ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:
হিন্দু নারীদের কেবল মাত্র স্ত্রীধনের উপর অধিকার আছে। এখন জানা প্রয়োজন স্ত্রীধন আসলে কি? বিবাহ এবং বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারে একটি মেয়ে বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় স্বজন বা বিবাহে উপস্থিত যে কারো কাছ থেকে উপহার, উপঢৌকন পেয়ে থাকেন সেগুলি। স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্য যে কোন উপহার সামগ্রী। বাবা-মা এবং ভাই-বোন যেসব উপহার দেন বিশেষ করে অর্থকড়ি, সোনা এবং মূল্যবান অলংকার সামগ্রী।
হিন্দু মেয়েদের বিয়ের অর্থ হলো কন্যা সম্প্রদান। পুরো কন্যা সম্প্রদানের অনুষ্ঠানকেই বিয়ে বলা হয়। কন্যা সম্প্রদানের সময় মেয়েটিকে গোত্র ত্যাগ করে স্বামীর গোত্র ভুক্ত করে দেওয়া হয়। এই নিয়মের নাম কনকাঞ্জলি। মুলতঃ সমাজ এবং আত্মীয়-স্বজনের সামনে কনকাঞ্জলি নেওয়ার পর মেয়েটি শ্বশুরবাড়ির অংশ হয়ে যায়। এরই সঙ্গে মেয়েটি তার পিতার সমস্ত সম্পত্তির উপর থেকে অধিকার হারায়।
তবে অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে নিয়ম ভিন্ন। কোন হিন্দু মেয়ের বিবাহ হওয়ার আগে যদি তার পিতা মারা যায়, তাহলে অন্যান্য ভাইদের সাথে মায়ের সমান হারে বাবার সম্পত্তির মালিকানা পায়। কিন্তু হিন্দু সমাজে অবিবাহিত মেয়ে সংসারে রাখা নিষেধ। তবে বিবাহের আগ পর্যন্ত শুধুমাত্র বাবার সম্পত্তি ভোগ করতে পারবে। কখনো বিক্রি করার অধিকার পায় না।
বেদে এবং মনুস্মৃতিতে বলা হয়েছে, যারা যারা মৃত ব্যক্তির পিন্ডদান করবে তারা সবাই মৃতের সমস্ত সম্পদের অধিকারী হবে। সাধারণ নিয়মে ছেলেরাই পিতার পিন্ডদান করে থাকে। তাই ছেলেরাই পিতার সম্পত্তির প্রথম উত্তরাধীকারী হয়ে থাকে। ছেলে না থাকলে ছেলের ছেলে বা ছেলের নাতি সেই উত্তরাধীকারী হবে। তাও যদি না থাকে তবে মেয়ের ছেলে পিন্ড দান করে। সরাসরি মেয়ে নয়। মেয়ের ছেলে হবে এই সম্পত্তির উত্তরাধীকারী। তাও যদি না থাকে তবে ভাইয়ের ছেলেরা মৃত ব্যক্তির পিন্ডদান করে, ওই সম্পত্তির উত্তরাধীকারী হবে। বাংলাদেশের হিন্দু আইন-এর কোন রকম পরিবর্তন বা সংশোধন করা হয়নি। এখনো ১৯৩৭ সালের আইন বলবৎ রয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হিন্দু ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্র ভারত। এ দেশের ধর্মীয় আইনে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। সতীদাহপ্রথা বিলুপ্তি, বিধবা বিবাহ, বিবাহ রেজিষ্ট্র্রি, বাবার সম্পত্তির অংশীদারী। এমনকি মাত্র কয়েকমাস আগে পাস হয়েছে স্বামীর সম্পত্তির অংশীদারী আইন। ১৯৫৬ সালের ভারতীয় হিন্দু ব্যক্তিগত আইন (হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন) নারীকে উত্তরাধীকার সূত্রে সম্পত্তি প্রাপ্তির অধিকার প্রদান করে। পুত্রসন্তানরা পূর্বপুরুষের সম্পত্তি একটি অংশের প্রাপক ছিলেন, কিন্তু কন্যাসন্তানরা কেবলমাত্র তাদের পিতার প্রাপ্ত অংশের উপর একটি অংশ পেতেন। একজন পিতা যদি তার পূর্বপুরুষের সম্পত্তির দাবি ত্যাগ করতেন, তাহলে তার কন্যা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। তবে তার পূত্র তার নিজের অংশের উপর অধিকার বজায় রাখতে পারতেন। এমনকি বৈবাহিক জীবনে নিপীড়নের সম্মূখীন মহিলাদেরও তাদের পূর্বপুরুষের বাড়িতে বসবাসের কোন অধিকার ছিল না। বেশির ভাগ ভারতীয় পরিবারের মহিলাদের নামে কোন সম্পত্তির মালিকানা নেই। তাদের পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ পায় না। তাদের সুরক্ষার্থে থাকা আইনগুলির যথাযথ প্রয়োগের অভাবে নারীরা এখনো বহু ক্ষেত্রে জমি ও সম্পত্তির প্রকৃত অধিকার পায় না। ভারতে সম্পত্তির উপর নারীর অধিকার ধর্ম ও গোত্রের উপর নির্ভরশীল। বহু আইনি ও প্রথাগত জটিলতার জালে আবদ্ধ। ২০০৫ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধনের ফলে নারীকে এখন পুরুষের সমান ও বৈধ অধিকার প্রদান করা হয়েছে।
অথচ সেই দেশের নিকটবর্তী দেশ বাংলাদেশ। এদেশের হিন্দু আইনের মধ্যে রয়েছে কতো পার্থক্য। এখানে হিন্দু বিয়ে হয় অগ্নিকে সাক্ষী রেখে। সকলের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে হিন্দু স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয় না। বিষয়টি ঠিক নয়। হিন্দু মেয়েরা অসহায়। তাদের ভাগ্য নির্ধারন হয় ‘পতি বিনে গতি নাই’। কারণ বিয়ের পর বাপের বাড়িতে তাদের কোন অধিকার থাকে না। বিয়ের যৌতুক হিসাবে যা দেওয়া হয় তা স্বামী বা তার পরিবারের অধীনে চলে যায়। একজন হিন্দু মেয়ে যিনি নিজে আয় রোজগার করতে পারেন না, তিনি সংসারে গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকেন সারাজীবন। তার নিজের বলতে সংসারে কিছু থাকে না। শিশুকালে বাবার ওপর, যৌবন কালে স্বামীর ওপর এবং বৃদ্ধকালে সন্তানের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। তাহলে সমাজে তথা সংসারে মেয়েটির পরিচয় কি? তাঁর নিজের বলে কোন পরিচয় নেই। একবার চিন্তা করে দেখি, যে কন্যা সন্তানটি কোলজুড়ে এলে এত ভালবাসা, এত আহ্লাদ দিয়ে বড় করা হয়। তাকে বিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে পর করে দেয়। তার প্রতি কোন দায়-দায়িত্ব থাকে না। কি নিষ্ঠুর কাজ।
বিয়ের পর সব মেয়েদেরই রাজ কপাল হয় না। কারো কারো ভাগ্যে জোটে গঞ্জনা। কিন্তু বিয়ের সময় মেয়েটিকে শিখানো হয়, ‘পালকি চড়ে যাচ্ছো স্বামীর বাড়িতে, সন্তানের কাধে চড়ে চিতায় যাবা’। সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মেয়েটি গঞ্জনা সয়ে স্বামীর বাড়িতে পড়ে থাকে শুধুমাত্র দুই বেলা দু’মুঠো খাওয়া পরার জন্য।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধাব বিবাহ আইন পাস করেছিলেন। বর্তমান সময়ে ডিভোর্স আইন প্রবর্তক বলে কেউ আসেননি। বিয়ের সময় যেখানে দলিল নাই, সেখানে ডিভোর্স হবেই বা কি করে।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই, দ্রৌপদীরা হারিয়েছে একাধিক স্বামী। আর রাজকন্যারা হারিয়েছে বাবার অর্ধেক রাজত্ব। তবে সীতারা এখনো অগ্নিপরীক্ষা দেয়। জানি না কোন যুগে এ পরীক্ষার অবসান হবে।
হিন্দু মেয়েদের প্রতি পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। শাস্ত্র বা সমাজের দোহাই দিয়ে মেয়েদেরকে কোন ঠাসা করে রাখা হয়েছে এত কাল। এ ধারনা থেকে বের হয়ে আসার সময় হয়েছে। চাই নারী-পুরুষ সমান অধিকার। চাই বাবার সম্পত্তির সমান অংশীদারিত্ব। (সমাপ্ত)
(www.theoffnews.com - Bangladesh family asset hindu women)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours