দেবিকা ভট্টাচার্য, লেখিকা ও লেকচারার, চন্দননগর, হুগলি:

ধর্মের বল নাকি অনন্ত নির্ঝর থেকে নিঃসৃত। এইজন্য সে, আপাতত অসুবিধা, বারবার পরাজয় এমনকি মৃত্যুকেও ভয় পায় না। বিচার বুদ্ধির সীমা—ফলাফল লাভে বা মৃত্যুতেই আবদ্ধ কিন্তু ধর্মের  কোনও গণ্ডী হয় না। একটিমাত্র কুয়োয় কি সমস্ত দেশের তৃষ্ণা দূর হতে পারে যেখানে আবার তার অনাবৃষ্টিতে শুকিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে? কিন্তু যেখানে চির নিঃসৃত নদী প্রবাহিত, সেখানে যে কেবল তৃষ্ণা নিবারণের কারণ বর্তমান তা নয়, সেখানে সেই নদী থেকে স্বাস্থ্য জনক বায়ু প্রবাহিত হয়, দেশের মলিনতা ধৌত হয়, ক্ষেত্র শস্যপূর্ণাও হয়; এককথায় সমগ্র দেশের শ্রী বৃদ্ধি হয়। ঠিক তেমনই বুদ্ধি-বলে কিছুদিনের জন্য সমাজ রক্ষা হতে পারে, কিন্তু ধর্ম-বলে চিরদিন সমাজের রক্ষা হয়, সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে সমাজের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য বিকশিত হতে থাকে। 

এত কথা বলা এই জন্য, এবার যেখানে নিয়ে যাব, সেই রাজবাড়ি চত্বরে প্রবেশ করার আগে বর্ধমান মহারাজাদের সম্পর্কে নিজেদের মনে একটা ধারণা, একটু শ্রদ্ধার স্থান তৈরি করা। রাজপরিবারের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ধর্মের প্রকৃত অর্থ তাঁরা বুঝেছিলেন। এই রাজবংশ সকল সম্প্রদায়ের ধর্মচর্চাতে এবং ধর্মীয় স্থান প্রতিষ্ঠাতে যথেষ্ট বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। 

শোনা যায়, ১৬১০ খ্রীষ্টাব্দে পাঞ্জাবের লাহোরের কোটলি মহল্লার অধিবাসী সঙ্গম রায় পুরী ভ্রমণ করে ফিরে যাওয়ার পথে ভুল করে বর্ধমান উপস্থিত হন এবং গাংপুরের কাছে বল্লুকা নদীতীরে তাঁবু ফেলেন। তাঁর আর পাঞ্জাব ফিরে যাওয়া হয়নি। কম্বল, শাল এবং তেজারতি ব্যবসা করে বর্ধমান থেকে পাঁচ মাইল দূরে বৈকুণ্ঠপুরে বসতি স্থাপন করেন। তখন নবাব জাহাঙ্গীরের আমল। বর্ধমানের জায়গীরদার শের আফগান নিহত হয়েছেন, তাঁর পত্নী নূরজাহানকে জাহাঙ্গীর দিয়েছেন সম্রাজ্ঞীর সম্মান। সেই মোগল আমল থেকে শুরু এক ব্যবসায়ীর উত্তর পুরুষদের রাজা হয়ে ওঠার গল্প। ১. সঙ্গম রায়— বঙ্কুবিহারী রায় (দিল্লি সম্রাটের প্রতি আনুগত্য ও বিপদকালে সাহায্যদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছিলেন রায়-ই-রায়ান উপাধি)- ২. আবুরাম রায় (১৬৫৭ সালে কোতোয়ালের পদ লাভ করেন)— ৩. বাবুরাম রায় (বার্ষিক তিন লক্ষ টাকা খাজনার বিনিময়ে বর্ধমান ও তিনটি মহলের অধিকার লাভ করেন) — ৪. ঘনশ্যাম রায়— ৫. কৃষ্ণরাম রায় (জমিদারি প্রসারিত করেন, সম্রাট ঔরঙ্গজেবের ফরমান অনুসারে পরগণার বর্ধমানের জমিদার এবং চৌধুরী পরিচয় সম্মানিত হন)— ৬. কীর্তিচাঁদ রায় (উত্তরাধিকার সূত্রে ৪৯ টি মৌজার জমিদারি লাভ করেন— ৭. চিত্রসেন রায় (মুঘল সনদ অনুযায়ী 'রাজা' উপাধি সহ জমিদারি লাভ করেন)— ৮. রাজা ত্রিলোকচাঁদ—  ৯. রাজা তেজচাঁদ— ১০. রাজা প্রতাপচাঁদ (জীবনটিকে ঘিরে উত্তমকুমার অভিনীত 'সন্ন্যাসী রাজা' সিনেমার প্লট লক্ষ করা যাবে)— ১১. মহাতাব চাঁদ— ১২. আফতাব চাঁদ— ১৩. বিজয়চাঁদ— ১৪. উদয়চাঁদ (১৯৫৩ রাজন্য প্রথার বিলোপ ঘটে) — এই হলো বর্ধমান রাজের ১৪ পুরুষের হিসাব। এঁদের মধ্যে আমরা কালনাবাসী, কীর্তিচাঁদ ও তাঁর মাতা ব্রজকিশোরী দেবী থেকে তেজচাঁদ পর্যন্ত রাজাদের সঙ্গে পরিচিত হবো কালনায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মন্দিরের মাধ্যমে। প্রতাপচাঁদ, সে জাল বা সত্যি যাইহোক শেষবারের মতো তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল এই কালনা থেকেই। এরপর যেসব রাজার নাম রয়েছে (মহাতাব থেকে বিজয়চাঁদ পর্যন্ত প্রত্যেকেই দত্তক পুত্র), এঁরা কালনার মন্দির বা অন্যান্য বিষয় রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন দায়িত্বের সঙ্গেই। এই রাজবংশের রাজাদের হুকুমনামাগুলি প্রমাণ করে যে, তাঁরা কোনও বিশেষ সম্প্রদায়কে অধিক সমর্থন করে 'দাপুটে শ্রেণী'তে পরিণত হননি।

যেহেতু আমাদের মন্দির পরিদর্শনই প্রধান উদ্দেশ্য তাই রাজাদের গল্প আর না বাড়িয়ে চলে যাব কালনার ফটকদ্বার অর্থাৎ যেখানে এককালে রাজবাড়ির প্রধান দরজা ছিল, তা পেরিয়ে (নামটাই আছে, ফটক নেই) নব কৈলাশ মন্দির বা ১০৮ শিবমন্দিরের দিকে। বিষ্ণুপুরে রাজকীয় ভূসম্পত্তির স্থানান্তর এবং মালিকানা উদযাপন করার জন্য ১৮০৯ সালে মহারাজা তেজ চন্দ্র বাহাদুর দ্বারা এই মন্দির নির্মিত হয়েছিল। একটি স্থাপত্য বিস্ময়, এই মন্দিরের কাঠামো দুটি সমকেন্দ্রিক বৃত্তের একটি সমন্বয়, যার মধ্যে প্রতিটি ছোট মন্দির ভগবান শিবকে নিবেদিত করা হয়েছে। এটি একটি পুঁতির অক্ষমালাকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং এই মন্দিরের দেয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের কিছু  চিত্র এবং শিকারের বহু দৃশ্য রয়েছে। বাইরের দিকে চুয়াত্তরটি মন্দির আছে এবং ভিতরে চৌত্রিশটি মন্দির আছে যেগুলি মঙ্গলকর চিন্তাভাবনাসহ পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে নির্মিত হয়েছে। এই ১০৮ টি মন্দিরের প্রতিটিতে একটি করে শিব লিঙ্গ রয়েছে। ভেতরের প্রতিটি শিব লিঙ্গ সাদা রঙের; বাইরের বৃত্তে অর্ধেক শিবলিঙ্গ (একটি সাদা, একটি কালো, এভাবে সাজানো) কালো পাথরের।

বছরের যেকোনও সময় তো মন্দির দর্শন করাই যায়, শিবরাত্রি ব্রততে প্রত্যেক শিবের মাথায় 'নমঃ শিবায়' বলে জল দিলে আপনা আপনি এক'শ আট বার জপ হয়ে যায় ভেবে বেশ রোমাঞ্চ হতো একটা সময়। আমাদের জীবনের সেই সময়টায় মন্দিরের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল বলা যাবে না। মন্দিরগুলির বেশ কয়েকটির গা থেকে খসে পড়ছিল ইটের টুকরো, কোনোটার দরজা ভাঙা, কোনোটার ছাদ থেকে চাঙর খসে আসছে। এখন একটু যত্ন নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বহু মন্দিরের গা থেকে হারিয়ে গেছে নকশা, কারুকার্য। মন্দিরগুলির অবস্থা খুব ভালো না হলেও এখন অন্তত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা হয়, বাগানটিরও বেশ  যত্ন নেওয়া হচ্ছে বলেই মনে হয়।

১০৮ শিব মন্দিরের সঙ্গে  বাইরের দিকে আরও দু'টি শিব মন্দির একই সঙ্গে উদ্বোধন হয়েছিল বলে শুনেছি বাবার কাছে। এও শুনেছি ওই মোট ১১০ টি শিব প্রতিষ্ঠার দিন বাইশজন পণ্ডিতকে বর্ধমান জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা হয়েছিল রাজার ইচ্ছানুসারেই। প্রত্যেক ব্রাহ্মণের উপর দেওয়া হয়েছিল পাঁচটি করে শিবপ্রতিষ্ঠার ভার। আমার পূর্বপুরুষ অম্বিকা কালনায় এসেছিলেন তখনই। আমার দাদু লক্ষ্মী নারায়ণ ভট্টাচার্যের পূর্বপুরুষ রামজয় তর্কভূষণ (বন্দ্যোপাধ্যায়) ছিলেন শঙ্করপুরের (গন্তার থানা) বাসিন্দা। সেখান থেকে, এই মন্দির প্রতিষ্ঠা সূত্রেই কালনায় আসা; গঙ্গার (তখন গতিপথ ছিল অন্য) ধারে বসতি স্থাপন (রাজা কিছুটা নিষ্কর জমি দান করেন), প্রতি মাসে (প্রথমে কত ছিল জানা যায়নি) সাম্মানিক পেয়ে সংসার প্রতিপালন। পুরুষানুক্রমে চলতে থাকে ১০৮ শিব বাড়ির সেবা।

জানি, ইতিহাসের এত কচকচি ভালো লাগছে না, কিন্তু এখানে একটা কথা জানাই, আমিও ছোটোকাকার কাছ থেকে সদ্যই জেনেছি, বেনারসের বাসিন্দা বিদ্যানিধি শর্মা বর্ধমান নবাবহাটের ১০৮ শিব মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ বর্ধমান রাজার অনুগ্রহে বর্ধমানে আসেন। তাঁরই চতুর্থ পুরুষ এলেন কালনার মন্দির প্রতিষ্ঠায়। তর্কভূষণের উত্তর পুরুষ আমি, দেখা যদি হতো একবার, তর্কটা আয়ত্ত করেই ছাড়তাম।

রাজাদের ইতিহাস স্বাভাবিকভাবেই বহু আলোচিত। রাজন্য প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত রাজা এখানে না থাকলেও চার পুরুষ পর্যন্ত সেই সাম্মানিক দেওয়া হতো। বাবার স্মৃতি অনুযায়ী মাসোহারা বারো আনা থেকে হয়েছিল পাঁচ টাকা। পরে বিভিন্ন কাজের চাপে দাদু ১০৮ শিব মন্দিরের দায়িত্ব ভার তাঁরই পরিচিত অপরজনের হাতে তুলে দেন। রাজাদের ইতিহাস স্বাভাবিকভাবেই বহু আলোচিত। কিন্তু কে আর মনে রাখে কারা এই স্থাপত্য নির্মাণ করল আর কাদের হাতে মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হল? রাজার দেওয়া 'ভট্টাচার্য' উপাধিটুকু আজ রয়ে গেছে। কিন্তু দাদুর কাছে বসে রাজবাড়ি আর রাজার গল্প শুনতে শুনতে যে অদ্ভুত টান সেখানকার প্রতি জন্মেছি, তারই বশে তোমাদের কাছে গল্প শোনাতে বসে গেছি। শুধু ১০৮ শিব বাড়ি নয়, আমাদের অনেকেরই খেলা, বড়ো হয়ে ওঠা ঘিরে রাজবাড়ি, রাজবাড়ির মাঠের গল্প। (ক্রমশঃ)

(ছবি সৌজন্যে প্রতিবেদক স্বয়ং)

(www.theoffnews.com - Ambika Kalna)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours