দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:

রাজবাড়ির মাঠ আমাদের কাছে মুক্ত বাতাসের কারখানা। ভাণ্ডার শেষ হতে পারে, কিন্তু এ কারখানা বন্ধ হওয়ার নয়। 

এ মাঠ উন্মুক্ত আকাশের নীচে এক টুকরো দূষণমুক্ত পৃথিবী। প্রাতঃভ্রমণ, খালি হাতে ব্যায়াম থেকে শুরু করে বিকেল বেলা ফুটবল, ক্রিকেটের ব্যাট হাতে সকলেই ছুটছে রাজবাড়ির মাঠে। আমাদের স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কোনও কোনও বছর এখানেই অনুষ্ঠিত হতো। কয়েক বছর ধরে শীতকালে সমারোহের সঙ্গে  কয়েকদিনের জন্য পর্যটন উৎসবও হচ্ছে ওই মাঠে।

রাজার আমলে এই  বিশাল মাঠটির চারদিক টগর ফুলের গাছ দিয়ে বেড়ার মতো ঘেরা ছিল। মাঝে ছিল দেশ-বিদেশের গোলাপের বাগান। মোট চারটি ফুল বাগানের মধ্যে আগে দু'টির কথা বলেছি। এইটি সবচেয়ে বড়ো। ছিল এক বিরাট সূর্য ঘড়ি।বাবার সঙ্গে গিয়ে বুঝেছি সূর্য ঘড়ির ব্যাপারটা। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোদ আসবে বলেই অত্ত বড়ো মাঠখানা। সূর্যঘড়িখানা বহুদিন পর্যন্ত ছিল, পরে কারা যেন তুলে নিয়ে যায়। 'রাজা বিনে রাজত্ব আটকায় না'-একথা সত্যি হতে পারে; কিন্তু 'সে রাজাও নেই, আর রাজত্বও নেই'—ধ্রুব সত্যি।

গরমের ছুটি পড়লে ছোটবেলায় (ক্লাস থ্রি-ফোর) ‍ঠাকুমার কথা শুনে ভোর হতেই মাঠে যেতাম। মাঠটি একবার দৌড়ে প্রদক্ষিণ করতে প্রাণটা আমার সত্যি সত্যি ঠোঁটের কাছে চলে আসত। যাকে বলে 'ওষ্ঠাগত প্রাণ'। আর যারা দৌড়তে পারত তাদের আমি একদৃষ্টে দেখতাম, হাঁফাচ্ছে আর দৌড়চ্ছে। দাদুর কাছে রাজবাড়ির গল্প শুনে শুনে এমন হয়েছিল মাঠে দাঁড়ালেই আমি ভাবতে বসতাম, বেশ, এখানে রানিদের বাগান! রানিরা সাজি ভরে ফুল তুলছে! কতটা অন্তর গাছগুলো থাকতে পারে পা দিয়ে মাপতাম। একদিন সকালে হলো কী—একটা ফুটবল এসে হাঁটুর কাছে লাগল। খেলুড়েরা দৌড়ে এল, একজন বলে উঠল- "এই রে! তারাসাধন ভট্টাচার্যের মায়ের পায়ে লেগেছে। বলেই পা ঝাড়তে বসে গেল"। সেই থেকে ভোরবেলা একলা একলা মাঠে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

এ মাঠ আমার কাছে তেপান্তরের মাঠের সমান। মাঠ পেরোলে দেখা যাবে নতুন সমাজ বাড়ি। এটিও দর্শন যোগ্য। কিন্তু এই বাড়িটিতে ছেলেদের স্কুল করা হয়েছে। তাই যখন তখন প্রবেশের অনুমতি মিলবে না। ছবিতে দেখে নেব। মহিষমর্দিনী গার্লস স্কুল কিন্তু অন্যত্র। নতুন সমাজ বাড়িতে বিচার সভা বসত। হিসাবপত্র দেখা হোত। 

পুরোনো  সমাজ বাড়ি নিচের রাস্তায়। সে বাড়িটির এখন জরাজীর্ণ অবস্থা। আরও কিছু দিন পর 'জ্যোতিষ্ক লোকের পথে কিছু মাত্র চিহ্ন রাখিবে না'। এখানে তেজচাঁদ এবং তাঁর প্রধান মহিষী কমল কুমারীর সমাধি রয়েছে। 

এই পর্বে মহিষমর্দিনী স্কুলের ছবি দেখে নিয়ে মাঠ পেরিয়ে চলে যাব ছোট্ট এক রিভলভিং (revolving) গেটের কাছে। একজন একজন করে সবাই ঢুকে পড়ব। (ক্রমশঃ)

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Ambika Kalna)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours