তপন সান্যাল, কবি, গীতিকার ও গবেষক, পাইকপাড়া, কলকাতা:

এই হিন্দুস্থানী সংগীতকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়। পর্যায়গুলি যথাক্রমেঃ

ক) উপজাতীয় গান (Tribal song)

খ) গ্রাম্য গান (Urban song)

গ) নাগরিক গান (Folk or Rural song)

উপজাতীয় গানও আবার ত্রিধারায় বিভক্ত।

১) প্রবন্ধ গান (Composed song)

২) দরবারী গান (Court or Art song)

৩) লঘু গান (Entertaining song)

উত্তর ভারতীয় দরবারী সংগীতই পরবর্তীকালে ‘হিন্দুস্থানী সংগীত’ হিসাবে পরিচিত হয়। সেটির আবার দুটি ভাগ।

ক) স্বদেশী গান (প্রবন্ধ-ভাঙ্গা রাগসংগীত)

খ) বিদেশী গান (মধ্যযুগীয় ইন্দো-পারসিক রাগ সংগীত)                       

এর পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা প্রসঙ্গে পন্ডিত ভাতখন্ডের প্রচারিত ও প্রবর্তিত নব্য যে হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতি, সেই সংগীত পদ্ধতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন বলে একজন গবেষকের দৃষ্টি ভঙ্গিতে আমার মনে হয়েছে। পরবর্তী ক্ষেত্রে, সংগীতের উচ্চতর শিক্ষার্থীদের সঠিক পথের অনুসন্ধানের জন্য সংগীত শাস্ত্রের মতের সাথে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, তার থেকে তারা যেন কোনোক্রমে বিচ্ছিন্ন না হয়। পূর্ববর্তী বিদগ্ধ সংগীত শাস্ত্রীদের মতের বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় পন্ডিত ভাতখন্ডের মতের সাথে। হিন্দুস্থানী সংগীত শাস্ত্রের কতটা সুবিধাজনক হল তার বিশ্লেষণও বিশেষভাবে প্রয়োজন।

উপরিউক্ত আলোচনার প্রাসঙ্গিকতা উঠে আসার পশ্চাতে সবচেয়ে বড় কারণ হল, পন্ডিত ভাতখন্ডে যে সময়ে সংগীত জগতে প্রবেশ করেছিলেন সেই সময়টায় যাঁরা সংগীতগুনী ছিলেন তাঁরা সকলেই পেশাদার দরবারী সংগীতজ্ঞ। দরবারী সংগীত বলতে বোঝায় পেশাদারী দরবারী সংগীতজ্ঞ। পেশাদারী ব্যবসায়িক সংগীতজ্ঞ রাজ-দরবারে  যাঁরা সংগীত পরিবেশন করে কৌশলের দ্বারা সকলকে সন্তুষ্ট করার মধ্যেই তাঁদের সাধনার সার্থকতা ছিল।

এই দরবারী সংগীতজ্ঞদের কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে প্রথাগত সংগীতের যে শাস্ত্র তার থেকে এবং তার ঐতিহ্য থেকে প্রায়শই বিরত থাকতে হয়। প্রাচীন শাস্ত্রগুলির ব্যাখ্যা না জানার কারণে পন্ডিতজীর পক্ষে সেই বিষয়ে ধারণা করা খুব কঠিন ছিল। কারণ এই দরবারী সংগীত প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্র থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল সেটা বোঝা তাঁর শিক্ষা না থাকার জন্য এই সমস্যা হয়েছিল। যাইহোক, মধ্যযুগে ভারতীয় সংগীত দুপ্রকার ছিল। লক্ষণ-যুক্ত লক্ষণ- সংগীত এবং লক্ষ্যসংগীত। কিন্তু লক্ষ্যসংগীত বলতে নিজের চোখে দেখে অনুধাবন করা যে, সংগীত তাকেই লক্ষ্যসংগীত বলা হয়। পন্ডিতজী সেই কারণে লক্ষ্যসংগীতের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিলেন এবং সেইকারনে তাঁর যে নবসিদ্ধান্তমূলক তত্ত্ব তার নাম রেখেছিলেন ‘শ্রীমলক্ষ্যসংগীতম্’। কারণ সংগীতবিদ্যা বলতে আমরা বুঝি সংগীতের শাস্ত্র, বিদ্যা এবং বিজ্ঞান। অর্থাৎ সঙ্গীতের যে কোনো বিষয়ের সত্যজ্ঞানই ‘সংগীতবিদ্যা’ বা মিউজিকোলজির অন্তর্ভুক্ত। অতএব সংগীত শাস্ত্রের ব্যাখ্যার যদি প্রাসঙ্গিকতা চলে আসে, তাহলে তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বা সমীক্ষা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন।

কবিগুরু তাঁর ‘সংগীত-চিন্তা’য় সংগীত ও ভাব অধ্যায়ে লিখেছেন যে-‘আমাদের সংগীত শাস্ত্র নাকি মৃত শাস্ত্র, যে শাস্ত্রের ভাবটা আমরা নাকি আয়ত্ত্ব করিতে পারি না, এইজন্য রাগ-রাগিনী বাদী ও বিসম্বাদী সুরের ব্যকরণ লইয়াই মহাকোলাহল করিয়া থাকি।(সংগীত-চিন্তা)।'

বর্তমানে যে হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের চর্চা করা হয় তাকে বলা হয় ক্লাসিক্যাল মিউজিক, এটি কিন্তু দরবারী সংগীত। বহু বছর পূর্বে আরেক ধরনের নিবদ্ধ সংগীত ছিল যাকে ‘প্রবন্ধ গান’ (composed music) বলা হত। তার মধ্যে গীত প্রবন্ধ (vocal composition) দেশী বা আঞ্চলিক রাগের ব্যবহার থাকবে। কিন্তু প্রবন্ধ পদ গান বলেই তার মধ্যে সবক্ষেত্রে প্রাধান্য পেত ভাবের। এবং ভাব থাকলেই তার মধ্যেই গীতাভিনয় ও রসের সঞ্চার হবে। গানে যদি অভিনয় না থাকে, তা হলে প্রাচীন ‘কাকু’ এবং শ্রুতিজাতির উল্লেখ প্রাচীন সংগীতশাস্ত্র না তা হলে দীপ্তা, আয়তা, মৃদ্যু, মধ্যা এবং করুণা এই পাঁচ প্রকার শ্রুতিজাতির ও প্রাসঙ্গিতা আসবে কি করে? একই স্বরকে নানা উচ্চারনের মাধ্যমে নানা ভাবের প্রকাশ হয়, আবার সুরবিহীন কথার ক্ষেত্রেও নানা উচ্চারণের ভঙ্গি ব্যবহার করা হয়। ভঙ্গি না থাকলে ভাব আসে না, আবার ভাব না থাকলে রসের উদভাবনা হয় না। ভারতীয় সংগীতে একটা প্রধান উপজীব্য বিষয়- রস না থাকলে নাট্য, সংগীত কোনো কিছুরই প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। কিন্তু ভাতখন্ডেজীর সংগীত-তত্ত্বের মধ্যে কিন্তু রস উপেক্ষিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সংগীত-চিন্তা’ গ্রন্থের একস্থানে লিখেছেন-

‘সংগীত বেত্তারা যদি বিশেষ মনোযোগ সহকারে আমাদের কী কী রাগিনীতে কি কী ভাব আছে, তাহাই আবিষ্কার করিতে আরম্ভ করেন, তবেই সংগীতের যথার্থ উপকার করেন।’ (রাগ ও ভাব) তিনি আরো বলেছেন ----

‘কেন বিশেষ বিশেষ এক এক রাগিনীতে বিশেষ একটা ভাবের উৎপত্তি হয় , তার কারন বাহির করুন।’ (ক্রমশঃ)

(www.theoffnews.com - Indian song history)

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours