনুর রশীদ, আবদুল্লাহ আল মামুন একের পর এক উল্লেখযোগ্য নাটক নির্মান করতেন। নাট্যকার হিসাবে ছিলেন ইমদাদুল হক মিলন, প্রনব ভট্ট, মাসুম রেজা। এ সময়ে উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে ছিল তৌকির-বিপাশার প্রিয়জন, তৌকির-শমী’র কুসুম, আজিজুল-শমী’র নাটের গুরু, জাহিদ-শমী’র গাঙচিল ভালবাসা, হুমায়ুন আহমেদ নির্মিত নিতুর বিয়ে ভীষন জনপ্রিয়তা পায়। ধারাবাহিকের মধ্যে কায়েস চৌধুরী’র না, অরুন চৌধুরীর ছোট ছোট ঢেউ, শায়ের চৌধুরীর ভোলার ডায়রি, হুমায়ুন আহমেদের সবুজ সাথী, মামুনুর রশীদের ‘সুন্দরী’, মোহাম্মদ হোসেন জেমীর ‘দমন’, ‘লোহার চুড়ি’।

প্যাকেজের আওতায় হুমায়ুন আহমেদের নক্ষত্রের রাত, আজ রবিবার, হানিফ সংকেতের পুত্রদায়, অনন্ত হীরার বিষকাঁটা, রিঙ্গোর স্বপ্ন, আরিয়ানা। এ সময়ে প্যাকেজ নাটকের কল্যানে প্রসিদ্ধ হয় কিছু প্রোডাকশান হাউজ। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম ও ইনফ্রেম তাদের মধ্যে অন্যতম। এতে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। 

৯০ দশকের শেষে বাঙালীর ড্রয়িংরুমে বিনোদনের এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আসে বাংলাদেশের প্রথম টেরিস্ট্রিয়াল টেলিভিশন একুশে টেলিভিশন। বড় বাজেট, বড় আয়োজনের একের পর এক নাটক তাক লাগায় গ্রামের গল্প সালাউদ্দিন লাভলুর বন্ধুবরেষু, গিয়াসউদ্দিন সেলিমের শহুরে গল্প বিপ্রতীপ, মোস্তফা সারোয়ার ফরুকীর সুচরিতাসু, আহির আলমের প্রেত, অমিতাভ রেজার অপেক্ষয় বৃষ্টি, একটি গোল্ডফিশের অপমৃত্যু, আফসানা মিমির বন্ধন উল্লেখ যোগ্য। ধারাবাহিক নাটকের মধ্যে সেলিম আলদীন এবং মাসুম রেজার রচনায় এবং সালাউদ্দিন লাভলুর পরিচালনায় ‘রঙের মানুষ’ ভিন্নমাত্রা যোগ করে। ধারাবাহিকটি খুবই জনপ্রিয়তা পেলে এই আদলে আরো অনেক নাটকের জন্ম হয়েছে। তবে রঙের মানুষের মতো এত জনপ্রিয়তা আর কোন ধারাবাহিক পায়নি।

একুশে টেলিভিশনের সাথে প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন কিছু স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ। যারা বিটিভির স্বর্ণযুগের নাটক নির্মানে জড়িত ছিলেন। একঝাঁক তরুন পরিচালকের স্বপ্নচোখে নির্মিত হয়েছিল এসব অসাধারণ নাটক। এ ধারা অব্যাহত থাকে একুশে টেলিভিশন বন্ধ হবার আগে পর্যন্ত। তবে এনটিভি, এটিএন, চ্যানেল আই'ও ভাল নাটক উপহার দিয়েছে। 

বর্তমান সময়টাকে বলা হয়ে থাকে নাটকের মন্দাকাল। অর্থাৎ বাংলা নাটকের প্রতি নাট্যপ্রেমীরা আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই দিনে দিনে নাটকের প্রশংসা তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। এর কারন খুঁজতে গিয়ে অনেকে অনেক কারণ দর্শানোর চেষ্টা করছেন। নাটক নির্মানের প্রধান উপজিব্য হলো বাজেট বা অর্থ বরাদ্দ। এর উপরই নির্ভর করছে নাটকটির গুনগত মান কেমন হবে। আবার অনেক সময় নির্মাতার নিজস্ব কোয়ালিটির উপরও নির্ভর করে নাটকটির গুনগত মান কেমন হবে। কারণ নাট্য নির্মাতার কোয়ালিটি না থাকলে বাজেট বেশি হলেও তিনি গুনগত মানের নাটক নির্মান করতে পারবেন না। আমাদের দেশে নাট্য পরিচালকদের কোন শ্রেনী নির্বাচন করা নেই। যে কারণে নাটক নির্মানের বাজেট বরাদ্দের কোন পার্থক্য নেই। সিনিয়র নাট্য পরিচালক এবং জুনিয়র পরিচালকদের জন্য আলাদা কোন ক্যাটাগরি নেই। কর্তৃপক্ষকে বা প্রযোজককে খুশি করে যে যত পারছে নাটক নির্মান বাজেট বরাদ্দ নিচ্ছে। এতে এক শ্রেনীর অপেশাদার লোক নিজেকে পরিচালক পরিচয় দিয়ে ফায়দা লুটে নিচ্ছে। এ ধরণের তথাকথিত পরিচালকরা সাধারণত নতুন কোন ব্যবসায়ী বা বিত্তশালীকে বিভিন্ন চাকচিক্য লোভ দেখিয়ে অর্থলগ্নী করতে উৎসাহিত করেন। তারা মনে করছেন একজন ভাল ক্যামেরাম্যান এবং একজন ভাল সহকারী পরিচালক নিলেই নাটক নির্মান হয়ে যায়। এভাবে নাটক নির্মানের নামে চলছে প্রহসন। যার ফলে এই সব পরিচালকের নাটক অনেক সময় প্রচারিত হয় না। নির্মিত নাটক পড়ে থাকে ড্রয়ারবন্দী হয়ে। ফলে নতুন প্রযোজকরা নিরুৎসাহ হচ্ছেন। 

নুতন প্রযোজকদের মিডিয়ার নাটক নির্মান এবং প্রচারের জন্য বিক্রির বিষয়টি অজানা থেকেই যাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকেই ইচ্ছামতো নাটকের বাজেট নিয়ে নাটক নির্মান করছেন। কিন্তু প্রত্যেক টেলিভিশন চ্যানেল একই বাজেটের নাটক প্রচার করছে না। আমাদের দেশে বর্তমানে প্রোগ্রাম ভিত্তিক চ্যানেল আছে বেশ কিছু। তবে সব চ্যানেলে একই মানের নাটক প্রচার করে না। যে কারনে নাটকের মান বা নাটকের বাজেটে থাকে ব্যবধান। তাছাড়া এক চ্যানেল কমেডি ভিত্তিক নাটক প্রচারে আগ্রহ বেশি। অন্য অনেক চ্যানেল শহুরে প্রেমের নাটক প্রচারে আগ্রহ বেশি। আবার অন্য চ্যানেল সময়োপযুগি মেসেজধর্মী নাটক প্রচারে আগ্রহ বেশি। এছাড়াও কোন কোন চ্যানেলে বিদেশি আদলের নাটক প্রচারের আগ্রহেরও কম নেই। একটি একক নাটক নির্মান করতে সাধারণত ২-৩ দিন সময় লাগে। তবে বর্তমানে নাটকের বাজেট কমে যাওয়ার কারণে প্রযোজক বা পরিচালক এক দিনের মধ্যে নির্মানের কাজ সম্পন্ন করতে চেষ্টা করেন। এতে নাটকের মান কমে যাচ্ছে। 

বাংলা নাটকের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে হলে টেলিভিশনে নাটক প্রচারের বা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে আরো পেশাদারি মনোভাব থাকতে হবে। তা না হলে উপমহাদেশের প্রশংসিত বাংলা নাটকের অবস্থান বিলুপ্ত হয়ে যাবে। (সমাপ্ত)

(www.theoffnews.com - Bangladesh Bangla drama)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours