দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:

তাহলে কী করে যেতে পারলেন মহাপ্রভু, গৌরীদাস পণ্ডিত অর্থাৎ পূর্বলীলার সুবল সখাকে ছেড়ে?

গৌরীদাস তো বলেই যাচ্ছেন—

"আমার বচন রাখ, অম্বিকা নগরে থাক, এই নিবেদন তুয়া পায়।

যদি ছাড়ি যাবে তুমি, নিশ্চয় মরিব আমি, রহিব সে নিরখিয়া কায়।।"

চৈতন্যদেব তাঁর নিজের হাতে লেখা (কপি করা) একখানি 'শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা' (তখন তো ছাপাখানা নেই, সবই হাতে লেখা পুঁথি) এবং বৈঠাখানা দিয়ে বললেন 'এই বৈঠা দিলাম, এই দিয়ে সব জীবকে ভবনদী পার করাও'। তাও গৌরীদাস নাছোড়।

এইবার তো আসল মজা। গৌরীদাসের প্রেমভক্তির জোরে আমরা পেয়ে গেলাম নিতাই-গৌরকে। কীভাবে? আমরা যেমন কোনও আত্মীয় বন্ধুকে ছাড়ার ইচ্ছে না হলে বাড়ির সদর দরজা অবধি একটু করে যাই আর থেকে যাওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করি, ঠিক তেমন গৌরীদাস আকুলি বিকুলি করছেন।

চৈতন্যদেব বললেন, 'গৌরীদাস! এমত আশা ছাড়।প্রতিমূর্তি সেবা কর।' তাও গৌরীদাসের মন মানে না। এত আকুলতা দেখে গৌরাঙ্গ ধীরে ধীরে বললেন "তাহলে এখানে থেকেই যাই।" সখার জন্য তো তাঁরও হৃদয় তোলপাড়। ফিরে এলেন গৌরীদাস আনন্দের সঙ্গে, নিতাই-গৌরকে নিয়ে। এসেই বিস্ময়ে হতবাক! চার মূর্তি! চৈতন্যদেব বলছেন এবার যেকোনও দুই মূর্তি রেখে দিতে।

"আকুল দেখিয়া তারে, কহে গৌর ধীরে ধীরে, আমরা থাকিলাম তোর ঠাঁই।

নিশ্চয় জানিহ তুমি, তোমার এ ঘরে আমি, রহিলাম এই দুই ভাই।।

এতেক প্রবোধ দিয়া, দুই প্রতিমূর্তি লইয়া, আইল পণ্ডিত বিদ্যমান। চারিজনে দাঁড়াইল, পণ্ডিত বিস্ময় ভেল, ভাবে অশ্রু বহয়ে নয়ান।।

পুনঃ প্রভু কহে তারে, তোর ইচ্ছা হয় যারে, সেই দুই রাখ নিজ ঘরে।

তোমার প্রতীতি লাগি, তোর ঠাঁই খাব মাগি, সত্য সত্য জানিহ অন্তরে।।"

দুই মূর্তি পেলেন গৌরীদাস, পেলাম আমরা, কালনাবাসী। 

এভাবে ভক্তের অধীন ভগবান বিগ্রহ রূপে ভক্তের প্রেম সেবা গ্রহণ করতে ভক্তের গৃহে বিরাজ করছেন। কালনার মহাপ্রভু সচল বিগ্রহ। বিগ্রহ চলেন! কথাও বলেন! ভক্ত মাত্রেই একথা বিশ্বাস করবেন। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরম হংস বলতেন তো মায়ের সঙ্গে কথা! নরেনের সকল দ্বন্দ্ব তো তিনিই ঘুচিয়েছিলেন! এমন ঘটনা এখানেও। গৌরীদাস পণ্ডিত নানান রকম অন্ন ব্যঞ্জন তৈরি করে ভোগ নিবেদন করেন। বিগ্রহ নৈবেদ্য স্বীকার করছেন না দেখে তিনি অভিমানে বলে ওঠেন—'আহার না করে যদি সুখে থাক তো, আমার রাঁধার কী প্রয়োজন বল?' প্রভুদ্বয় সহাস্যে বলেন- 'তুমি এত কষ্ট করে রন্ধন কর, তা দেখে আমাদের কষ্ট হয়। বহুবিধ পাক না করে সংক্ষেপে সমাধান কর'। পণ্ডিত বলেন - 'বেশ! কাল থেকে শাক আর সিদ্ধ অন্ন করে দেব।' একদিন পণ্ডিতের ইচ্ছা হলো বিগ্রহদ্বয়কে অলংকারে সাজাবেন। সকালে মন্দিরের দরজা খুলে দেখেন বহুবিধ অলংকারে অলংকৃত হয়ে বিগ্রহদ্বয় দাঁড়িয়ে আছেন। গৌরীদাস বিগ্রহ দর্শনে প্রেমাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। প্রভু বললেন- 'পুষ্পালংকারেই বেশি প্রীতি। আমাদের পুষ্পালংকার দিও।'

একবার গৌরপূর্ণিমা আসন্নপ্রায়। গৌরীদাস পণ্ডিত, তাঁর শিষ্য হৃদয়ানন্দের উপর সেবাভার দিয়ে বললেন, উনি ঠিক সময়ে আসবেন; যতদিন না আসছেন কোনও কিছুর ত্রুটি যেন না হয়। এদিকে অনুষ্ঠানকাল এগিয়ে আসছে, পণ্ডিতের দেখা নেই।গুরুদেব ইচ্ছা করে দেরি করছেন যে! নিরুপায় শিষ্য তখন উৎসবের যথোচিত নিমন্ত্রণ ও আয়োজন করলেন, গুরুদেব এসেই উদ্বিগ্ন না হন। গুরুদেব উৎসবের একদিন আগে এসে সব জেনেশুনে বাইরে ক্রোধ প্রকাশ করে বললেন 'আমি থাকতে যখন স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ করলে তখন যাও, স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান কর'। উপায় না দেখে গঙ্গাতীরে গাছের তলায় হৃদয়ানন্দ স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান শুরু করলেন। দুপুরে ভোগ নিবেদন এর সময় আরেক শিষ্য দেখেন মন্দিরে বিগ্রহ নেই। সঙ্গে সঙ্গে গুরুদেবকে সে কথা জানাতে, হৃদয়ানন্দের সঙ্কীর্তনে গিয়ে পণ্ডিত দেখেন দুই প্রভু সেখানে নৃত্য করছেন। বৈষ্ণবগণ হরিধ্বনি দিতে থাকলেন, গুরু-শিষ্য উভয়ে অনুষ্ঠান সমাপন করলেন। শ্রী গদাধর পণ্ডিতের ভাই বাণীনাথের পুত্র হৃদয়ানন্দ হলেন 'হৃদয়চৈতন্য' — পেলেন অম্বিকা কালনার শ্রীগৌর নিত্যানন্দের সেবার ভার। শেষ জীবন পর্যন্ত তিনি সেবা করে গেছেন। তাঁর সমাধিও রয়েছে মন্দিরে।গুরু-শিষ্য পরম্পরায় চলে আসছে নিত্যসেবা। কালনাবাসী সকলে সেবা কাজে পরোক্ষভাবে নিযুক্ত। কোনও অনুরাগী ভক্তের সঙ্গে ঠাকুর যেন আর চলে না যান, তার জন্য রয়েছে ঝাঁকি দর্শন বা ঝলক দর্শনের ব্যবস্থা। রয়েছে মহাপ্রভুর পাদুকা, ১২ বছর অন্তর বিগ্রহের অঙ্গরাগের সময় এই পাদুকা পূজিত হয়। গৌরীদাস পণ্ডিতের এই বাড়ি  'মহাপ্রভু বাড়ি' বলেই পরিচিত।

এই বাড়ি থেকে কিছুটা পশ্চিমে সূর্যদাস পণ্ডিতের বাড়ি, সূর্যদাস পণ্ডিতের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবার সঙ্গে, চৈতন্যদেবের ইচ্ছাতেই শ্রী নিত্যানন্দের বিবাহ হয়। চিহ্নিত করা রয়েছে বিবাহ-স্থল। আমরা ছোটো থেকে সেটাই জেনে আসছি। তবে নরহরি চক্রবর্তী নিত্যানন্দের বিবাহ স্বীকার করলেও স্থান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মত বসুধা জাহ্নবার সঙ্গে শালিগ্রামেই নিত্যানন্দের বিবাহ হয়। যাইহোক, আমরা করছি কালনা দর্শন। তর্কে লাভ নেই। নিতাই-গৌর, দুই ভাই আমাদের। গৌরীদাস - সূর্যদাস এর দুই বাড়ী আমাদের। সেবা আমাদের। অবারিত দ্বার। তবে মহাপ্রভু বাড়ির বিগ্রহের দর্শন অল্প সময়ের, বিগ্রহের ছবি তোলা যাবে না; নিতাই এর বাড়ির বিগ্রহ  তৈরি করানো হয়েছিল, এ বিগ্রহ যতক্ষণ ইচ্ছা দর্শন করা যাবে, ছবি তোলা যাবে।

পরেরদিন নিয়ে যাব অন্য মন্দির দর্শনে। আজ কিছু ছবি দিয়ে যাই। (ক্রমশঃ)

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Ambika Kalna)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours