ইরানী বিশ্বাস, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও পরিচালক, বাংলাদেশ:

প্রাচীন যুগ অনুযায়ী হিন্দু বিয়ের রীতিতে ছেলেরা বিয়ে করতে যাবার আগে মাকে বলে, মা চিন্তা করো না। তোমার জন্য বাদী আনতে যাচ্ছি। অর্থাৎ এই মা, স্বামীর পরিবারে এসেছিল বাদী হয়ে। যুগ যুগ ধরে মেয়েরা স্বামীর বাড়ি আসে বউ হয়ে নয়, বাদী হয়ে। স্বামী-সন্তানের সেবা করার জন্য।

এতক্ষন মহাভারত রামায়ণ ও পুরানো শাস্ত্রের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। এ কাহিনী সকলেরই জানা। তবুও অনেকদিন পর মহাভারতের কাহিনী শুনতে আশাকরি কারোরই খারাপ লাগেনি। মহাভারত লিখেছিলেন ব্যাসদেব। আর রামায়ন লিখেছিলেন বাল্মীকি। তাঁরা দুজনেই ছিলেন পুরুষ। আমার ধারণা মহাকাব্য দুটি যদি কোন নারী লিখতেন তাহলে অনেক কিছু সংস্করণ করেই লিখতেন। এর মাধ্যমে বোঝা যায় পুরাকাল হতে মেয়েরা নিগৃহীত। 

(১) মহাভারতের কথায় দ্রৌপদী ছিল একটি ‘জিনিস’। তাহলে কি বুঝবেন, মেয়েরা পুরাকাল থেকেই বস্তু হিসাবে পরিগনিত হয়ে এসেছে। তাদেরকে মানুষ হিসাবে ভাবার অবকাশ ছিল না। মহাভারতে দেখতে পাই দ্রৌপদীর পাঁচ স্বামী। কিন্তু বর্তমান কালে হিন্দু ধর্ম বা আইন মতে মেয়েদের একটির অধিক বিয়ে ন্যায় সঙ্গত নয়। তাহলে দ্রৌপদীকে কি ব্যাভীচারী বলা যায় না!

(২) রাজকন্যা আর রাজত্ব পাওয়ার কথা গল্প বা ধর্মীয় কাহিনীতে বর্ণিত থাকলেও বাস্তবে এখন তার উল্টৌ দেখা যায়। বর্তমান সময়ে হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী পিতার সম্পত্তিতে নারীর কোন অধিকার নেই।

(৩) রাম একজন দেবতা। তিনি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয়ই জানতেন সীতার কোন কলঙ্ক নেই। তবে কেন প্রজাদের সামনে একটি বারের জন্যও বলতে পারেননি সীতা পবিত্র। তার কোন কলঙ্ক নেই। স্ত্রীর পক্ষ হয়ে কথা বললে কাপুরুষের পরিচয় মিলবে, এ ভয়ে রাম সেদিন মুখ খোলেননি।

ধর্ম নিয়ে তর্কে যাবার ইচ্ছা আমার নেই। আমি ধর্মে বিশ্বাস করি। ধর্ম মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। বর্তমান কালে সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। সুতরাং পুরাকালের কথা বাদ দেওয়াই ভাল। 

নারীর অধিকার নিয়ে পারিবারিক ভাবে বা আদালতে আইনি লড়াই যুগ যুগ ধরে বহমান। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৮ মার্চ বিশ্বব্যাপি পালিত হয় বিশ্ব নারী দিবস। শুধু তাই নয়, নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination against Women, যা সংক্ষেপে CEDAW হিসাবে পরিচিত। বাংলায় এটিকে নারীর প্রতি সব বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) বলা হয়। প্রায় ৩ বছর পর ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে এই সনদ কার্যকর শুরু হয়। সিডও সনদে তিনটি মৌলিক নীতি রয়েছে। ১. সমতার নীতি, ২. বৈষম্যহীনতার নীতি, ৩. শরিক রাষ্ট্রগুলোর দায়বদ্ধতার নীতির ওপর ভিত্তি করে রচিত সনদে রয়েছে ৩০টি ধারা। ১ থেকে ১৬ পর্যন্ত ধারাগুলোতে ঘোষিত হয়েছে নারীর সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীত নীতিগুলো। ১৭ থেকে ২২ ধারায় বর্ণিত হয়েছে সিডও ও কর্মপন্থা ও শরিক রাষ্ট্রগুলোর দায়বদ্ধতা পালনের পন্থাগুলো।

হিন্দু নারী উত্তরাধিকার আইন পৃথিবীর সব থেকে কঠিন এবং কঠোর আইন। হিন্দু মেয়েরা পিতার স্থাবর কোন সম্পত্তির অধিকারী নয়। প্রাচীনকাল থেকে হিন্দু আইন মোতাবেক মেয়েদের সম্পদ দুই প্রকার। ১. উত্তরাধিকার, ২. স্ত্রীধন।

উত্তরাধিকার বলতে বোঝানো হয়েছে স্বামীর সম্পত্তির উপর স্ত্রীর কতটুকু অধিকার থাকবে, না থাকবে তার মাপকাঠি। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় স্বামীর সম্পদের উপর স্ত্রীর কোন রকম অধিকার নেই। কেবল মাত্র ভোগ করতে পারবেন। তবে ১৯৩৭ সালের অবিভক্ত ভারতীয় হিন্দু আইন অনুযায়ী স্বামী মারা যাবার পর হিন্দু বিধবা নারী তার স্বামীর সম্পত্তিতে সন্তানদের পাশাপাশি ভাগ পাবেন এবং তা ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু বিক্রয় করতে বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। একে সহজ ভাষায় জীবনস্বত্ব বলে। এমনকি তীর্থে যাবার বা চিকিৎসার প্রয়োজনেও স্বামীর সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারবেন না। বিধবার মৃত্যু হলে তার প্রাপ্ত সম্পত্তি পরবর্তী পুরুষ উত্তরাধিকারীদের হাতে ফিরে যাবে। (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Bangladesh family asset hindu women)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours