তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:
এই মামলা সংক্রান্ত সর্বপ্রাচীন যে নথিটি হাতে এসেছে, সেটি ১৭৮০ সালের ৮ মে সুপ্রিম কোর্টে করা একটি আবেদনপত্র। প্রয়াত গোবিন্দরাম ঠাকুরের সম্পত্তির আইনি অধিকার চেয়ে যৌথ ভাবে এই আবেদন করেন নীলমণির জ্যেষ্ঠ পুত্র রামলোচন (যাঁর পালিত পুত্র ছিলেন দ্বারকানাথ) এবং দর্পনারায়ণের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাধামোহন। দুই আবেদনকারী জানান, প্রয়াত গোবিন্দরাম তাঁর মৃত্যুর আগে কোনও ইচ্ছাপত্র বা উইল রেখে যাননি, তাই গোবিন্দরামের একমাত্র বিধবা স্ত্রী রামপ্রিয়ার অনুমতিক্রমে তাঁরা এই সম্পত্তির অধিকার চাইছেন। এই আবেদনপত্রে তাঁরা সেই সময়ে গোবিন্দরামের সম্পত্তির মূল্য ১০ হাজার ৩০০ টাকা ছিল বলে দাবি করেন। মামলাটি তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রখ্যাত বিচারক জন হাইড-এর এজলাসে ওঠে। এ বিষয়ে আদালতে হলফনামা জমা করলে ২৩ মার্চ তারিখে দুই জ্ঞাতি ভাই যৌথ ভাবে গোবিন্দরামের সম্পত্তির মালিকানাও পেয়ে যান। অর্থাৎ, সম্পত্তি ভাগের জন্য নীলমণি এবং দর্পনারায়ণ ঠাকুরকে রামপ্রিয়া প্রথমে কাঠগড়ায় তোলেননি। বরং নীলমণি এবং দর্পনারায়ণ ঠাকুরই তাঁদের ছেলেদের সামনে রেখে ছোট ভাইয়ের অসহায় বিধবা স্ত্রীর ন্যায্য পাওনা ঠকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
ভাশুরের ছেলেদের দিয়ে তাঁর মৃত স্বামীর সম্পত্তি দখলের প্রচেষ্টার কথা প্রথমে রামপ্রিয়ার জানা ছিল না। তাঁকে ঠকিয়ে রামলোচন এবং রাধামোহনের সম্পত্তি লাভের কথা জানতে পেরে যশোরের এই প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্না নারী ১৭৮০ সালের ১৬ মে সুপ্রিম কোর্টে পাল্টা মামলা দায়ের করেন। একই সঙ্গে নিজের অজান্তে এক ইতিহাসও তৈরি করেন তিনি। বাংলার তথা ভারতীয় নারীর স্বাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সম্পূর্ণ বিস্মৃত অধ্যায়। মনে রাখতে হবে, রামপ্রিয়াই প্রথম মহিলা, মৃত স্বামীর সম্পত্তির অধিকার আদায় করার জন্য যিনি সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন এবং জয়ীও হন।
রামপ্রিয়া ঠাকুরানি আদালতে বলেন, তাঁর অজ্ঞাতে রামলোচন ও রাধামোহনকে তাঁর প্রয়াত স্বামীর সম্পত্তির যে মালিকানা দেওয়া হয়েছে, তা ফিরিয়ে নেওয়া হোক। এবং প্রকৃত উত্তরাধিকারী হিসেবে অবিলম্বে তাঁকে এই সম্পত্তি হস্তান্তরিত করা হোক। রামপ্রিয়া আরও বলেন, তিনি এক জন হিন্দু বিধবা। তাই ধর্মীয় প্রথা অনুসারে তিনি আদালতে উপস্থিত হয়ে কোনও হলফনামা দিতে অক্ষম। এই কারণে তাঁকে আদালতে ব্যক্তিগত উপস্থিতি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হোক। জজসাহেবের কাছে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য একটি কমিশন গঠনেরও আবেদন করেন। রামপ্রিয়ার আবেদনে এই কমিশনের সদস্য হিসেবে জনৈক রামলোচন মুন্সী এবং নিকোলাস জেব-এর নাম প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ঠিক হয় ২০ মে। বলা হয়, এই দু’জন বা এঁদের মধ্য থেকে কোনও এক জনের সামনে তিনি শপথ নিয়ে লিখিত হলফনামা জমা দিতে প্রস্তুত।
আদালত সম্ভবত রামপ্রিয়ার এই দাবি মেনে নিয়েছিল। কেননা আমরা দেখি ২২ মে রামপ্রিয়ার স্বাক্ষরিত হলফনামার ভিত্তিতে পূর্বোক্ত বিচারক জন হাইডকে অন্তর্বর্তীকালীন রায় দান করতে। রামপ্রিয়া হলফনামায় বলেন, আদালতের রায়ে সম্পত্তির অধিকার পেয়ে তাঁর প্রয়াত স্বামীর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র বর্তমানে তাঁকে তাঁর স্বামীর সম্পত্তি থেকে উৎখাত করতে চাইছে। তাই আদালত যেন তার পূর্বোক্ত রায় স্থগিত ও বাতিল করে, নিষ্ঠাবান হিন্দু বিধবা রামপ্রিয়াকে সকল সম্পত্তি প্রত্যার্পণ করে। এই হলফনামায় আনন্দীরামের পুত্র রামতনু সাক্ষী ছিলেন।
বিচারক জন হাইড এই হলফনামা পড়ে পরবর্তী রায় দানের দিন ধার্য করেন ১৫ জুন ১৭৮০। দুঃখের বিষয়, আমাদের জানা নেই প্রস্তাবিত ১৫ জুন কোনও রায়দান হয়েছিল কি না। কারণ ওই দিনের রায় সংক্রান্ত কোনও নথি পাওয়া যায়নি। আসলে সেই সময় কোম্পানির ‘সুপ্রিম কাউন্সিল অব বেঙ্গল’-এর সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সীমা ও অধিকার নিয়ে এক বিবাদ চলছিল। যার ফলে বিচারপতিদের রায়দানও অনেক সময়ই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল।
যাই হোক, পরবর্তী কালে এই মামলা সংক্রান্ত আরও দু’টি নথি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। প্রথমটি ১৭৮১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রামপ্রিয়ার স্বাক্ষরিত এক পাতার একটি নথি এবং অপরটি স্বাক্ষরবিহীন চার পাতার একটি নথি। এই দু’টি নথিই ছিল প্রয়াত গোবিন্দরামের সম্পত্তির বিস্তারিত তালিকা। সোনা-রুপো-পিতল প্রভৃতির তৈরি বাসনকোসন, আসবাবপত্র থেকে বইখাতা, জমি-বাড়ি-বাগান, সব কিছুরই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখে রামপ্রিয়া সেগুলি আদালতে জমা করেছিলেন। এর পরই সম্ভবত কোনও এক দিন আদালত তার চূড়ান্ত রায় শোনায়। যদিও সেই রায়দানের সঠিক তারিখ এবং রায়ের আসল কপি পাওয়া যায়নি। কিন্তু ঠাকুর পরিবারের আদি পর্বের কথাকাররা আদালতের রায়ে রামপ্রিয়ার সম্পত্তির অধিকার লাভের কথাই শুনিয়েছেন।
সস্ত্রীক গোবিন্দরাম আমৃত্যু পাথুরিয়াঘাটার বাড়িতেই থাকতেন। স্বামীর মৃত্যুর পরেও রামপ্রিয়া এই বাড়ি ছেড়ে যাননি। কিন্তু মামলায় জয়লাভের পর তিনি এই বাড়ি ছেড়ে পাথুরিয়াঘাটার কাছে শিবতলায় একটি স্বতন্ত্র বাড়িতে উঠে যান। রামপ্রিয়া প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেও নরম মনের মানুষ ছিলেন। উপকারীর উপকারও তিনি ভোলেননি। তাঁর মূল হলফনামায় সাক্ষ্যদানকারী রামতনুর পুত্রকে তিনি পরবর্তী কালে অভাবের সময় অর্থসাহায্য করেছিলেন। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকেও তিনি কলকাতায় গৃহনির্মাণের জন্য অর্থ দিয়েছিলেন। রামপ্রিয়া ঠাকুরানি দীর্ঘায়ু ছিলেন, ১৮১৩ সালে আনন্দীরামের সম্পত্তি লাভের জন্য রাধাবল্লভের করা মামলার সময়েও জীবিত ছিলেন তিনি। তখন তাঁর বয়স ৯৮ বছর। তিনি শতায়ু হয়েছিলেন কি না, আমাদের জানা নেই। কিন্তু অত্যন্ত বিচক্ষণ রামপ্রিয়া আমৃত্যু তাঁর সম্পত্তি রক্ষা করেছিলেন, এ কথা জানা যায়।
প্রশান্তকুমার পাল তাঁর ‘রবিজীবনী’তে জানাচ্ছেন, ওই মামলার ফলে ১৭৮২ সালে রামপ্রিয়া রাধাবাজার ও জ্যাকসন ঘাটে দু’টি বাড়ির মালিকানা পান। হয়তো এই মামলার সূত্রেই নীলমণি ও দর্পনারায়ণ ঠাকুরের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে গোলযোগ দেখা দেয়। পরে আপসে
এই বিবাদ মিটিয়ে নেওয়া হয়। পাথুরিয়াঘাটার বাড়িটি পান দর্পনারায়ণ ঠাকুর, আর নিজস্ব উপার্জনলব্ধ অর্থ, নগদ এক লক্ষ টাকা ও লক্ষ্মীজনার্দন শিলা নিয়ে নীলমণি গৃহত্যাগ করেন। কলকাতার আদি বাসিন্দা বৈষ্ণবচরণ শেঠ নীলমণিকে মেছুয়াবাজার অঞ্চলে এক বিঘা জমি দান করেন। কিন্তু শূদ্রের দানগ্রহণে নীলমণি সম্মত হননি। বৈষ্ণবচরণ তখন লক্ষ্মীজনার্দন শিলার নামে ওই জমি দান করেন। এ ভাবেই ১৭৮৪ সাল থেকে জোড়াসাঁকোয় ঠাকুর পরিবারের বসবাসের সূত্রপাত। (সমাপ্ত)
(www.theoffnews.com - Rampriya Tagore)
Post A Comment:
0 comments so far,add yours